কুরআনের ১৯ মিরাকল।।

‘কুরআনের ১৯ মিরাকল’ সংক্রান্ত একটা বই পড়ে রকমারী সোহাগ ওরফে উদ্ভাস সোহাগ নাস্তিক থেকে আস্তিক হওয়ার কারণ হিসেবে দাবী করেছেন কিছুদিন আগে। দুঃখজনক হচ্ছে কুরআনের ১৯ মিরাকল ইত্যাদি নামে বাংলাদেশে তিনটি বই বাজারজাত করছে রকমারী, কিন্তু কুরআনের ১৯ মিরাকলের ভাঁওতাবাজী নিয়ে কোন বই বাংলাদেশ থেকে কেউ বেরই করতে দিবে না। ফলে এই সমস্ত বই এর কাউন্টার কোন বই বাংলায় পাওয়া যায় না। কুরআনের এই কথিত ১৯ মিরাকল সম্পর্কে প্রথম যিনি লেখালেখি করে বিশ্বে প্রচার করেন তিনি একজন ‘রাসূল’! তার নাম রাশেদ খলিফা। পেশায় একজন রাসায়নবিদ ছিলেন আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের সরকারী দপ্তরে। তার অনুসারীরা এখনো আছে। তিনি হযরত মুহাম্মদের পর সর্বশেষ রাসূল হিসেবে নিজেকে দাবী করেছিলেন। মিশরীয় এই মার্কিন নাগরিক সমস্ত হাদিসকে ভুল মিথ্যা দাবী করে তা বর্জন করেন। 


তিনি কুরআনকে ওসমানের সময় বিকৃত করে ফেলা হয়েছে, অনেক সুরা নতুন করে ঢোকানো হয়েছে দাবী করে নতুন করে কুরআন লিখেন। তিনি নবী মুহাম্মদের সমস্ত সুন্নাহ পুরোপুরি বাতিল করে দেন। তিনি কুরআনের সুরা ফুরকান, সুরা ইয়াসিন, সুরা শুরা, সুরা তাকবির এ নিজের নাম ঢুকিয়ে দেন। যেমন এভাবে: ‘হে রাশেদ আপনি বলে দিন’ অথবা ‘আপনাকে (রাশেদ) আমি পাঠিয়েছি বার্তাবাহক হিসেবে...’।

রাশেদ খলিফা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নবী মুহাম্মদের পর যত নবী ও রাসূল এসেছেন বলে আমি জানতে পেরেছি তারা সকলেই কুরআনের ৩৩ নাম্বার সুরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতকে ব্যবহার করেছেন। বহু আলেম ওলামাও স্বীকার করেছেন এই আয়াতে মুহাম্মদকে শেষ নবী বলা হয়েছে, শেষ রাসূল নয়। কুরআনের আল ইমরানের ৮১ নম্বর আয়াতে আরো রাসূল পাঠানো কথা থাকায় সেটাকে রাশেদ খলিফা তার আগমনী বার্তা বলে দাবী করেন। এবং শেষে কুরআনের সুরা তওবা’র ১২৮-১২৯ আয়াতকে মিথ্যা দাবী করে বাতিল করে দেন। অর্থাত রাশেদ খলিফা রাসূল! নবী ও রাসূলের মধ্যে তফাত হচ্ছে রাসূলদের উপর কিতাব নাযিল হতে পারে, নবীদের উপর নয়। নবীরা কেবল পূর্বতন রাসূলদের কিতাব প্রচার করেন। সেই অর্থে রাশেদ খলিফা রাসূল যিনি নতুন করে আয়াত ডাউনলোড করতে পারবেন। সুরা আহযাবকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আরো অনেক রাসূল যে আসবে সেকথা আমরা বলতে পারি। কাজেই বিনোদন কিন্তু শেষ হচ্ছে না!

রাশেদ খলিফা একটা কাজ করলে, তিনি কম্পিউটারে ১৯৬৯ সালে কুরআনের জন্য একটা প্রোগ্রাম তৈরি করেন এবং ১৯৭৪ সালে দাবী করেন কুরআনের অলৌকিকতার একটি নির্দশন হচ্ছে এর ১৯ সংখ্যার মিরাকল। তার দাবী ছিলো, কুরআনের ৭৪ নম্বর সুরা মুদাচ্ছির এর ৩০ নং আয়াতে উল্লেখিত ১৯ সংখ্যা একটি মিরাকল, কুরআনের সুরা সংখ্যা ১১৪ যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য, কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬ যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য হয়, কুরআনের উল্লেখিত বিসমিল্লাহ রাহমানির রাহিম এর শব্দ সংখ্যাও ১৯, কুরআনের প্রথম নাযিল হওয়া সুরা আলাক ১৯টি শব্দ দিয়ে তৈরি, আবার পিছন থেকে গণনা করলে আলাক ১৯ নম্বর সুরা, সর্বশেষ সুরা নাসর এর প্রথম আয়াতটি ১৯টি শব্দ দিয়ে তৈরি। এরপর নানান পত্রিকায় এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করলে গোটা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে কুরআনের এই অলৌকিক প্রমাণ ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও সে ঝড় আছড়ে পড়েছে বলাই বাহুল্য। লেখা হয় বই। মেজর কাজী জাহান মিয়া লিখেন ‘আল কুরআন দ্য চেলেঞ্জ। ডা. খন্দকার আবদুল মান্নান লিখেন কম্পিউটার ও আল কুরআন। নাফেজ মুনিরউদ্দিন আহেমদ লিখিত বাংলা কুরআনের ভূমিকাতে এই কুরআনের ১৯ মিরাকল উপস্থাপন করেছেন কুরআনের অলৌকিকতা প্রমাণ করতে। এদিকে রকমারী সোহাগও ১৯ মিরাকল পড়ে দ্বিনের পখে আসার যে দাবী করেছেন সেটি স্বঘোষিত রাসূল রাশেদ খলিফার তৈরিকৃত! যে রাশেদ খলিফা নতুন করে কুরআন লিখেছেন, নিজেকে আখেরি রাসূল দাবী করেছেন তার তৈরি এই মিরাকল দেখিয়ে কুরআরকে অলৌকিক প্রমাণের অর্থ হচ্ছে রাশেদ খলিফাকে রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়া। কিন্তু মুসলমানরা রাশেদ খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারেনি। ১৯৯০ সালে আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের টুকসন মসজিদদের ভেতর তার ২৯ বার চাকু মারার লাশ পাওয়া যায়। তার মুখটি এমনভাবে কুপানো হয় যে চেহারাই চেনা যাচ্ছিল না। এই ঘটনায় ইসলামিক গ্রুপ ‘জামাতুল ফুরকা’-কে দায়ী করা হয়।

রাশেদ খলিফার কুরআনের এই ১০ মিরাকল আসলে একটি চতুরতা ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। একদম শুরুর সুরা মুদাচ্ছিদ এর ৩০ নম্বর আয়াতে ১৯ সংখ্যাটির আগে পরে কোন আয়াত উল্লেখ না করে সেখানে ১৯ সংখ্যাটিকে রাশেদ খলিফা দেখিয়েছেন। এই আয়াতে আসলে দোযগে ১৯ জন ফেরেস্তার কথা বলা হয়েছে- যার আসলে আলাদা কোন অর্থ বহন করে না। দোযগে ১৯ জন ফেরেস্তা পাহারায় থাকবে এটাই এই আয়াতে বলা হয়েছে। এটা শুনে মক্কার কুরাইশরা হাসি তামাশা শুরু করেছিলো কারণ আদম থেকে এখন পর্যন্ত যত নবী এসেছে তাদের সময়ের সমস্ত পাপীদের দোযগে পাঠানো হবে। আর তাদের জন্য মাত্র ১৯ জন পাহারাদার! এটা শুনে পড়ে সম্পূরক আয়াত নাযিল হয় যেখানে বলা হয় ১৯ সংখ্যাটি আসলে কাফেরদের বিভ্রান্ত করার জন্য বলা হয়েছে। যাই হোক, কুরানের ১৯ মিরাকলের কথা এই সুরায় উল্লেখ আছে বলে যা দাবী করা হয় তা অসত্য। এতে প্রথমেই প্রমাণিত হয় কুরআন নিজেই জানে না এরকম কিছু তার ভেতরে আছে। যদি এরকম গাণিতিক হিসাব এখানে থাকত তাহলে কুরআনের কোথাও তার উল্লেখ থাকত। সেটি নেই।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে কুরআনের ১১৪টি সুরা নিয়ে ইসলামী স্কলারদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। সুরা তওবা ও সুরা আনফাল একটি সুরাই দাবী করা হয় যে কারণে সুরা তওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করা হয়নি! এ ছাড়া ওসমানের সংকলনের আগে এই সুরাগুলির কোন নাম ছিলে না। এর তালিকা বা ক্রমবিন্যাস মানুষ্যকৃত, বড় সুরা থেকে ছোট সুরায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কুরাআনের প্রথম সুরা চলে গেছে একদম শেষে। তওবা ও আনফাল একই সুরা হওয়ায় কুরআনের সুরার সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১১৩! তখন কিন্তু ভাগ ফল মিলবে না! নবী মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ সুরা নাস ও ফালাককে কুরআনের অংশ নয় বলে দাবী করে গেছেন। তার মানে ১১৪টি সুরার মধ্যে ভেজাল আছে! আবার বহু আলেম ওলামা সুরা ফিল ও সুরা কুরাইশ দুটি সুরাকে আসলে একটি সুরা বলে দাবী করেছেন (দেখুন: তফসীর মাআরেফুল কুরআন, ১৪৭৬ পৃষ্ঠা)। তার মানে এটা ধরলেও ১১৪টি সুরা গণনা ভুল!

এবার্ আসা যাক কুরআনের আয়াত সংখ্যা নিয়ে। রাশেদ খলিফার থিউরী কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬ ধরে নিয়ে। কিন্তু কুরআনের এই আয়াত সংখ্যা কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়। এটা চরম বিতর্কিত একটি বিষয়। কারণ রাশেদ থলিফা তার কুরআন থেকে নিজের ইচ্ছে মত আয়াত কেটে বাদ দিয়েছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশে যে কুরআন আরবীতে পাওয়া যায় সেটি তো রাশেদ খলিফার নয়। তাই এইসব কুরআনের আয়াত ৬৩৪৬টি আয়াত নয়! রাশেদ খলিফা এটি বানিয়ে নিয়েছেন নিজের মত করে যেমন ৬৩৪৬ (৬+৩+৪+৬)=১৯! কিন্তু প্রচলিত কুরআনের আয়াত তো এই সংখ্যায় নয়। সেখানে রয়েছে ৬২৩৭। সেটাকে বিভাজ্য করি আসুন। ৬২৩৭ (৬+২+৩+৭) =১৮! আপনার বাড়ির, রকমারী সোহাগের বাড়ির কুরআেনর আয়াত মিলেও সংখ্যাটা ১৮! অথচ আপনি জীবনে কত শতবার এই কুরআনের ১৯ মিরাকলের গল্প বলে কুরআনকে বিজ্ঞানময় দাবী করেছেন ভাবুন! কুরআনের আয়াত নিয়ে বিতর্ক বহু পুরোনো। বলতে পারেন ১৪০০ বছর ধরে। হযরত আয়েশার মতে কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬৬৬৬, ওসমান মতে ৬২৫০, হযরত আলী মতে ৬২৩৬...।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখতে ১৯টি শব্দের ব্যবহার কিন্তু ওসমান আমলে শুরু হয়েছিলো হাজ্জাব বিন ইউসুফের হাত ধরে যিনি মক্কায় অবরোধ করে কাবাঘর ভেঙ্গেছিলেন নিজ হাতে। কুরাইশদের হত্যা করে, দাস বানিয়ে চরম হিংস্রতা দেখিয়েছিলেন। অর্থ্যাত নবী মুহাম্মদের সময় জের জবর পেশ দিয়ে কুরআন লিখিত হয়নি তার মানে বিসমিল্লায় তখন ১৯টি শব্দ ছিলো না! এইসব যে রাশেদ খলিফার নিজেকে রাসূল বানানোর জন্য তৈরি করা সেটি বুঝত হলে একটু জ্ঞানের প্রয়োজন বৈকী। তবে মুমিনরা খুব সেয়ানা। রাশেদ খালিফা নিজে কুরআন লিখে নিজেকে রাসূল দাবী করায় তাকে খুন করলেও তার ১৯ ফর্মূলাকে আজো ব্যবহার করে ফয়দা লুটে! কুরআনের এই ১৯ ফর্মূলা মানুষের সমাজে আমরা অহরহ দেখতে পাই যা আসলে খুবই দক্ষতা ও চিন্তার ফল। যেমন কুমিল্লার নাজমুল কবীর নামের একজন লেখক ‘ক’ বর্ণ দিয়ে প্রতিটি শব্দ লিখে বাক্য তৈরি করে উপন্যাস লিখেছেন তিনটি! এটিও তাহলে মিরাকল? নাজমুল কবীরের বই থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে ধরছি, ‘কইত করব কবরী কাবিন করব। কার্তিকের কুড়িতেই কাবিন করব। কাবিন করেই কাকিমার কুটিরে কাল কাটাব। কল্পিত কামনাগুলিকে কামিয়াবী করব। কি কও কবরী?’

সৈকত চৌধুরী ও অনন্ত বিজয় দাসের ‘কুরআনের ১৯ মিরাকল’ লেখাটি থেকে এই লেখাটি লিখতে প্রচুর সহায়তা নিয়েছি। তাদের সেই লেখাতে জানতে পারি মার্কিন লেখক আর্নেস্ট ভিনসেন্ট একটি উপন্যাস লিখেন যার বৈশিষ্ঠ হলো, এই উপন্যাসটি ৫০,১১০টি শব্দ দিয়ে লেখা হয়েছে যেখানে একবারের জন্যও লেখক ইংরেজি “E” বর্ণটি ব্যবহার করেননি। এছাড়া কবিতায় সনেট একটি গাণিতিক সূত্রের মত করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা কি মিরাকল বলব? ‘ফিবোন্নাকি রাশিমালা’ ইতালির একজন গণিতবিদ যখন এটি তৈরি করলেন যে রাশিমালায় প্রকৃতির অজানা কথা লুক্কায়িত আছে বলে স্বয়ং তিনি দাবী করলেন সেটাও কি মিরাকল? কিন্তু সেটা তো একজন সাধারণ খ্রিস্টান গণিতবিদের তৈরি!

মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার বলতে একটা জিনিস বলা হয় যে ক্যালেন্ডারে পৃথিবীতে ২০০০ সাল পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে সবই মিলে গেছে। কেউ কিন্তু মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার খুঁজতে যায়নি। কিংবা বারমুডা টায়েঙ্গাল বলতে যে গুজব প্রচলিত কেউ এটা সত্য কিনা জানতেও চায়নি। অতিপ্রাকৃত রহস্যময় যে কোন কিছুকে মানুষ বিনাবাক্যে মেনে নিবে। কিন্তু হাজারবার পরীক্ষা নিরিক্ষার পর বিজ্ঞান যা সত্য বলে প্রকাশ করে সেটা নিয়েই মানুষের সন্দেহের শেষ নেই!

Written by : সুষুপ্ত পাঠক

#copyrightfree

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted