১৯৬৪ সালের এক বৃহস্পতিবার রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে সাত জন আগন্তুক এসে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ থেকে কথিত প্রফট মুহাম্মদের চুল চুরি করে পালিয়ে যায়। এই সাতজনের মধ্যে একজন ছিলেন কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাধারণ সম্পাদক বখশি আবদুর রশিদ। চুল চুরির ঘটনা তারাই ছড়িয়ে দেয়। যেহেতু ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে এসেছে- এ কাজ যে হিন্দুদের সেটা সহজেই অনুমান করে নিবে জনতা। হলোও তাই। কাশ্মীরের যেন আগুন লেগে গেলো। ভাত কাপড় চিকিত্সা বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদার জন্য নয়, একজন নবীর কথিত চুল চুরি গেছে শুনে মানুষজন ঘরে ছেড়ে জঙ্গি রূপ নিয়েছে। উত্তেজিত জনতাকে কাশ্মীরের কংগ্রেসের শফি কোরেশি, পলিট্রিক্যাল কনফেরারেন্সর সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন ও গণভোট ফ্রন্টের মুজাহিদ শান্ত করে অন্যত্র সরে যেতে রাজি করান। কিন্তু বখশি আবদুর রশিদ হঠাত সেখানে উপস্থিত হয়ে ফের জনতাকে উত্তেজিত করে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। ফলে পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি করতে বাধ্য হয়।
ভারতে মুসলমানরা হিন্দুদের উপর জিহাদ ঘোষণার পর ঘটনা সেখানে থেমে থাকবে সেই উদ্দেশ্যে তো এতবড় ঘটনা ঘটানো হয়নি। বখশি আবদুর রশিদদের একটি গোপন রাজনীতি থাকে- যার নাম ‘মুসলিম উম্মাহ’। এটি একটি ভয়ংকর কাল্ট জাতীয়তাবাদ। কংগ্রেস সিপিএম আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট পার্টি যেটাই করেন ভেতরে এই জাতীয়তাবাদ পুষে বেড়াতে পারেন। যে কারণে হযরতবালের ঘটনার পর কোলকাতা ও পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার ‘পূর্ব পাকিস্তান ইসলামিক বোর্ড’ এর অন্যতম সদস্য আবদুল হাই পূর্ব পাকিস্তানে থাকা হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ যাবার প্রক্কালে সাংবাদিকদের বলে যান, হযরতবালের ঘটনার প্রতিক্রিয়া যদি এখানে কিছু ঘটে তার দায়দায়িত্ব আমরা নিবো না...।
খুলনা দৌলতপুর মংলা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের আদমজিতে ভয়াবহ ম্যাসাকার শুরু হয়ে যায়। এটাকে খুব চালাকি করে এই দেশে ‘দাঙ্গা’ নাম দেয়া হয় যাতে মনে হতে পারে এখানে বুঝি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী ফাইট হয়েছিলো। বিষয়টি তা নয়। দেশভাগের আগে পরে বাংলাদেশে দাঙ্গার কোন ইতিহাস নেই। এখানে হিন্দুদের উপর একতরফা মার হয়েছে আর তারা পালিয়েছে। হযরতবালের ঘটনায় কোলকাতায় দাঙ্গা ছড়িয়েছিলো। কাশ্মীর ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা লেগেছিলো। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর মুসলমানরা একতরফা হামলে পড়ে। চলে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, খুন। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকে। দৈনিক ইত্তেফাকে বের হয় ঢাকা শহরের ক্ষতিগ্রস্ত গৃহের ৯৫% হিন্দুদের আর এক লক্ষ হিন্দু খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে! নবীর চুল চুরির অভিযোগে যে বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুদের বিদ্বেষ করে যাচ্ছিলো এক পর্যায়ে দেখা গেলো তারাও আতংকিত হয়ে পড়েছে। কেননা এক পর্যায়ে খুনোখুনিটা বিহারী মুসলমানরা বাঙালি মুসলমানদের উপরেও চাপিয়ে দিয়েছিলো। বিহারী মুসলমানরা বাঙালি মুসলমানদের কখনো পরিপূর্ণ মুসলমান মনে করেনি। হযরতবাল মসজিদের ঘটনায় তাই হিন্দুদের পাশাপাশি ছোট পরিসরে বিহারীদের হাতে বাঙালি মুসলমানরাও আক্রান্ত হতে থাকে। সরকার কারফিউ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমান এই ম্যাসাকার নিয়ন্ত্রণে সকল পক্ষকে শান্ত হতে বলেন এবং রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ওয়ারী এলাকার পাঁচশো হিন্দু পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বলা যায় তার এই ভূমিকাই পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের কাছে তাকে দেশভাগের পর ‘মুসলিম লীগের শেখ মুজিবকে’ ভুলে ‘নিজেদের নেতা’ হিসেবে বরণ করে নেয়।
৬৪ সালের এই দাঙ্গা হিন্দুদের বড় একটি অংশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পুরো পাকিস্তান আমলে থেমে থেমে এমন পরিস্থিতি কখনো প্রকাশ্যে কখনো অপ্রকাশ্যে চলতে থাকে যে দেশছাড়ার ধারা হিন্দুদের কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে যা স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত জারি আছে। হযরত বাল মজিদের প্রফেটের চুল চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে মুসলমানরাই। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সূচনার পেছনে মুসলিমদের হাত একটি ঐতিহাসিক সত্য যেটা বললে নিশ্চিত করেই ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ হিসেবে গণ্য হবো! এটি একটি সহজাত বিষয়। আপনি পৃথিবীতে মন্দির গির্জা মঠ যেখানেই যান কোথাও কারোর ধর্ম নিয়ে বিষেদাগার পাবেন না। কিন্তু মসজিদে আপনি হিন্দু খ্রিস্টান ইহুদীদের শিরক, নফরমানী শত্রুতা এইসব শুনতে পাবেন। এই শিক্ষা তাদেরকে অন্যের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ করে তোলে যা একদম বাচ্চা বয়স থেকে একজন মুসলমান পেয়ে থাকে। আমরা ছোট থাকতেই মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের সঙ্গে মুনাজাত ধরতাম ইহুদীদের ধ্বংস করে যেন দেয়া হয়। ভারতের হিন্দুদের উপর যেন গজব পড়ে...। আজো মসজিদগুলিতে সেই ধারাই চলছে। এটা আপনি খুব গোপনে হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধদের ধর্মালয়ে গিয়ে দেখতে পারেন সেখানে অন্যদের ধর্ম নিয়ে কোন কথা নেই। চলমান কোন ঘটনা নিয়ে, কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা নিয়ে সেখানে পুরোহিত ফাদার ভান্তে কিছু বলছে না। এইসব ধর্মকে প্রশংসা করছি না, ঐসব ধর্মজীবীদের ভালো বলছি না, বলছি তাদের কারোকে কি ইসলাম নিয়ে কথা বলতে দেখেন? ভারতে নেপালে কোথাও সংখ্যার বিচারেও সেটা ঘটে না। অথচ ভারতের মসজিদগুলিতে, ওয়াজে সমানে হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কটুক্তি করতে মুসলিম মুল্লাদের ভয় হয় না।
৬৪ সালের ম্যাসাকর নিয়ে খুব বেশি বই লেখাপত্র পাওয়া যায় না। যা আছে সেখানেও খুব সাবধানে ‘গুটি কয়েক দুর্বৃত্ত’ উল্লেখ করে বাকী সবাইকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখানো হয়েছে। সমস্ত দোষ চাপানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর। অথচ খুন হত্যা মেতে উঠেছিলো কারখানার শ্রমিকসহ সাধারণ মুসলমানরা। হ্যাঁ ভালো উদার প্রগতিশীল মানুষ এগিয়ে এসে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আমির হোসেন চৌধুরী হিন্দুদের উপর হামলা ঠেকাতে গিয়ে মারা যান। আমেরিকার জাতীয় অধ্যাপক ও নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার নোভাক একটি হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে আক্রমনের শিকার হয়ে মারা যান...। এতবড় ঘটনার পরও পূর্ব পাকিস্তানের কবি কথা সাহিত্যিকদের কলম থেকে এই ঘটনা নিয়ে কোন সাহিত্য রচিত হয়নি! যে ঘটনার পর ঢাকার সমস্ত স্কুল বন্ধ করে হিন্দুদের জন্য আশ্রয় শিবির খুলতে হয়েছিলো, স্কুলগুলোর শিক্ষক ও স্টুডেন্ট সংকট চোখে পড়ার মত ছিলো, হিন্দু দোকানপাটগুলি আগুনে পোড়ানো, ধ্বস্তুপ- তেমন ঘটনায় এখানকার লেখকদের মনে এতটুকু দাগ কাটেনি? দুয়েকটি যা হয়েছে তার মূল সুর হচ্ছে ঐ ‘গুটি কয়েক দুর্বৃত্ত’ আর বাকীরা সব দরবেশ বাবা! আর পূর্ব পাকিস্তান অসাম্প্রদায়িক। হিন্দুরাই ভারতে দাঙ্গা লাগিয়েছে। এখানে দাঙ্গা লাগলে ভারতের সুবিধা... এই রকমই এখনকার ইতিহাসের ভাষ্য...।
তথ্যসূত্র : দ্য ডন, পাকিস্তান, করাচি, ২৩ জানুয়ারী, ১৯৬৪/ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩-৬ জানুয়ারী ১৯৬৪। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৬৪): সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ও পর্যালোচনা, সজীব কুমার বণিক ও খালেদা চৌধুরী।
Written by : সুষুপ্ত পাঠক
#copyrightfree
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................