অসাম্প্রদায়িকতা এক জিনিস আর অন্যের ঘা পাঁচড়াকে প্রশংসা করা অন্য জিনিস।

কাশ্মীরের শ্রীনগরে হজ করে ফিরে আসা হাজীদের ‘মুহাম্মদ বন্দনা’ গেয়ে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছে কাশ্মীরী হিন্দু পন্ডিতরা! এই সেই কাশ্মীরী পন্ডিত সম্প্রদায় যারা উপত্যকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে জন্মভূমি হারিয়েছিলো। গত কয়েক বছর ধরে যখন উপত্যকায় কিছু কিছু কাশ্মীরী পন্ডিত ফিরছিলো তখন তাদের গুপ্ত হত্যা করা হচ্ছিল। এরকম সময়ে হজযাত্রীদের ‘মুহাম্মদের বন্দনা’ গেয়ে অভ্যর্থনা জানানো অভাবনীয়! কেননা ইমেজ সংকট যদি কারোর তৈরি হয়ে থাকে সেটা কাশ্মীরী মুসলমানদের। ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এই রাজ্যে হিন্দুদের জায়গা হয়নি। এটি পাকিস্তান বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ভাবমূর্তি ভারতের মধ্যেই দেখতে পাওয়া গেছে। এটা তো কাশ্মীরী মুসলমানদের উচিত ছিলো হিন্দুদের মনে অভয় জাগাতে এমন কিছু করা...।



আসলে হিন্দুদের বুঝা একটু কঠিন। আমি একদিন দেখলাম একজন হিন্দু মহিলা একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে করে মসজিদের সদর দরজায় মেঝেতে বাচ্চার কপালটি ঠেকিযে ধরেছে ভক্তি ভরে। এমন কৌতুহল হলো তাই জিজ্ঞেস করে ফেললাম মন্দির থাকতে মসজিদ কেন? মহিলা আমাকে যা বললেন তা এরকম, মন্দির তো কিছুটা দূরে আর এই মসজিদটি আমার একদম ঘরের সামনে... আর মন্দির মসজিদ দুটোই তো পবিত্র আর একজনের জন্যই বানানো হয়েছে...। 

হিন্দুদের ছোঁয়াছুয়ি জাতপাতের এমন সংক্রীর্ণতা থাকার পরও তারা পীরের দরগায় শিরনি চড়ায়! মসজিদ দেখলে প্রণাম করে। আপনি জীবনে একজনও মুসলমান পাবেন না যিনি মন্দিরকেও পবিত্র মনে করে সেলাম ঠুকে। সে যতই উদার মুসলমানই হোক, সে কখনো মনে করবে না মন্দির মসজিদ দুটোই একই ও একজনের উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে। এরকম চিন্তা কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মানুষই করতে জানে। সোজা বাংলা এটা হিন্দুদের মনস্তাত্বিক অবস্থান। এটা ইহুদী খ্রিস্টানদেরও নেই। আমার এক ফেইসবুক বন্ধু বলেছেন, যদি সুলতান মাহমুদ ভারত লুট করে চলে যাবার সময় ভারতের মাটিতেই মরে যেতে তাহলে তার ‘মাজারে’ হিন্দুরা গিলাফ চড়াতো!...

এখানেই আসলে আমার আপত্তি আর অস্বস্তিটা! অসাম্প্রদায়িকতা এক জিনিস আর অন্যের ঘা পাঁচড়াকে প্রশংসা করা অন্য জিনিস। সুলতান মাহমুদ একটা ডাকাত ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সুলতান মাহমুদকে ভারতীয়রা তাদের পাঠ্যবইতে ডাকাত হিসেবেই পড়বে। কিন্তু সেটি ঘটেনি। নেহাত মাহমুদ ভারতে থেকে যায়নি তাহলে সুলতান মাহমুদকে আমি ডাকাত বলায় ভারতীয় হিন্দু কমিউনিস্ট আর লিবারালরা এখনি আমাকে আরএসএস বিজেপির পেইড এজেন্ট বলে দিতো!

বাংলাদেশের সিলেটের শাহজালাল পীরের মাজারে হিন্দুরা ভক্তিভরে মানত করতে যায়। ভারতবর্ষে সুফিদের জিহাদের তরোয়ালে একেকটি জনপদ কেঁপে উঠেছিলো। হিন্দু বৌদ্ধ মন্দিরে গরুর রক্ত ছিটিয়ে দিয়ে মহাসুখ পেতো তারা। কিন্তু কালের বিবর্তণে সেই হিন্দুরাই পীর বাবাদের ভক্ত বনেছে। তাতে সমস্যা নেই। সমস্যাটা ঘটেছে অন্যখানে। কদিন আগেই সিলেটের বন্যায় হিন্দুদের ইসকন ত্রাণ কার্যে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিলো। গত রমজান মাসে ইসকন ও বৌদ্ধ বিহারগুলি ইফতার বিতরণও করেছিলো। তারপরই কুরবাণীর ঈদের পর পর  নড়াইলে দুইশো হিন্দু বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটল। গণিমত লুট হলো যথেষ্ঠ। বহু পরিবারের আজীবন ধরে তীল তীল করে গড়ে উঠা সঞ্চয় লুট হয়েছে একরাতে।

 এনায়েতউল্লাহ আব্বাসী নামের একজন ওয়াজী হুজুরের ওয়াজ আছে যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করলে পরকালে এজন্য কোন মুসলমানকে জবাবদেহী হতে হবে না। যারা এনায়েতউল্লাহ আব্বাসীকে সহি ইসলাম জানে না দাবী করবেন তাদের কাছে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা- ইসলামে ‘গণিমতের মাল’ জিনিসটা কি একটু জানাবেন? জিহাদের ফলে কাফেরদের সম্পত্তি (এই সম্পত্তির তালিকায় কাফেরদের নারীরাও রয়েছে) মুসলমানদের দখলে আসবে তখন এগুলো জিহাদীদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। গণিমতের মালের বন্টন কুরআনে স্পষ্ট করে বিধান দিয়েছে যে গণিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লা ও তার রসূলের (সুরা আনফাল, আয়াত-৪১)! মানে দশ বস্তা চাল লুট হলে এক বস্তা আল্লাহ ও তার রসূলের। যদি দশটি নারী আটক হয় তার একটি আল্লাহ ও তার রসূলের! তাহলে এনায়েতউল্লাহ আব্বাসী যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে হিন্দুদের সম্পত্তি লুট করলে পরকালে জবাবদেহী হতে হবে না বলেছে সেটি তো আর মিথ্যে বলেনি। এই রকম শাস্ত্রীয় জ্ঞান যারা মাদ্রাসায় চৌদ্দ পনেরো বছর অধ্যায়ন করে মসজিদের ইমামের চাকরি নেন তাদেরকে নড়াইল-২ আসনের এমপি কাম ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তোজা বলেছেন এলাকায় সকলকে জ্ঞান দিতে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম! ইমামরা রসূলের শান্তির বাণী প্রচার করবে!... আমার দেখা সেই হিন্দু নারীর ধর্মীয় অজ্ঞতার সঙ্গে মাশরাফির ধর্মীয় অজ্ঞতার কোন অমিল নেই। তবে তফাত আছে। সেই হিন্দু মহিলা মনে করেন মন্দির মসজিদ দুটোই একই ও পবিত্র কিন্তু মাশরাফি যত ভালো মুসলমানই হোক তিনি কখনোই মন্দির মসজিদকে একই পাল্লায় মাপবেন না। তাই কাশ্মীরের পন্ডিতদের দেখাদেখি এইসব হাজী সাহেবরা যত ভালোই হোন না কেন, হিন্দুদের অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে কোনদিন কৃষ্ণবন্দনা করবেন না! এখানেই আসল সমস্যাটি চিহ্নিত। সম্প্রীতির দুটো তারে একই সুর বাজতে হয়। একটা বেসুরো বাজলে তা কখনো রাগিনি হয়ে উঠে না...।

-সুষুপ্ত পাঠক
17 July 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted