‘হেরেম থেকে বলছি’ পারস্যের নাদির শাহের আফ্রিকান খোজা ক্রীতদাস আগাবাসীর আত্মকাহিনী।

‘হেরেম থেকে বলছি’ পারস্যের নাদির শাহের আফ্রিকান খোজা ক্রীতদাস আগাবাসীর আত্মকাহিনী।

আফ্রিকার উপকূল থেকে আরব বণিকরা কালো কালো বাচ্চাদের ধরে এনে বাগদাদের বাজারে বিক্রি করে দিতো। বাগদাদের বাজারে উঠানো এই দাসদের কিনে নিতো ব্যবসায়ীরা হুবহু কুরবানীর পশুর মত। কুরবানীর পশুকে যেমন খাইয়ে দাইয়ে বড় করে মোটা দামে বিক্রি করা একটা ব্যবসা, ঠিক আফ্রিকান বাচ্চাদের খোঁজা বানিয়ে (যৌনাঙ্গ কেটে বাদ দিতো) ঘরে এনে খাইয়ে দাইয়ে একজন ক্রীতদাসের যেসব গুণ হিসেবে ক্রেতা মনে করে সেগুলির ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত করা হতো বড় বাজারে বিক্রি করার জন্য। পরিপূর্ণ প্রস্তুত ক্রীতদাসদের সবচেয়ে বড় বাজার ছিলো ইরানের ইস্পাহান বাজার। এখান থেকেই হিন্দুস্থানে চড়া দামে ক্রীতদাস বিক্রি হতো। হিন্দুস্থানের বাদশাহদের জন্য এসব ক্রীতদাস কেনা হতো। 

হিন্দুস্থান বড় বিচিত্র দেশ! দাসদের সবার মনের গভীরে ছিলো হিন্দুস্থানে যাবার আগ্রহ। দাসদের মধ্যে দুরকম আছে, একটা খোজা যাদের কাজই হেরেম পাহারা দেয়া। হেরেমে বাদশাহ সুলতানদের অগুণতি স্ত্রী রক্ষিতা দাসী থাকে। এখানে অন্য কোন পুরুষের আগমন হারাম। তাই এই জায়গার নাম হয়েছে ‘হেরেম’। এখানে পাহারায় থাকে খোঁজা বলবান পুরুষ দাসরা। এদের দ্বারা শাহেনশার কোন জেনানার উপর কুদৃষ্টি বা আত্মসাতের সম্ভাবনা নেই। কারণ খোঁজাদের যৌবন থাকলেও কোন উত্তেজনা নেই। ক্রীতদাসদের মধ্যে যারা খোজা নয় তাদেরকেও কেনা হতো। ক্রীতদাস কেনাটা ছিলো সম্রাটদের সখ। হিন্দুস্থানে অনেক দাস বাহশাহ পর্যন্ত হয়েছিলো। মুহাম্মদ ঘুরির ছিলো ক্রীতদাস কেনার সখ। হাজার হাজার ক্রীতদাস কিনতেন তিনি। নিজের কোন ছেলে ছিলো না। কেউ যখন সেকথা বলত তিনি দাসদের দেখিয়ে হেসে বলতেন, এরাই তো আমার ছেলে...। এই ঘুরির মৃত্যুর পর নিজেকে শাহেনশাহ ঘোষণা করেন একজন দাস- কুতুবউদ্দিন আইবেক। সিন্ধুতে আরেক দাস নাসিরুদ্দিন কাবাচা, গজনীতে তাজউদ্দিন ইলদুজ সুলতান হয়েছিলেন। দাসদের যুদ্ধুবিদ্যা শিখিয়ে পরিয়ে শিক্ষিত করা হতো বেশি দামে বেচার জন্য, এমনকি তাদের পড়তে লিখতে শেখানো হতো। তাদের অনেকেই হিন্দুস্থানে এসে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলেছিলো। স্বয়ং বাদশাহ হয়ে সিংহাসনে বসেছিলো। তাদেরও ছিলো দাস কেনার বিরাট নেশা। দুই হাতে ক্রীতদাস কিনতো। ক্রীতদাসদের প্রতি সদয় হওয়া মালিকের ইচ্ছা মাফিক। এটা ক্রীতদাসের ভাগ্য সে কেমন মালিকের ঘরে যাচ্ছে।

যেসব সৌভাগ্যবান দাসদের কথা বললাম যারা হিন্দুস্থানে গিয়ে কপাল খুলে গিয়েছিলো্ তারা ছিলো তুর্কি। তুর্কি দাসদের পুরুষত্ব কেড়ে নেওয়া হতো না। আফ্রিকান ও আর্মেনিনাদেরই খোজা বানিয়ে দাস করা হতো। এদেরই দায়িত্ব পড়ত হেরেম পাহারার। খোজা দাসে মালিকের লাভ বেশি। একটু খাওয়া পরা ছাড়া আর কোন চাহিদা নেই। ধন সম্পদ দিয়ে সে কি করবে? তবু এদের মধ্যে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে বাদশাহ হয়েছিলো কেউ কেউ নিজের মালিক সম্রাটকে হত্যা করে। হিন্দুস্থানের বাংলা মুল্লুকে এরকম এক আফ্রিকান কালো খোজা দাস বিদ্রোহ করে মসনদে বসেছিলো। দিল্লির আলাউদ্দিন খিলজীর খোজা দাস মালিক কাফুর প্রতিশোধ নিয়েছিলো আলাউদ্দিন লিখজীকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলো। নিজের অপমানের শোধ নিতে খোজা হওয়ার পরও আলাউদ্দিনের এক স্ত্রীকে বিয়েও করেছিলো। দিল্লির আরেক খোজা বিদ্রোহী জাবিদ খাঁর কথা জানা যায় যে গদিতে বসতে পেরেছিলো।

সিংহাসনের পেছনের দরজাই ছিলো হেরেমে যাবার দরজা। এখানে বাদশাহ ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারত না। প্রহরী হিসেবে কাজ করত খোজা ক্রীতদাসরা। এ এক বিচিত্র জগত। যেন এক খন্ড জান্নাত বানিয়ে রেখেছে যৌনদাসীদের জন্য। গালিচা, বাগান, ঝর্ণা, পাথরের কারুকাজ, ভাস্কর্য, নগ্ন মূর্তি, মসলিনের পর্দা ঘিরে বিলাশ আর ব্যসনের ছড়াছড়ি। কিন্তু সব থেকেও এখানে কিছু নেই! এ যেন এক পাষাণপুরী। হাহাকার, কান্না, আর্তনাদ এখানকার চার দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরে মরে। সন্ধ্যের পর বেগম রক্ষিতা দাসীরা সিরাজী (ইরানের সিরাজ প্রদেশের প্রসিদ্ধ মদ) খেয়ে বেহুঁশ হয়ে থাকত নিজেদের অভিশপ্ত জীবন ভুলে থাকতে। এখানে ঐশ্বর্য্যের কোন অভাব নেই। কিন্তু হেরেম ভরা নারীদের জন্য একজন মাত্র পুরুষ স্বয়ং বাদশা। তিনি হেরেমে আসলেন তো আসলেন না। গেলেন তো ঘুমিয়ে পড়লেন। কিংবা একজন কাউকে নিয়ে সময় কাটালেন। বছরের পর বছর এই হেরেমগুলিতে তাই বেগম বাঁদীরা সন্ধ্যের পর রাত যত গভীর হতে থাকে মদে মত্ত হয়ে যা করত সুস্থ অবস্থায় তা করতে লজ্জা বোধ হতো। একটা পুরুষ সঙ্গীর জন্য বেগমরা কাঁদতেন। দাসীদের আঁচড়ে কামড়ে দিতেন। ওদের জড়িয়ে ধরতেন। বাঁদীরা খোঁজা জেনেও পুরুষ ক্রীতদাসের জোর করে ধরে চুমু খেতো। জাপটে ধরে নিজেদের যন্ত্রণা ঘোচাতে চাইত। কিন্তু খোঁজাদের তো সেসব অনুভূতিকে ছুরি দিয়ে কবেই কেটে বাদ দিয়ে ফেলা হয়েছে। খোজারা চাবুক মেরে বাঁদীদের সরাতো। এভাবেই কাটতো একটি রাত। পরদিন সকালে সূর্য উঠত। সন্ধ্যের পর আবার সিরাজী আসত ভারে ভারে। সেসব গিলে এই মানবজনমকে ভুলে যেতে চাইত। হেরেমগুলিকে পতিতালয় বললে ভুল বলা হবে না। কেননা এইসব হেরেমকে পরপুরুষ থেকে নিষিদ্ধ করে রাখলেও যখন অন্য বাদশাহ ক্ষমতা দখল করত তখন এই হেরেমও দখল হয়ে যেতো। স্বয়ং বাদশাহ এসে পূর্বের বাদশার স্ত্রী রক্ষিতাদের মধ্যে কাদের যৌবন সৌন্দর্য অটুট আছে তাদেরকে রেখে বাকীদের বাঁদি মহলে পাঠিয়ে দিতেন। অর্থাত তরোয়াল যার জেনেনা তার! ইসলামী তথা মুসলিম শাসনে হেরেমের এই চিত্র সর্বত্র। হেরেমগুলি ভর্তি করা হতো আসলে ‘গণিমতের মাল’ হিসেবে পাওয়া নারীদের দিয়ে। শাহ সুলতান বাদশাহরা একেকটা জনপদ জয় করে ফিরে আসতেন সোনাদানা আর মেয়েমানুষ নিয়ে। এই নারীদের বেশির ভাগ হতো দাসী। অপরূপ সুন্দরীদের বাদশাহ নিজের হেরেমে বেগমমহলে স্থান দিতেন। তারা মর্যাদা পেতেন হেরেমে আলাদা করে।

হিন্দুস্থানের নারীদের রূপ নিয়ে তুর্কি আফগান ইরানের শাসক মহলে আলোচনা হতো। হিন্দুস্থানের রমনী ভোগ করার স্বাদই নাকি আলাদা। হিন্দুস্থানে আক্রমন করলে একজন সাধারণ সৈনিক যে পরিমাণ লুটের মালের ভাগ পান তাতে সে যুদ্ধ জিতে দেশে ফিরে বড়লোক হয়ে যায়। সুলতান মাহমুদের দলের সঙ্গে যে সৈন্য অভিযানে গিয়েছিলো সে লুটের ভাগ পেয়েছিলো। সে লিখে গেছে হিন্দুদের ধন ভান্ডের কাহিনী। সে কাহিনী শুনে তৈমুর লং ভারত আক্রমন করেছিলো। ভারতের হাজার হাজার নারী এইসময়ে দাসী হিসেবে ইরানের বাজারে চালান হয়েছিলো। মুঘলদের বাবুর সেই একই কাহিনী শুনে ভারতবর্ষ আক্রমন করে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। বাবুর ভারত থেকে তার নিজের দেশের আত্মীয় স্বজনদের সেকালেই কোটি কোটি টাকার উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। এরকম লুণ্ঠন বা পাচার গোটা মুসলিম শাসনে ঘটলেও কেবলমাত্র ইংরেজ উপনিবেশকালে ইংলেন্ডে অর্থ পাচারের ইতিহাসই আমরা পড়ি! প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা উচিত ইরানের নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি আক্রমন করে মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহকে পরাজিত করে লাল কেল্লা দখল করে নেন। নাদির শাহ মুহাম্মদ শাহকে আটক বা হত্যা না করে শর্ত দেন, পরাজিত মুঘল সম্রাটকে ইরানের শাহকে নগদ বিশ কোটি মুদ্রা দিতে হবে। হেরেম লুন্ঠন করতে অনুমতি দিতে হবে। ইরানের শাহ’র সৈন্যদের শহর মুক্তভাবে শহর লুন্ঠন করার সুযোগ দিতে হবে। শর্তে রাজি হোন সম্রাট। ইরানের শাহ লুন্ঠন চালিয়ে ধন-দৌলত বোঝাই করে ইরানের পাঠিয়ে দেন। যে কোহিনূর ব্রিটিশরা চুরি করে নিয়ে গেছে বলে এখনো মরাকান্না চলে সেই কোহিনূর লুট করতে ইরানের নাদির শাহ তন্ন তন্ন করে পুরো কেল্লা ভেঙ্গেচুড়ে ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু কোহিনূর পাননি। নাদিরকে মিথ্যা বলা হয়েছিলো যে কোহিনূর টুকরো টুকরো করে হেরেমের দেয়ালে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই কোহিনূল ভারতেই পাওয়া গিয়েছিলো। রাজা বিক্রম জিত ছিলেন এর মালিক। তিনি মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে এটি উপহার দিয়েছিলেন। সেই কোহিনূরের খুশবু ইরান পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। লুট করে আসা নাদিরের প্রথম নজর ছিলো কোহিনূর।... 

এ সময় দিল্লিতে গুজব রটে নাদির শাহকে গুপ্তঘাতকরা হত্যা করেছে। এটা শুনে মুঘল আমিরদের কেউ কেউ সৈন্য সংগ্রহ করে ফের লাল কেল্লা দখলের চেষ্টা শুরু করলে নাদির শাহ হুকুম দেন তিনি দিল্লিতে যারা তার মৃত্যু গুজব বিশ্বাস করেছে তাদের মৃত দেখতে চান। বলা হয় তৈমুর লং এমনভাবে ভারতীয়দের হত্যা করেছিলো যে মানুষের মৃতদেহ পঁচা দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে তৈমুর ভারত ত্যাগ করেছিলেন। তৈমুরের তরোয়ালে মানুষ মরে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। নাদির শাহ ফের সেই হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করলেন। বিদেশী আক্রমনে এক মুসলিম শাসনে আরেক মুসলিম শাসনের আগ্রাসনে মূল চুকালো সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠি। সাধারণ ভারতীয়রা মরতে লাগল পাখির মত...। একদিনে ৩০ হাজার মানুষ হত্যা করেছিলো নাদির শাহ। এরকম হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কাহিনী আমাদের দেশের ইতিহাস পাঠ্যে স্থানে দিলে সেটাকে বলা হবে ‘মুসলিম বিদ্বেষী’!

পুরো এশিয়া অঞ্চলে মুসলিম সাম্রাজ্য ভারতবর্ষ থেকে ইরান আফগান ধরে যে বিশাল অঞ্চল সেখানে জমজমাট দাস ব্যবসার কথা আমাদের ইতিহাসবিদরা প্রায় ভুলেই গেছেন অথবা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। কেননা দাস ব্যবসার ইতিহাস মানেই হচ্ছে সাদা ইউরোপীয়ানদের ইতিহাস। যেন তারা একাই আফ্রিকার কালো মানুষদের ধরে ধরে দাস বানাতো। যেন তারাই কেবল দাসদের অত্যাচার করত। ভারত আক্রমন করে ভারতীয়দের দাস বানিয়ে চালান করে দেয়ার ইতিহাস শুরু করলে সেটা হয়ে যাবে ‘হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাস’! ইউরোপীয়ানদের দাস ব্যবসার অনেক আগে থেকে ইসলামী খিলাফতে পরাজিতদের দাস করে বাজারে বিক্রি করা হতো। পরাজিতদের নারীদের দাসী করে বাগদাদের বাজারে, ইরানের বাজারে বিক্রি করা হতো। আফ্রিকা থেকে ধরে ধরে দাসদের নিয়ে আসা হতো ভারতে মুসলিম সম্রাটদের হেরেম পাহারা দেয়ার জন্য। শুধু সাদা ইউরোপীয়ানরা দাস ব্যবসা করত এরকম এক তরফা ইতিহাস আমাদের পড়তে হয় কারণ এখানে একদা মুসলিম শাসন চলেছিলো এবং এখানো তাদের গর্বিত উত্তরাধিকারীরা নানা পরিচয়ে সেইসব শাসনের রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে...। 

পড়তে পারেন: হেরেম থেকে বলছি, নিগূঢ়ানন্দ, Nadir Shah: The Stanhope Essay For 1885 , by Herbert John Maynard (পিডিএফ পাওয়া যায়)।

Written by : সুষুপ্ত পাঠক

#copyrightfree

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted