ভারতে একদল ব্রাহ্মণ আছে যারা ইসলামের নবী মুহাম্মদের নাতি ইমাম হুসেনের পুজা করে থাকে! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এরকম ব্রাহ্মণদের নামই ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’। এই হিন্দু সম্প্রদায় দাবী করেন হুসেনের বোন যখন তাদের আত্মত্যাগের কথা জানতে পারেন তখন আপ্লুত হয়ে তাদেরকে ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’ বলে অভিহত করেন। আসলেই কি এরকম কোন ঘটনা ঘটেছিলো? ইতিহাস কি বলে?
হুসেনি ব্রাহ্মণদের বংশধর Nonica Datta এ সম্পর্কে লিখেন, “A community which was historically considered to be “half Hindu” and “half Muslim”, the Hussaini Brahmins traditionally brought two cultures together. Often referred to as either Shia Brahmins or Hussaini Brahmins, phrases such as “Wah Dutt Sultan, Hindu ka dharm, Mussalman ka iman’; and ‘Dutt Sultan na Hindu na Mussalman” became a part of folklore.”
এটা সত্য যে ভারতে হুসেনি ব্রাহ্মণ বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং অমৃতস্বরে এখনো শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে যোগ দেয়। যারা হিন্দুদের অন্যসব পুজা আচ্চা করলেও মহরম মাসে হুসেনের স্মরণে পুজা করে তার জন্য শোক করে। বিস্মিয়ের আরো বড় দিক হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের যত শিয়া ঘরোনার মহরমের গান প্রচলিত তার ৯০ ভাই লিখেছেন হিন্দুরা। বিখ্যাত মহরম গানের রচিয়তা হচ্ছেন চুন্নুলাল। চুন্নুলাল ছিলেন ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’। হুসেনি ব্রাহ্মণদের কিন্তু ইসলামে দীক্ষার কোন নজির নেই। বিচিত্র এই পৃথিবীতে বিচিত্র সব ধর্মীয় বিশ্বাস। কিন্তু ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’ যদি থেকে থাকে তাহলে তাদের উত্পত্তির ইতিহাস তো থাকবে? কি সে ইতিহাস?
দুঃখজনক হচ্ছে ইতিহাসের এমন কোন শক্ত প্রমাণ নেই যে ইমাম হোসনের হয়ে ব্রাহ্মণরা যুদ্ধ করেছিলেন। দু রকম কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রথম কাহিনী অনুসারে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার যুদ্ধের সময় ভারতবর্ষের (বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত) রাহিব (রাহিম সিং) দত্ত নামের একজন পার্বত্য অঞ্চলের ছোট একটি জনগোষ্ঠির সেনানায়ক ছিলেন। ইমাম হোসেন ইয়াজিদের সঙ্গে যুদ্ধের আগে তার হয়ে লড়ার জন্য দুরদুরান্তের বন্ধু মিত্রদের অনুরোধ পাঠান। রাহিব দত্ত এই যুদ্ধকে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুরূপ ন্যায় নির্ধারণের যুদ্ধ জ্ঞান করে যুদ্ধে তার সাত পুত্রকে নিয়ে হুসেনের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধের রাহিবের সাত পুত্রের মন্ডু কেটে ইয়াজিদ বাহিনী সাজিয়ে রেখে দেন। রাহিব দত্ত বেঁচে ফিরেন। পরাজিত হুসেন পরিবারের সঙ্গে যখন দেখা হয় রাহিব দত্তের তখন হুসেনের বোন এই অমুসলিমের আত্মত্যাগে আপ্লুত হয়ে তাকে ‘হুসেনি ব্রাহ্মণ’ বলে ডাকেন। সে থেকে তারা হুসেনি ব্রাহ্মণ। কিন্তু কথিত হুসেনের এই বোনটি হুসেনের কি ধরণের বোন সেটি আমি কোথাও নিশ্চিত হতে পারিনি। হযরত আলী একাধিক বিয়ে করেছিলেন। ফাতেমার ঘরে দুই পুত্রের কথা ইসলাম জানালেও অন্য পক্ষেন সন্তানদের বিষয়ে প্রায় কোন উল্লেখ করা হয় না। কাজেই হুসেনের এটি কেমন তরো বোন জানা যায় না। দ্বিতীয় কাহিনীতে বলা হয় কারবালার যুদ্ধের সময় বাগদাদের দুর্গম পার্বত্য এলাকাতে তখনো কিছু পৌত্তলিক ব্রাহ্মণ বসবাস করত রাহিব দত্ত তাদের একজন। ইমাম হোসেন কারবালার অসম যুদ্ধে খড়কুটো আকড়ে ধরার মত করে যাকে পেয়েছেন দুত পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছেন। রাহিব দত্ত সেই ডাকে সাড়া দেন। এই কাহিনী বাস্তবতা কিছুটা মেনে নেওয়া যায়। রাহিব দত্ত বেলুচিন্তান থেকে সেই কারবালার ইমাম হোসেনের কথা জানবেন সেযুগে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং বাগদাদে পৌত্তলিকদের সামান্য কিছু তখনো অবশিষ্ঠ ছিলো সেটি মানা যায়। আমরা তো জানিই কাবাঘর পৌত্তলিকদের একটি মন্দির ছিলো। দ্বিতীয় প্রচলিত কাহিনী দাবী করে রাহিব দত্ত পরে ভারতের বর্তমান বেলুচিন্তান বা পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম অংশে পালিয়ে চলে আসেন আশ্রয় নিতে। বর্তমান হুসেনি ব্রাহ্মণ আসলে তার বংশধর।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত হুসেনি ব্রাহ্মণরা নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করতে পারলেও দেশভাগের কালে তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তাদেরকে অস্বীকার করে। হিন্দুরা তাদেরকে অহিন্দু মনে করে। মুসলমানরা তো তাদের হিন্দুই মনে করে। পাকিস্তানে তাদের ঠাঁই হয়নি। ভারতে চলে আসে হুসেনি ব্রাহ্মণরা এবং এখনো তারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহরমের সময় তারা হুসেনের জন্য শোকও পালন করে।
প্রকৃত ইতিহাস হয়ত আর কোনদিনই জানা যাবে না কারা এই হুসেনি ব্রাহ্মণ। কিন্তু পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ এবং পৃথিবী থেকে তাদের উচ্ছেদের সংকল্প নিয়ে যে ইসলামের জন্ম, তার একজন উত্তরাধিকারীকে জড়িয়ে হিন্দুদের একটি ছোট্ট উপশাখা প্রমাণ করেছে ধর্মীয় উদার্যতা কতখানি পৌত্তলিকদের মধ্যে। ভারতে হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত পয়গম্বরের যে চুলের কথা আমরা জানি তারও ঐতিহাসিক কোন রেফারেন্স না থাকলেও প্রচলিত কাহিনী হচ্ছে সেই চুল এই হুসেনি ব্রাহ্মণ রাহিব দত্ত হুসেনের পরিবার থেকে উপহার পেয়েছিলেন যা রাহিব দত্ত সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। অথচ এই চুল চুরির গুজব সৃষ্টি করে ভারতে মুসলমানরা দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দুদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানে এই চুল চুরির গুজবে হিন্দুদের কচু কাটা করে হত্যা করা হয়েছিলো। আরো একটি তথ্য হচ্ছে সুন্নী মুসলমানরা এই হুসেনি ব্রাহ্মণদের ঘৃণার চোখে দেখে। মূলত শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে হুসেনি ব্রাহ্মণদের সক্ষতা দৃশ্যত হয়। ভারত এমন একটি দেশ যেদেশে হুসেনি ব্রাহ্মণদের ঠাই হয়েছে এবং আজো তারা তাদের সম্প্রদায়গত বিশ্বাস অবাধে পালন করতে পারে। আর আমরা যদি বলি ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ পৌত্তলিকদের দেশ বলেই সেটি সম্ভব হয়েছে তাহলে কি বিশেষ কোন পক্ষপাতের অভিযোগ উঠবে?
তথ্যসূত্র: The Forgotten History of Hussaini Brahmins and Muharram in Amritsar, Nonica Datta/ Hussaini Brahmins: A crossover creed, Yusra Husain.
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................