সনাতন ধর্ম পরিত্যাগকারী,
'অসিপত্রবন' নরকে নিক্ষিপ্ত হয়
ধর্ম হল জন্মদায়িনী মায়ের মত। মায়ের সতিত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন করা যায় না। মাকে যেমন কোন অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যায় না, তেমনি শাশ্বত সনাতন ধর্ম; যা পূর্বে ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এ সনাতন ধর্মকে কখনো পরিত্যাগ করা যায় না। এ ধর্মের মূলে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ নয়; স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক প্রবর্তিত হয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই এ সনাতন ধর্ম নিরবচ্ছিন্ন বহমান। এ কারণেই শ্রীমদ্ভগবদগীতার তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে:
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্ স্বনুষ্ঠিতাৎ৷
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ৩.৩৫)
"নিজ ধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত আপাত দৃশ্যমান পরধর্ম থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই নিজধর্ম সাধনে যদি মৃত্যুও হয়, তবেও সে ধর্ম কল্যাণকর ; কিন্তু পক্ষান্তরে পরধর্ম ভয়াবহ। "
এরপরেও বিধর্মীদের বিভিন্ন প্রকারের প্রলোভনে পড়ে অনেকে ধর্মান্তরিত হয় বা হতে বাধ্য হয়। এরা সকলেই ভয়ংকর নরকগামী হয়। মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, যারা নিজের জাতির সাথে, সম্প্রদায়ের সাথে, নিজের প্রতিবেশীদের সাথে, নিজের পরিবার পরিজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধর্মান্তরিত হয়; তারা যা কিছুই করে সকলেই অধর্মে পর্যবসিত হয়। তারা কখনই শান্তি পায় না।
জাতিশ্রেণ্যধিবাসানাং কুলধৰ্ম্মাংশ্চ সৰ্বতঃ।
বর্জয়ন্তি চ যে ধৰ্মং তেষাং ধর্মো ন বিদ্যতে।।
(মহাভারত:শান্তিপর্ব, ৩৬.১৯)
" যারা নিজের জাতি, নিজের শ্রেণী, ও নিজের প্রতিবেশীদের ধর্ম, সর্বপ্রকার কুলধর্ম এবং শাস্ত্রোক্ত দানাদিধর্ম পরিত্যাগ করে, তারা ধর্মান্তরিত হয়ে গেলেও তাদের কোন ধর্ম হয় না।"
অনেকে মনে করেন রামায়ণে বিভীষণ তাঁর কুলধর্ম পরিত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষে যোগ দিয়ে অধর্ম করেছেন। তাই তিনি লঙ্কাকুলের গৃহশত্রু। কিন্তু বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, বিভীষণ নয়, বরং রাবণ কুম্ভকর্ণ তাদের কুলধর্ম পরিত্যাগ করেছিল। কারণ রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ সকলেই ছিলেন ঋষি বিশ্রবার পুত্র। তেজস্বী মহর্ষি বিশ্রবা ছিলেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, ক্রতু আদি সপ্তর্ষির অন্যতম ঋষি পুলস্ত্যের মানসপুত্র। সে দিক থেকে জন্মসূত্রে রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ সকলেই ছিলেন ঋষিপুত্র। ঋষির ধর্মই হল সর্বদা বেদকে অনুসরণ করে সত্য, ন্যায়ের পক্ষে চলা। তাই সে হিসেবে বলা যায় বিভীষণ কুলধর্ম ত্যাগ করে নি, বরং অধর্মকে পরিত্যাগ করে পরম সত্যের সান্নিধ্যে এসে ঋষিকুলের কুলধর্মকে রক্ষা করেছিলেন।মনের শঠ প্রবৃত্তিকে অবলম্বন করে যে সকল ব্যক্তি শাশ্বত ধর্ম পরিত্যাগ করে, অমানবিক আসুরিক ধর্মে জীবন যাপন করতে ইচ্ছা করে তারা প্রতারক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সকল পাপিষ্ঠ প্রতারকেরা সহজ সরল মানুষকে প্রতারিত করার লক্ষ্যে সারাজীবন প্রতারণাতেই সক্রিয় থাকে। শাশ্বত ধর্ম হতে বিচ্যুত, অমানবিক আসুরিক ধর্মের আশ্রয় গ্রহণকারী তাপসিক ব্যক্তি সর্বদা নিন্দনীয় পথেই পরিচালিত হয়। সেই পাপাত্মাকে সমাজ বা রাজশক্তি শোধন করবে, না হয় রাজা সেই ব্যক্তির প্রাণদণ্ড প্রদান করবে।
দণ্ডেনৈব স হন্তব্যস্তং পন্থানং সমাশ্রিতঃ।
চ্যুতঃ সদৈব ধর্ম্যেভ্যোঽমানবং ধর্মমাস্থিতঃ॥
শঠঃ স্বধর্মমুৎসৃজ্য তমিচ্ছেদুপজীবিতুম্। সর্বোপায়ৈর্নিহন্তব্যঃ পাপাে নিকৃতিজীবনঃ॥
(মহাভারত :শান্তিপর্ব, ১০৬ অধ্যায়, ২৫-২৬)
"যে ব্যক্তি আপন ধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে, অমানবিক আসুরিক ধৰ্ম আশ্রয় করে সে নিন্দনীয় পথেই চলতে থাকে; রাজা সেই ব্যক্তির প্রাণদণ্ড দিবেন।
একমাত্র শঠ প্রবৃত্তির ব্যক্তিই আপন ধর্ম পরিত্যাগ করে, অমানবিক আসুরিক ধর্মে জীবন যাপন করতে ইচ্ছা করে এবং সে লক্ষ্যে সারাজীবন প্রতারণাতেই নিযুক্ত থাকে। সেই পাপাত্মাকে সর্ব উপায়ে বধ করা উচিত।"
শাশ্বত ধর্মের পরিত্যাগকারী পাপিষ্ঠকে ইহলোকে রাজা যেমন প্রাণদণ্ড প্রদান করবে, তেমনি মৃত্যুর পরেও তাকে যমদূতেরা ভয়ংকর লাঞ্ছনা প্রদান করবে। শাশ্বত অপৌরুষেয় বেদাচার ছেড়ে যে পাপিষ্ঠ পাষণ্ড ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে অনাচারে প্রবৃত্ত হবে, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নরকে নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে কশাঘাত করবে। সেই ভয়ংকর নির্মম কশাঘাত খেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ছুটে পালাতে প্রচেষ্টা করবে। কিন্তু সফল হবে না। দুপাশে থাকবে তলোয়ারের মতো ধারাল অসিপত্রের তালবন। সেই তালগাছের পাতাগুলো তলোয়ারের মত ধারালো। যমদূতের কশাঘাতের হাত থেকে পালাতে গিয়ে ধারালো পাতায় সেই পাপির সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হতে থাকবে। সে তখন," হায় হায় আমি মরলাম!" বলে দারুণ মৃত্যু যন্ত্রণায় পদে পদে জ্ঞান হারাবে। নরকে এভাবে দীর্ঘকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করে, তাকে পুনরায় আবার কোন তামসিক যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়।
যস্ত্বিহ বৈ নিজবেদপথাদনাপদ্যপগতঃ
পাখণ্ডং চোপগতস্তমসিপত্রবনং প্রবেশ্য
কশয়া প্রহরন্তি তত্র হাসাবিতস্ততো ধাবমান উভয়তোধারৈস্তালবনাসিপত্রৈশ্ছিদ্যমানসর্বাঙ্গো হা হতোঽস্মীতি পরময়া বেদনয়া মূৰ্চ্ছিতঃ পদে পদে নিপততি স্বধর্মহা পাখণ্ডানুগতং ফলং ভুঙক্তে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত: ৫.২৬.১৫)
"যে ব্যক্তি অকারণে বেদাচার ছেড়ে পাষণ্ড ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে অনাচারে প্রবৃত্ত হয়, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নরকে নিক্ষেপ করে গিয়ে কশাঘাত করতে থাকে। সেই কশাঘাত খেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণায় ছুটে পালাতে গেলে দুপাশে তালবনের অসিপত্রে, অর্থাৎ তলোয়ারের মতো ধারাল পাতায় সেই পাপির সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। সে তখন 'হা হতো অস্মি' ( হায় হায় আমি মরলাম! ) বলে দারুণ মৃত্যু যন্ত্রণায় পদে পদে জ্ঞান হারায়। স্বধর্ম ত্যাগ করে পাষণ্ড ধর্ম অনুসরণ করলে এমন শাস্তিই ভোগ করতে হয়।"
ধর্মান্তরিত পাপিষ্ঠদের গম্য অসিপত্রবন নরক সম্পর্কে গরুড়পুরাণের উত্তরখণ্ডে সুবিস্তারে বলা হয়েছে:
অসিপত্রবনং নাম নরকং শৃণু চাপরম্ ।
যোজনানাং সহস্রং ধো জ্বলত্যগ্ন্যাশৃতাবনিঃ ॥
অতি তীব্রকরৈশ্চগুৈর্যত্র তীরে সুদারুণে।
প্রতপন্তি সদা তত্র প্রাণিনো নরকৌকসঃ।।
তন্মধ্যে চরণং শীতং স্নিগ্ধপত্রং বিভাস্যতে।
পত্রাণি যত্র খণ্ডানাং ফলানি পক্ষিসত্তম।।
শ্বানশ্চ তত্র সুবলাশ্চরন্ত্যামিষভোজনাঃ।
মহাবক্ত্রা মহাদংষ্ট্রা ব্যাঘ্র ইব মহাবলাঃ।।
ততশ্চ বনমালোক্য শিশিরচ্ছায়মগ্রতঃ।
প্রয়ান্তি প্রাণিনস্তত্র ক্ষুত্তাপপারিপীড়িতাঃ।
হা মাতর্ভ্রাতস্তাতেতি ক্রন্দমানাঃ সুদুঃখিতাঃ ।
দহ্যমানাঙ্ঘ্রিযুগলা ধরণিস্থেন বহ্নিনা।।
তেষাং গতানাং তত্রাসীদ্ যত্র যাতি সমীরণঃ ।
প্রবাতি তেন পাত্যন্তে তেষাং খড়্গাস্তথোপরি।।
ছিন্না পতন্তি তে ভূমৌ জ্বলৎপাবকসঞ্চয়ে।
লেলিহ্যমানে চান্যত্র তপ্তাশেষমহীতলে।।
সারমেয়াশ্চ তে শীঘ্রং শাতয়ন্তি শরীরতঃ।
তেষাং খণ্ডান্যনেকানি রুদতামতিভীষণে।।
অসিপত্ৰবনং তাত ময়ৈতৎ পরিকীর্তিতম্ ।
অতঃপরং ভীমতরং তপ্তকুম্ভং নিবোধ মে।।
(গরুড়পুরাণ: উত্তরখণ্ড, ৩.৩১-৪০)
"অপর এক নরকের নাম অসিপত্রবন । সে নরক সংস্রযোজনব্যাপী অগ্নিময় ভূমি। সেই অতি
তীব্র আগুনের তাপে সন্তপ্ত হয়ে প্রাণিগণ মহাক্লেশ পেতে থাকে। সেই নরকের মধ্যস্থানে স্নিগ্ধপত্র বিদ্যমান; কিন্তু সেই পত্র খড়্গের মত ধারালো। সেখানে গেলে মানবের পদদ্বয় শীতল হয়ে যায়। সেখানে বাঘের মত মহাবল মহাদংষ্ট্র বিকটাকার দীর্ঘমুখের কুকুর মাংসলোভে সর্বদা বিচরণ করে।প্রাণিগণ সেই বনে নিক্ষিপ্ত হয়ে স্নিগ্ধচ্ছায়াযুক্ত বন দেখে সকলেই সেই পথে ধাবিত হয়। তারা যেতে যেতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অত্যন্ত ক্লিষ্ট হয়ে, হে মা! হে ভ্রাতা! হে পিতা বাঁচাও বাঁচাও! বলে আর্তনাদ করতে থাকে। ভূমিস্থ আগুনে তাদের পদদ্বয় দগ্ধ হয়ে যায়। তাদের যাওয়ার সময়ে প্রবল গতিতে বায়ু প্রবাহিত হয়। তখন সেই খড়গ বা অসির আকারের পত্রসকল তাদের উপরে পতিত হয়। এতে তাদের শরীর ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে জলন্ত আগুনের মধ্যে পতিত হয়। তখন সেই ভয়ংকর বিকটাকার কুকুরগুলি তাদের দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে খেতে শুরু করলে সেই পাপিষ্ঠরা অসহ্য নরকযন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তাত গরুড়! অসিপত্রবন নরকের বিবরণ বর্ণনা করলাম। এখন তপ্তকুণ্ড নরকের বিবরণ শ্রবণ করুন।"
যে স্বধর্মত্যাগ করে সে অধর্মে সংযুক্ত হয়, তার ইহলোকে পরলোকে কোন গতি হয় না। মহাভারতে বনপর্বে বলা হয়েছে, যে লোক স্বধর্ম এবং স্বকর্ম রক্ষায় যত্নশীল তিনিই প্রকৃত ধার্মিক।
স্বধর্মং ত্যজতো ব্রহ্মমধৰ্ম্ম ইতি দৃশ্যতে ।
স্বকৰ্মনিরতো যন্ত্র ধর্মঃ স ইতি নিশ্চয়ঃ ॥
(মহাভারত:বনপর্ব, ১৭৬.১৮)
"হে ব্রাহ্মণ! স্বধর্মত্যাগীর অধর্ম হয় এবং যে লোক স্বকর্মনিরত, সেই প্রকৃত ধার্মিক; এ বিষয়টি শাস্ত্রে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে।"
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................