বেদে গো-মনুষ্য হত্যাকারীকে, সীসার গুলি বিদ্ধ করতে বলা হয়েছে।।

বেদে গো-মনুষ্য হত্যাকারীকে,
সীসার গুলি বিদ্ধ করতে বলা হয়েছে

ভারতবর্ষের সমাজ কৃষি ভিত্তিক সমাজ।এ কৃষি ভিত্তিক সমাজের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে রয়েছে গো জাতি। মাতৃদুগ্ধের পরে গোদুগ্ধ পান করে শিশু বেঁচে থাকে বলে গো জাতিকে মাতার সমতূল্য মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গো জাতি অহিংস্র, তারা কারো কখনও ক্ষতি করে না। বরং তার দেহের যথাসর্বস্ব দিয়ে জগতের কল্যাণ করে। তাই ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে:

প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়
মা গামনাগা মদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৮.১০১.১৫)

"জ্ঞানবান মনুষ্যের নিকটে বলছি যে, নিরপরাধ অহিংস্র পৃথিবী সদৃশ গো জাতিকে হত্যা করিও না।"

বেদের বিভিন্ন স্থানেই গো জাতিকে 'অঘ্ন‍্যা' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বেদাঙ্গে মহর্ষি যাস্কের নিরুক্তে 'অঘ্ন‍্যা' শব্দের এই ব‍্যাখ‍্যায় বলা হয়েছে - "অঘ্ন‍্যা অহন্তবা” ( নিরুক্ত:১১.৪৪)। অর্থাৎ গো জাতি হলো অবধ‍্য। তাদের কখনো হত্যা করা যাবে না। অর্থববেদের 'অগ্ন্যা' সূক্তে জগতী ছন্দে ঋষি কাঙ্কায়ন বারবার 'অঘ্ন‍্যা' বলে সম্বোধন করেছেন।মদ্যাসক্ত আসক্ত ব্যক্তির নিকটে যেমন মদ্য প্রিয়, তারা শুধু মদ্যের সন্ধানে এবং অপেক্ষাতেই থাকে; মাংস প্রিয় মাংসাশী যেমন মাংসের অপেক্ষাতেই থাকে; একজন জুয়াড়ির কাছে যেমন জুয়াখেলার স্থান প্রিয়; একজন অত্যন্ত কামাসক্ত সুরতাকামী পুরুষের মন সর্বদা স্ত্রীবিষয়েই আসক্ত হয়ে থাকে; ঠিক সেই রকমভাবে যেন অবধ্য 'অঘ্ন্যে' গাভীকে আমরা রক্ষা করতে পারি এবং অবধ্য গাভি এবং তাঁর বৎসের সম্পর্ক যেন বিনষ্ট না হয়। অর্থাৎ বৎস থেকে যেন গাভীকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত করে বিচ্ছেদ করা না হয়।

যথা মাংসং যথা সুরা যথাক্ষা অধিদেবনে।
যথা পুংসো বৃষণ্যত স্ত্রিয়াং নিহন্যতে মনঃ।
এবা তে অঘ্ন্যে মনোঽধি বৎসে নি হন্যতাম্ ॥ ১॥
যথা হস্তী হস্তিন্যাঃ পদেন পদমদ্যুজে।
যথা পুংসো বৃষণ্যত স্ত্রিয়াং নিহন্যতে মনঃ।
এবা তে অঘ্ন্যে মনোঽধি বৎসে নি হন্যতাম্ ॥ ২॥
যথা প্রধির্ষথোপধির্ষথা নভ্যং প্রধাবধি।
যথা পুংসো বৃষণ্যত স্ক্রিয়াং নিহন্যতে মনঃ।
এবা তে অঘ্নো মনোঽধি বৎসে নি হন্যতাম্ ॥ ৩॥
(অথর্ববেদ সংহিতা: ৬ কাণ্ড,৭ অনুবাক,৯ সূক্ত.১-৩)

"সুরাসক্তের নিকট সুরা প্রিয়, মাংসাশীর নিকট মাংস প্রিয়, দ্যূতকারের নিকট দ্যূতস্থান প্রিয়, সুরতাকামী পুরুষের মন স্ত্রীবিষয়ে আসক্ত হয়ে থাকে, সেই রকমই, হে অবধ্য গাভী! তোমার এই বৎস তোমার প্রিয় হোক।

হস্তী যেমন প্রীতিতে নিজের পা হস্তিনীর পায়ের উপরে তোলে, যেমন সন্তানদাতা পুরুষ স্ত্রীবিষয়ে প্রসন্ন হয়, তেমনই, হে অবধ্য গাভী! তুমি তোমার বৎসের প্রতি প্রসন্ন থাকো।

যেমন রথচক্রের মধ্যফলকের সাথে নেমি দৃঢ়তার সাথে বন্ধনযুক্ত হয়ে থাকে বা দৃঢ় সম্বন্ধযুক্ত হয়, তেমনই, হে ধেনু! তুমি বৎসের সাথে বন্ধনযুক্ত হয়ে থাকো। যেমন কামী পুরুষের মন স্ত্রীবিষয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকে, তেমনই, তোমার মন এই বৎসে মুগ্ধ হয়ে থাকুক। "

অর্থববেদ সংহিতায় গো, অশ্ব ও মানুষকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। যারা এদের হিংসা কর বা হত্যা করতে উদ্যত তাদের সীসকের গুলি (সীসেন বিধ্যামো) দ্বারা বিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এরপরেই প্রার্থনা করা হয়েছে, পরিবারে যেন বীরত্বমণ্ডিত পৌরুষদীপ্ত সন্তানের জন্ম হয়। বেদমন্ত্রে গো, অশ্ব ও মানুষকে রক্ষায় সীসকের গুলির ব্যবহার দেখে, আমরা কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। তা হলো- বৈদিকযুগে, গো, অশ্ব এবং নিরপরাধ মানুষ্য হত্যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিলো এবং সেযুগেও বর্তমান কালের বন্ধুকের মতই সীসকের গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিলো।

যদি নো গাং হংসি যদশ্ব্যং যদি পুরুষম্।
তং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোঽসো অবীরহা।।
(অর্থববেদ সংহিতা: ১. ১৬.৪)

" যদি তুমি যদি আমাদের গরু, অশ্ব ও প্রজাদিগকে হিংসা কর বা হত্যা কর ; তবে তোমাকে সীসকের গুলি দ্বারা বিদ্ধ করবো। আমাদের মধ্যে যেন বীরত্বহীন কাপুরুষের জন্ম না হয়।"

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted