বেদে দুর্গাপূজা পদ্ধতি

বেদে দুর্গাপূজা পদ্ধতি 

আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গাই কালী,লক্ষ্মী, সরস্বতী   ইত্যাদি বিবিধ নামে প্রকাশিতা। বৈদিককাল থেকেই তাঁর পূজা প্রচলিত। আশ্বলায়ন শাখার ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের রাত্রিসূক্তে রাত্রিরূপা আদ্যাশক্তি ভগবতী দুর্গাকে ক্ষীরসহ পঞ্চগব্যাদি দিয়ে দেবীর শ্রীবিগ্রহকে অভিষিক্ত করে চন্দনাদি দ্বারা অনুলিপ্ত করে "নমো দুর্গে নমো নমঃ" মন্ত্রে দেবীর গলায় বিল্বপত্রের মালা প্রদান করে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের নির্দেশনাও রয়েছে। 

ক্ষীরেণ স্নাপিতা দুর্গা চন্দনেনানুলেপিতা।
বৈল্বপত্রকৃতামালা নমো দুর্গে নমো নমঃ।।
( ঋগ্বেদ সংহিতা:আশ্বলায়ন শাখা, ১০.১২৮.৮)

" দুধের ক্ষীর দ্বারা স্নাতা, চন্দনাদি দ্বারা অনুলিপ্তা এবং বিল্বপত্রের মাল্যধারিণী সেই দুর্গাকে বারংবার নমস্কার  করি।"

পুষ্পপত্র, চন্দনাদি অনুলেপন এবং দেবীর শ্রীবিগ্রহের অভিষেকসহ বিবিধ উপাচারে দেবীর পূজা পদ্ধতিও বৈদিক । অর্থাৎ অনেকে যারা বলেন, বৈদিকযুগে প্রতিমাপূজা ছিলো না, প্রতিমা পূজা পদ্ধতি অবৈদিক, তাদের কথাগুলো সত্য নয়। তারা অনেকটা বেদ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে না জেনেই ব্যক্তিগত বা জনপ্রিয় প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে বলেন।"ক্ষীরেণ স্নাপিতা দুর্গা" অর্থাৎ দুগ্ধাদি পঞ্চগব্যের দ্বারা দেবীকে স্নান বা অভিষেকের বিধান আমরা ঋগ্বেদ, সামবেদ এবং যজুর্বেদীয় এ ত্রিবেদীয় পদ্ধতিতেও দেখতে পাই। পারিবারিক ঐতিহ্য বা পরম্পরা অনুসারে এর যে কোন একটি বিধান অনুসরণ করা যায়।

ঋগ্বেদীয় বিধান:
দুগ্ধ : 
ওঁ আপো অদ্যন্বচারিষং রসেন সমগস্মহি। পয়স্বানগ্ন আ গহি, তং মা সংসৃজ বর্চসা।।
"হে জল, এখন আমি তোমার অনুগমন করি। তুমি রসপূর্ণ হয়ে এসো। হে অগ্নি, তুমি দুগ্ধযুক্ত হয়ে এসো। তুমি আমাকে তোমার তেজের দ্বারা সম্পৃক্ত করো।"

 দধি: ওঁ উদ্বুধ্যধ্বং সমনসঃ সখায়ঃ সমগ্নি মিন্ধং বহবঃ সনীড়াঃ। দধিক্রামগ্নিমুষসঞ্চ দেবী মিন্দ্রাবতোহ বসে নি হ্বয়ে বঃ।।
"তোমরা সকলে একমন, একপ্রাণ এবং একসঙ্গে বাস করে সম্যক অবগত হও, অগ্নিকে প্রদীপ্ত করো। আমি দধিক্ৰামা নামক দেবকে, অগ্নিকে এবং উষাদেবীকে ইন্দ্রের সঙ্গে আমাদের রক্ষার জন্য আহ্বান করি।"

ঘৃত : ওঁ অগ্নিরস্মি জন্মনা জাতবেদা, ঘৃতং মে চক্ষুরমৃতং ম আসন্। অর্কস্ত্রিধাতু রজসো বিমানোঽজস্রো ঘর্মো হবিরন্মি নাম।।
"আমি জন্ম থেকেই অগ্নিত্ব প্রাপ্ত হয়েছি, অতএব আমি সর্বজ্ঞ ঘৃত আমার চক্ষু, আমার মুখে আছে অমৃত, আমি অৰ্চনীয়। তিন বেদ আমার ধাতু। আমি জলের সৃষ্টিকর্তা, ক্ষয়হীন, দীপ্তিশালী এবং আহুতির দ্রব্য।"

সামবেদীয় বিধান: 
 দুগ্ধ : ওঁ গব্যো ষু ণো যথা পুরাশ্বয়োত রথয়া।
 বরিবস্যা মহোনাম্।।
"হে ইন্দ্ৰ, তুমি পূর্বে যেমন আমাদের গাভিদান করতে, অশ্ব লাভের ইচ্ছায় অশ্ব দিতে, রথ লাভের ইচ্ছায় রথ দিতে এবং ধন লাভের ইচ্ছায় ধন দিতে—এখনও তদ্রূপ করো।"

দধি :ওঁ দধিক্ৰাণো অকারিষং জিষ্ণোরশ্বস্য বাজিনঃ সুরভি নো মুখা করৎ। প্র ণ আয়ুংষি তারিষৎ।।

"আমরা জয়িষ্ণু, সর্বব্যাপী বেগবান্, দধিক্রাবা দেবতার স্তব করি। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয় সকলকে সৎপথে প্রবৃত্ত করুন এবং আমাদের আয়ুবৃদ্ধি করুন।"

ঘৃত : ওঁ ঘৃতবর্তী ভুবনানামভিশ্রিয়ো বী পৃথ্বী মধুদুঘে সুপেশসা। দ্যাবাপৃথিবী বরুণস্য ধর্মণা, বিষ্কভিতে অজরে ভূরিরেতসা।।
"স্বর্গ ও পৃথিবী ঘৃতযুক্ত হোক, তারা সর্বভূতের আশ্রয়স্থল, বিস্তীর্ণ, বিখ্যাত, মধুক্ষরণকারী, সুরূপ, বরুণের ধারণে ধারিত, নিত্য এবং বহু কার্য সম্পাদক।"

যজুর্বেদীয় বিধান:
দুগ্ধ: ওঁ আ প্যায়স্ব সমেতু তে বিশ্বতঃ সোম বৃষ্ণ্যম্।
 ভবা বাজস্য সঙ্গথে।। 
"হে সোম, তুমি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও, তোমার তেজ তোমার সর্বাংশে সম্মিলিত হোক, তুমি আমাদের অন্নপ্রদ হও।"

দধি :ওঁ দধিক্ৰাণো অকারিষং জিষ্ণোরশ্বস্য বাজিনঃ সুরভি নো মুখা করৎ। প্র ণ আয়ুংষি তারিষৎ।।

"আমরা জয়িষ্ণু, সর্বব্যাপী বেগবান্, দধিক্রাবা দেবতার স্তব করি। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয় সকলকে সৎপথে প্রবৃত্ত করুন এবং আমাদের আয়ুবৃদ্ধি করুন।"

 ঘৃত: ওঁ তেজোঽসি শুক্রমসি অমৃতমসি ধাম নামাসি। প্রিয়ং দেবানামনাধৃষ্টং দেবযজনমসি।।

"হে ভগবৎ সংযুক্ত কর্ম, তুমিই তেজ, তুমিই শুক্র, তুমিই অমৃত। তুমি দেবতাদের সংরক্ষক, সর্বত্র অনভিভূত এবং যাগাদি সৎকর্মের সাধক তুমি।"

"চন্দনেনানুলেপিতা" অর্থাৎ বৈদিককাল থেকে এখনো দুর্গাপূজায় দেবীকে চন্দনাদি বিবিধ গন্ধদ্রব্যের অনুলেপন দ্বারা অনুলিপ্ত করা হয়। দেবী অচিন্ত্য, বাক্য এবং মনের অতীত। তাঁর প্রাকৃত মূর্তি নেই। ভক্তের শুদ্ধ মানসলোকই তাঁর বিবিধ রূপের প্রকাশ। তাই গন্ধাদি অনুলেপন প্রদান করে সাধক বলছেন যে,  হে দেবী!  আপনার শরীর কেমন তাও জানি না, তোমার কর্মচেষ্টাও জানি না। এরপরেও আপনি ল আমার নিবেদিত গন্ধদ্রব্যাদি গ্রহণ করে অঙ্গে লেপন করুন।

ওঁ শরীরং তে ন জানামি চেষ্টাং নৈব চ নৈব চ।
ময়া নিবেদিতান্ গন্ধান্ প্রতিগৃহ্য বিলিপ্যতাম্ ।।

" হে দেবী, তোমার শরীরও জানি না, চেষ্টাও জানি না। আমার নিবেদিত গন্ধ গ্রহণ করে অঙ্গে লেপন করো।"

বিল্বপত্র অমৃত থেকে উৎপন্ন এবং অত্যন্ত শ্রীযুক্ত শোভাময়। বিল্বপত্র ভগবান মহাদেবের সদাপ্রিয়। তাই সে পত্রে আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গাও অত্যন্ত প্রসন্ন হন। তাই সেই মহাপবিত্র বিল্বপত্রমাল্য দুর্গার আরাধনার ভক্তরা বৈদিকযুগ থেকেই নিবেদন করে আসছে।

 ওঁ অমৃতোদ্ভবং শ্রীযুক্তং মহাদেবপ্রিয়ং সদা।
পবিত্রং তে প্রযচ্ছামি শ্রীফলীয়ং সুরেশ্বরি ।।
ওঁ সূত্রেণ গ্রথিতং মাল্যং নানাপুষ্পসমন্বিতম্। 
শ্রীযুক্তং লম্বমানঞ্চ গৃহাণ পরমেশ্বরি ।।

" অমৃত থেকে উৎপন্ন, অত্যন্ত শ্রীযুক্ত, মহাদেবের সদাপ্রিয়, পবিত্র এই বিল্বপত্রমাল্য, হে সুরেশ্বরী, তোমাকে নিবেদন করছি। 
 হে পরমেশ্বরি, সূত্রের দ্বারা গাঁথা, নানাবিধ পুষ্পযুক্ত, শোভাযুক্ত লম্বমান এই মালা তুমি গ্রহণ করো।"

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted