দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষ!
অজয় সাহা বিক্রমপুরের আমাদের ভাগ্যকুল বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন৷ দুই যুগ আগেই দেশ ছাড়েন৷ আমার এক বাল্যবন্ধু কলকাতার এক কাচাবাজারে তাঁকে দেখেন হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আলু বিক্রি করতে৷ বন্ধুটি কাকা সম্বোধন করে ডাকতেই তিনি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন৷ বন্ধুটি আরো কাছে গিয়ে বলে, 'কাকা আমাকে চিনতে পারেন নি?'
অজয় সাহা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন৷ ধরা গলায় বলেন, "বাবা তোকে কি না চিনতে পারি! আমি লজ্জায় তোকে মুখ দেখাতে চাইনি৷ তুই এ দীনহীন অবস্থায় আমাকে দেখে কষ্ট পা তা চাইনি!"
কেন দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই যুগ পরেও চলে যেতে বাধ্য হলেন? বন্ধুটি সেটাই জানার চেষ্টা করেছেন৷ কজন প্রভাবশালী মানুষ দিনের পর দিন বাকি খেয়ে টাকা দিত না উল্টো টাকা হাওলাদ নিয়েও দিত না৷ চাইলে ভয় দেখাতো! তখনই সিদ্ধান্ত নেন দেশ ছাড়বেন৷ সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দেন কলকাতায়৷ তিনি কলকাতা গিয়ে বুঝতে পারেন যাদের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন সেই টাকা তারা আর তাকে দিবে না৷ জীবন বাঁচাতে শুরু করেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলু বিক্রি করা৷ অজয় সাহা একজন উন্নত রুচির ক্রীড়ামোদী মানুষ ছিলেন৷ ফুটবলে রেফারি ও ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ার হিসেবেও সুখ্যাতি পেয়েছিলেন৷ সেই মানুষটিকেও শুধু সাম্প্রদায়িক কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছে৷
আমাদের ভাগ্যকুলে জন্ম নেয়া অধ্যাপক শক্তিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'পদ্মা থেকে গঙ্গা' তে আমরা এমন অনেক ঘটনা পাই৷ তিনি এসএসসি পাশ করে কলকাতায় গিয়েছিলেন পড়তে৷ আর আসা হয়নি৷ ভারত ভাগের সময় সংঘটিত দাঙ্গার জেরে কলকাতা যাওয়া কজন শিক্ষককে তিনি আবিষ্কার করেন দীনহীন অবস্থায়৷ এক শিক্ষককে দেখেন হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে কচু বিক্রি করতে৷ শরীর চর্চা শিক্ষককে দেখেন অভূক্ত রুগ্ন অবস্থায়৷
দেশ হারানোদের আশ্রয় হয় মহাভারতের রাম-সীতার আশ্রয় নেয়া দণ্ডকারণ্যে৷ মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের চেয়ে বড় সুবিশাল এক অরণ্যাঞ্চল৷ সেই দণ্ডকারণ্যে বনবাসে যাওয়া অসংখ্য দেশ ছেড়ে যাওয়া হিন্দু বাঙালির আর কোন হদিস আমরা জানি না৷ এর মধ্যে পার হয়েছে আরো দু/তিনটি প্রজন্ম! বিক্রমপুরের দুজন দণ্ডকারণ্য কমিশনের প্রথম দুই চেয়ারম্যান৷ বিক্রমপুরেরও বহু মানুষ আশ্রয় নেয় দণ্ডকারণ্যে! আজ যেমন দেশ হারানো রুহিঙ্গারা ভাসানচরে মানবেতর জীবন যাপন করছে৷ ধর্মীয় কারণে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ আজো দেশ হারাচ্ছে৷
যতদিন ধর্মের প্রভাব থাকবে রাষ্ট্রে, সমাজে ততদিন মানুষ দেশ হারাতেই থাকবে৷
লেখক: Mojib Rahman
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................