ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃত মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা

মুহম্মদ বিন কাশিম এবং সুলতান মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে একের পর এক আক্রমণ করে স্থানীয় রাজাদের পরাজিত করার মাধ্যমে তাদের সেনাবাহিনী ধ্বংস করে প্রচুর ধন-সম্পত্তি লুট করে, নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বন্দী করলেও স্থায়ী ভাবে রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেনি। অনেক সময় বিশ্বস্ত এবং মনোনীত শাসকদের হাতে সদ্যজয়কৃত রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে আবার ফিরে গিয়েছে নিজেদের রাজ্যে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে তখন পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃত মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মুইজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ওরফে মুহম্মদ ঘুরি। বারবার হামলা এবং প্রতি-হামলা সহ্য করে মুহম্মদ ঘুরি এই অঞ্চলে শক্তিশালী বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাত এবং গজনী অঞ্চলের মধ্যবর্তী ছোট্ট একটা এলাকার নাম “ঘর”। ঘরের সামন্ত রাজা ছিলো মুহম্মদ ঘুরির বাবা বাহাউদ্দিন সাম। বাহাউদ্দিন সামের দুই সন্তান; গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদ এবং অপরজন মুইজউদ্দিন মুহম্মদ। গিয়াসউদ্দিনের গজনী দখলের সময় খোরাসানের যুদ্ধে মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি বড়ো ভাইকে সাহায্য করে। মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি এক জন উচ্চাভিলাষী সামরিক নেতা ছিলো। ছেলেবেলা থেকেই তার মনে হতে থাকে এতো ছোট রাজ্য তার জন্য নয়, ছোট্ট গজনীকে দুই ভাই ভাগে শাসন করে সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তার দরকার আরও ক্ষমতা, আরও বড়ো রাজ্য। তাই পুরো ভারত ভারতবর্ষ কীভাবে পদানত করা যায় সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়ে। সুতরাং, যুদ্ধ বিদ্যাটা ভালো মতো শেখেই সে অভিযানে নেমে পড়ে।
ঘুরি ১১৭৫ সালে বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান আক্রমণ করে, মুলতানের শাসক ইসলামের ইসমাইলি সম্প্রদায়ের মালিক খসরু্র ছেলেকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। মূলত মুলতান দখলের মধ্য দিয়েই তার রাজ্য বিস্তারের শুরু। মুলতান দখলের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সে সিন্ধু অববাহিকার ছোট-ছোট রাজ্য গুলো দখল করতে থাকে। ১১৭৮ সালে সিন্ধুর উচ রাজ্য দখল করে সেখানে একটা দুর্গ নির্মাণ করে। সিন্ধু থেকে মুহম্মদ ঘুরি গুজরাটে ঢুকার চেষ্টা করে। প্রাথমিক ভাবে মুহম্মদ ঘুরি স্থানীয় রাজপুত যোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে, কারণ তখন পর্যন্ত রাজপুতরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো, ভ্রাতৃ-ঘাতী আন্তঃ-কোন্দল তখনো ততোটা তীব্র ভাবে দানা বেঁধে ওঠে নি। উগুজরাটের রাজপুত রাজা ভীমদেব সোলাঙ্কি গুজরাটের রাজধানী আনিল বারের কাছে কায়াদারার যুদ্ধে ঘুরিকে পরাজিত করে। কিন্তু যুদ্ধ বন্দীকে হত্যা করা রাজপুতদের যুদ্ধের নিয়ম বিরুদ্ধ হওয়ায় মুহম্মদ ঘুরিকে জীবিত ছেড়ে দেয়।যুদ্ধে হেরে গেলেও মুহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী ফিরতি পথের দু পাশের মন্দির, গঞ্জ, নগর ধ্বংস এবং লুট করতে করতে গিয়েছিলো।কিন্তু কথায় আছে না, পরাজয়ে ডরে না বীর...১১৭৯ সালে আরও এক বার গুজরাট আক্রমণের চেষ্টা করলে গুজরাটের রাণী নাইকি দেবীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।গুজরাট দখলে ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মরুভূমি অতিক্রম করে আবার সিন্ধুতে ফিরে গেলেও তার অভিযান কিন্তু থেমে থাকেনি।

১১৭৯ সালে ঘুরি পেশোয়ার দখল করে নেয়। ১১৮২ সালের মধ্যে পুরো সিন্ধু অববাহিকার সব গুলো রাজ্য তার দখলে চলে আসে। সিন্ধুর পরে মুহম্মদ ঘুরির চোখ পড়ে পাঞ্জাব এবং লাহোরের উপর। মুহম্মদ ঘুরি ভারতের রাজনীতি, রাজায়-রাজায় বিভক্তি, ধর্মীয় রীতিনীতি, হিন্দুদের জাতি-বিভাজন, সামাজিক এবং সামরিক শক্তি, দূর্বলতা, সম্ভাবনা এবং হুমকি সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ওয়াকিবহাল ছিলো। সে জানতো, ভারত ধন সম্পদে, সোনা, জহরতে যতোটা পরিপূর্ণ প্রতিরক্ষায় ঠিক ততোটাই দূর্বল। কারণ সে ইতিপূর্বে মুহম্মদ বিন কাশিম এবং সুলতান মাহমুদের বারংবার প্রায় প্রতিরোধহীন ভারত আক্রমণের কাহিনী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতো। রাজ্য দখল করে শুধু লুট করে নিজের দেশে ফেরত যাওয়া নয়, মুহম্মদ ঘুরি পরিকল্পনা করলো, রাজ্য জয় করে স্থানীয় বাসিন্দাদের ইসলাম কায়েম করে এখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করবে।যেই চিন্তা সেই কাজ; সুতরাং, আক্রমণ শুরু।

তারাইনের প্রথম যুদ্ধঃ ১১৯১ সালে মুহম্মদ ঘুরি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যবর্তী খায়বার গিরিপথ অতিক্রম করে ভারত এবং বর্তমান পাকিস্তান সীমান্তের পাঞ্জাবে পৌঁছায়। পাঞ্জাব পৌঁছেই ঘুরি দিল্লী অভিযান শুরু করে এবং পাঞ্জাবের শিরহিন্দ দখল করে। পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজ্যের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের একটা শক্তিশালী দূর্গ দখল করে নেয়। কাজি জিয়া উদ্দিনের উপর দূর্গের ভারার্পণ করে গুজরাট অভিমুখে আগাতেই মুহম্মদ ঘুরি সংবাদ পেলো যুবরাজ গোবিন্দ রাইয়ের নেতৃত্বে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সসৈন্যে দুর্গ পুনরুদ্ধারে দুর্গের তিনদিক থেকে ঘিরে ধরে। দুই সেনাবাহিনী থানেশ্বর(হরিয়ানা) থেকে ১৪ মাইল দূরে তারাইনে মুখো-মুখি অবস্থান নেয়।মুহম্মদ ঘুরির মামলুক সেনারা প্রথম তীর নিক্ষেপ শুরু করলে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনী সাহসিকতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করে এবং যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। পৃথ্বীরাজের ভাই গোবিন্দ রাইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরি মারাত্মকভাবে জখম হয়, গোবিন্দ নিজেও আহত হয়। শেষ পর্যন্ত পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনী চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে এবং ঘুরির সেনাবাহিনী রণে ক্ষান্ত দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে যুদ্ধে পরাজিত করলেও গোবিন্দ কিন্তু আক্রমণকারী পরাজিত সেনাদের হত্যা করে না।মারাত্মক আহত মুহম্মদ ঘুরিকে কুতুবউদ্দিন আইবেক ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দ্রুত যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে হেরে যাওয়ার মধ্যেই লিখিত আছে ঘুরির ভারত বিজয়ের ইতিহাস।

তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধঃ তারাইনের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মুহম্মদ ঘুরি অপমানে ফুঁসতে থাকে এবং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। সে প্রতিদিন আঁকতে থাকে ভারত আক্রমণের ছক। ভারতে চূড়ান্ত আক্রমণের লক্ষ্যে সে এবারে তুর্কি, আফগান, পার্সিয়ানদের সমন্বয়ে গঠন করে ১,২০,০০০ সৈন্যের বিশাল সেনাবাহিনী। ১১৯২ সালে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ঘুরি পুনরায় ভারত আক্রমণ করার জন্য মনঃস্থির করে। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় আক্রমণ করতে অনেকেই নিরুৎসাহিত করলেও তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরি অনেক পরিণত, সংগঠিত, শত্রু পক্ষের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য, শক্তিমত্তা জেনে আট-ঘাট বেঁধেই যুদ্ধের ময়দানে নামে। মুহম্মদ ঘুরির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর পরামর্শে শেষ রাতের দিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণে চৌহানের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে ঘোড়সওয়ারী তরোয়ালধারী দুর্ধর্ষ আফগান তুর্কি সেনাদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ করতে করেই বিপুল সৈন্য ক্ষয় হয়ে যায়। ঘোড়ায় চড়া তীরের মত গতিবেগের দুর্ধর্ষ সেনাদের রুখতে পারে না চৌহান বাহিনী। শেষ রাত থেকে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনী তখন ক্লান্ত, তাদের শেষ শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে, এদিকে যুদ্ধ চলছে একনাগাড়ে শেষরাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সেনাদের মধ্যে সেনাপতি খাণ্ডে রাও মারা যাওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোবল ভগ্নপ্রায় এবং অবিন্যস্ত। এরকম ছত্রভঙ্গ সেনাদের উপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে দ্রুত গতির অশ্বারোহী অপ্রতিরোধ্য ১২০০০ আফগান সেনা।তাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তখন আসলেই পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনীর আর অবশিষ্ট ছিলো না।তারা নিরুপায় বেঘোরে আফগানদের হাতে মারা পড়তে লাগলো।

এদিকে যুদ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫০ জন ঊর্ধ্বতন সেনানায়ক এবং মিত্র রাজাদের নিয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহান একটা গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়ায়। তারা মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফেরার আগেই তুর্কি আফগান বাহিনী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং একই সাথে চলতে থাকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ, তখনই আসলে বেজে গিয়েছে মরণ ঘন্টা। তুর্কি এবং আফগান যৌথ বাহিনীর আক্রমণে রাজপুতরা নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে চৌহান রাজপ্রাসাদের দিকে পালানোর চেষ্টা করলেও ঘুরির হাতে বন্দী হয়ে যায়।
পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বন্দী করেই মুহম্মদ ঘুরি চলে যায় রাজপ্রাসাদে রাণী সংযুক্তার খোঁজে। তখন সম্ভ্রম রক্ষায় সংযুক্তা তার দাসীদের নিয়ে জহরব্রত করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও ততোক্ষণে ঘুরি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যায় এবং তাকেও বন্দী করে নিয়ে আসে। বাইরে তখনো যুদ্ধ চলছে সমান তালে, এদিকে কিছু মাত্র সময় দেরী না করে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সামনেই তার প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তাকে ধর্ষণ করে ঘুরি। পৃথ্বীরাজকে ইসলাম কবুল করার জন্য চাপ দিতে থাকে ঘুরি। কিন্তু চৌহান রাজি হয় না। আর এদিকে চলতে থাকে সংযুক্তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ।বন্দী অবস্থায় চৌহান ঘুরিকে হুংকার দিলে ঘুরি চৌহানের চোখ অন্ধ করে দেয়। ১৫ দিন একনাগাড়ে সংযুক্তাকে ধর্ষণ করার পর ঘুরি চৌহানের শিরশ্ছেদ করে কাটা মাথাটা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে উপহার দেয়।চৌহানের কাটা মাথা দেখে, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কষ্টের পর অবশেষে আমরা চূড়ান্ত বিজয় পেলাম।”

ততো দিনে ঘুরির সেনাবাহিনী রাজধানী অজয়মেরুর রাজপ্রাসাদ, কোষাগার, অস্ত্রাগার, টাকশাল, প্রতিটি নাগরিকের বাড়িঘর তছনছ করে, যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে দেয়।সামান্য যা প্রতিরোধ আসে সেটা আফগান, তুর্কি বাহিনীর সামনে শ্রেফ আত্মাহুতি দেয়া ছাড়া কিছুই নয়।নগরের সমস্ত সৈন্য নিহত হয় প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে।তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে অন্যতম হত্যাযজ্ঞ। মাত্র দশ ঘণ্টার ব্যবধানে তিন লাখ সৈন্যকে হত্যা করে ঘুরির সৈন্যদল। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি বলেন, “ঘুরির সেনাবাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে, বাদ যায় না যুবক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ। মাত্র দুদিন স্থায়ী যুদ্ধে অজয়মেরু শহরের ২০ লাখ অধিবাসীকে হত্যা করা হয়, ৫ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়, নারী ও শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা হয় হারেমে যৌন বিনোদন এবং কৃতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য। যে শহরটি এখন আজমির বলে পরিচিত সেটা ছিলো তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী নগরী।তিব্বত, মধ্য এশিয়া এবং আরবীয়রা ব্যবসার কাজে এখানে আসতো। বলা হয়ে থাকে, আজমির ছিলো রোমের থেকে দ্বিগুণ আর বেইজিং থেকে তিন গুণ বড়ো। এখন মুসলিম অধ্যুষিত আজমির শহরে হিন্দুরাই সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে।” আজমির, দিল্লী দখলের কয়েক দিনের মধ্যেই মুহম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনী প্রায় বিনা প্রতিরোধে উত্তর ভারতের সরস্বতী, সামানা, কোরাম, হাসি দখল করে নেয়। রাজ্য দখলের সময় জোরালো বাঁধা না আসলেও হত্যা করা হয় প্রতিটি নগরের দ্বাররক্ষী, সমস্ত সৈন্য, এবং বিনা উস্কানিতে সাধারণ নাগরিকরাও হত্যা থেকে রেহাই পায়নি।

তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে ভারতে ৬০০ বছর স্থায়ী ইসলামী শাসনামলের শুরু। দিল্লী এবং আজমির মুহম্মদ ঘুরির দখলে আসার পরে একের পর এক রাজ্যের পতনের পালা শুরু।কনৌজের রাজা জয়চাঁদ রাঠোরের সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শত্রুতা ছিলো।মুহম্মদ ঘুরি যখন পৃথ্বীরাজ চৌহানকে হত্যা করে তখন জয়চাঁদ রাঠোর উল্লাস প্রকাশ করেছিলো। এখানে উল্লেখ্য পৃথ্বীরাজ চৌহান ছিলো জয়চাঁদ রাঠোরের জামাতা। কিন্তু অপরিণামদর্শী রাজনীতি চিন্তার জয়চাঁদ রাঠোর চিন্তাও করতে পারেনি, তার কন্যা ইতিমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে গিয়েছে, জানতো না তার দিনও ঘনিয়ে আসছে।
১১৯৪ সালে ঘুরি কনৌজ আক্রমণ করে এবং চান্দাবারের যুদ্ধে জয়চাঁদ রাঠোরকে হত্যা করে। কনৌজ জয় করে মুহম্মদ ঘুরি কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে শাসনভার অর্পণ করে খোরাসান রণক্ষেত্রে চলে যায় বিদ্রোহ দমন করতে।কুতুবউদ্দিন আইবেক পুরো ভারত জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকে।

ফ্রান্সের সাংবাদিক Francois Gautier তার ‘Rewriting Indian History’(1996) বইতে লিখেছেন, “মুসলিমদের তরোয়ালের আঘাতে দীর্ঘমেয়াদী চলমান ভারতের হিন্দু গণহত্যায় ঘুরির নেতৃত্বে আফগান, তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা যার কোন তুলনা হয় না। ঘুরির নেতৃত্বে প্রকৃত পক্ষে কী পরিমাণ হিন্দু জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে তার সঠিক পরিমাণ কোন দিন জানা সম্ভব হবে না। কারণ মুসলিম শাসকরা হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস হিন্দুদের লাশের সাথেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তবে গণহত্যা শুধু মানুষ হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং হিন্দুদেরকে গণ-ধর্মান্তরকরণ, মন্দির ধ্বংস, মন্দিরের মূর্তি বিনষ্ট, লুটপাট, ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদেরকে যেতে হয়েছে।মুসলিম-বাহিনী মন্দির লুটে নিয়ে, মন্দির ধ্বংস করে দিয়ে প্রথমেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হত্যা করতো, তাদের স্ত্রী, কন্যাদের ধর্ষণ করে হারেমে পাঠিয়ে দিতো বা দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতো। রাজা, অমাত্য, মন্ত্রী, যুবরাজদের হত্যা করতো সবার পরে। কিছু যুবরাজকে হত্যা না করে তাদেরকে খোজা করে দিয়ে হারেমের পাহারায় নিযুক্ত করতো। বিশাল-সংখ্যক নারী সম্ভ্রম রক্ষা করতে বা যৌন-দাসী হওয়ার ভয়ে বিষপানে বা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো।

মুহম্মদ ঘুরির সাফল্যের পিছনে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর ভূমিকাঃ মুহম্মদ ঘুরির বিজয়ের পিছনে তার দক্ষ সেনাবাহিনী, রণকৌশল ছাড়াও সূফী সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর ভূমিকা অপরিসীম। মুহম্মদ ঘুরির আজমির আক্রমণের আগে থেকেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী সেখানে ইসলাম প্রচার করছিলো।কিন্তু হিন্দু রাজার অধীনে তার ইসলাম প্রচার খুব বেশি সফল ছিলো না।ফলে তার জন্য দরকার ছিলো রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। তাই কৌশলে আজমিরের ধন সম্পদের প্রাচুর্য, পৃথ্বীরাজ চৌহানের সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তার সৌন্দর্যের কথা ঘুরির কাছে উপস্থাপন করে। পৃথ্বীরাজ চৌহান, জয়চাঁদ রাঠোরের কন্যা সংযুক্তাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে। ফলে রাঠোর এবং পৃথ্বীরাজের মধ্যে শত্রুতা শুরু হয়। সেই শত্রুতাকে কাজে লাগায় খাজা মইনুদ্দিন চিশতী। চিশতী গুপ্তচরের মতো গোপনে পৃথ্বীরাজের সৈন্যবল, শক্তিমত্তা, রণকৌশল, অস্ত্রসম্ভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খবরা-খবর জোগাড় করে ঘুরিকে নিয়মিত জানাতে থাকে।চিশতীর মাধ্যমে ঘুরি জানতে পারে রাজপুতরা সূর্যাস্তের পরে আর যুদ্ধ করে না। সুতরাং, এটা আক্রমণের মোক্ষম সময়।
স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন, “চিশতীর পরামর্শেই শেষ রাতের আঁধারে ঘুরি ঘুমন্ত রাজপুত সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত চৌহানের সেনাবাহিনী আকষ্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায়। এদিকে মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করলে মইনুদ্দিন চিশতী রাজপুত-বাহিনীর পানির উৎসে বিষ মিশিয়ে দেয়।" 
বিজয়ীদের দ্বারা লিখিত ইতিহাসে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে একজন ধর্মপ্রচারক সূফী এবং দার্শনিক হিসেবে মহিমান্বিত করা হলেও বাস্তবে স্থানীয় হিন্দুদের জন্য সে লালন করত অপরিসীম ঘৃণা। ইতিহাসবিদ এস.এস.এ রিজভি ‘A History of Sufism in India’, Vol. 1(Munshiram Manoharlal, 1978)’ লিখেছেন, “খাজা মইনুদ্দিন চিশতী কিছু মুসলিম অনুসারী নিয়ে আজমিরের অন্নসাগর দীঘির পাড়ে আস্তানা গাড়ে। দীঘির চারপাশ ঘিরে বেশ কয়েকটি মন্দির অবস্থিত। সেখানে সে নিয়মিত গরু জবাই দিয়ে মাংস রান্না করে খাওয়ার পর মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে গরুর হাড়, বর্জ্য ফেলে দিতো। আলী আজগর বিন শাইখ মাহমুদের “জওহর-ই-ফরিদি” বইতে উল্লেখ আছে, “হিন্দুদের কাছে পবিত্র গরু জবাইয়ের অভিযোগে পৃথ্বীরাজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে গ্রেফতারের জন্য সেনা পাঠালে সে কোনক্রমে পালিয়ে রক্ষা পায়। স্থানীয় হিন্দু নারীদের প্রতি তার যৌন লালসার কথা অবিদিত নয় কিন্তু ইসলামকে গৌরাবন্বিত করতে গিয়ে এবং ইসলামিক শাসকদের রক্ত চক্ষুর ভয়ে সেসব কুকীর্তি চিরদিন থেকে গিয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।মন্দিরের সেবায়ত নারীরা সেখানে স্নান করতে, জল আনতে গেলে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী প্রায়ই তাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করতো।" অন্নসাগর দীঘির পাড়ে কামদেবের মন্দিরে পূজো দিতে আসা পৃথ্বীরাজের অসাধারণ রূপসী স্ত্রী সংযুক্তাকে দেখে সে এতটাই কামার্ত হয়ে পড়ে যে নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে তাকে ধর্ষণ করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখায়। পৃথ্বীরাজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে শিরশ্ছেদের জন্য সৈন্য পাঠালে এবারেও সে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে আজমির থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।মূলত তখনই সে সংযুক্তার রূপ-যৌবনের প্রশংসা করে আজমির আক্রমণে প্রলুব্ধ করে মুহম্মদ ঘুরিকে চিঠি লিখে। সেই সাথে জানিয়ে দেয় আজমিরের বিপুল ধন সম্পত্তি ও পৃথ্বীরাজের রাজপ্রাসাদের অতুলনীয় নারীদের ভোগ করার সীমাহীন সম্ভাবনা।

মুহম্মদ ঘুরির সাফল্যের কারণঃ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি A Study of History বইতে লিখেছেন, “মুহম্মদ ঘুরির সৈন্যদল গঠিত হয়েছিলো ইন্দাস এবং অক্সাস নদীর মধ্যবর্তী অববাহিকার পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের সমন্বয়ে যাদের জীবন-যাত্রা ছিলো সব সময় সংগ্রাম-মুখর এবং বিপদ সংকুল। অন্য দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ছিলো শান্তিপ্রিয়, অপেক্ষাকৃত অলস ও বিলাসী, ফলে তারা স্বভাবতই যুদ্ধ-বিমুখ।তাদের যুদ্ধের কলাকৌশল আফগান বা তুর্কিদের মতো উন্নত ছিলো না।ভারতীয় উপমহাদেশ ছিলো ছোট-ছোট রাজ্যে বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ নিত্য দিনের সঙ্গী।কোন রাজ্য আক্রান্ত হলে অন্য কেউ এগিয়ে আসতো না।”
যদিও যদুনাথ সরকার টয়েনবির বিরোধিতা করে বলেন, ভারতীয়দের যুদ্ধ কৌশল, বীরত্বের কোন ঘাটতি ছিলো না। রাজপুত সম্প্রদায় তো অসীম সাহসী এবং যোদ্ধা জাতি ছিল। তবুও তাদের পতনের কারণ কী? যদুনাথ সরকারের মতে ভারতীয়দের সামাজিক কাঠামো তাদের ধ্বংস ডেকে এনেছে। আরব, আফগান, পাঠান অথবা তুর্কি যে জাতির সৈন্য হোক না কেন, দাস বা মালিক, ত্বকের রঙ যাই হোক না কেন ইসলাম তাদেরকে দিয়েছে সাম্যতা।তিনটি অনন্য কারণে ঘুরির সৈন্যদল পৃথ্বীরাজ বাহিনী থেকে আলাদা।

১. সকল মুসলিম ভাই ভাই। সেখানে কোন জাতি ভেদ নাই, বর্ণ প্রথা নাই।যুদ্ধের ময়দানে সবাই সবার বিপদে আপদে এগিয়ে আসে।তাদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ়।
২. আল্লাহ এবং পরকালের উপর অটুট বিশ্বাস।
৩. ইসলামে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা মুসলিমদের বাঁচিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।প্রবল প্রতাপশালী রাজপুত, মারাঠাদের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ তাদের সুরাসক্তি।

ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো, সমরনীতি তুর্কিদের যুদ্ধে জিতিয়ে দিতে বড়ো ভূমিকা রেখেছে। ভারতের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র রাজনৈতিক ভাবে দূর্বল এবং সামন্ত রাজারা পারস্পারিক বিদ্বেষে এতো মগ্ন ছিলো যে বহিঃশত্রু পাশের রাষ্ট্র আক্রমণ করলে বরং তারা খুশি হতো। ছুতমার্গ ভারতের একটা ভয়াবহ সামাজিক ব্যধি। ছুতমার্গের কারণে এক বর্ণের হিন্দু অন্য-বর্ণের হিন্দুদের সাথে মেলা-মেশা করতে পারতো না, ফলে হিন্দুদের সেনাবাহিনীর দক্ষতা এবং একতা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘুরি অন্যায় ভাবে রাতের আঁধারে আক্রমণ করলে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।
সকাল পর্যন্ত খাবার আসতে আসতে রাজপুত বাহিনী আগে জিজ্ঞেস করে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা খাবার রান্না হয়েছিলো কিনা। রাজপুত বাহিনী অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও তারা ছিলো রক্ষণশীল আর হাতিতে চড়ে তাদের গতিও ছিলো অনেক ধীর। কিন্তু তুর্কি, আফগান বাহিনীর ঘোড়ায় চড়া গতি ছিলো বিদ্যুতের বেগে। তুর্কি ও আফগান বাহিনীর যুদ্ধের নিয়মনীতি মেনে চলার দায় ছিলো না, তারা আক্রমণকারী, অন্যায় ভাবে মানুষ মারতে তাদের দ্বিধা লাগে না, তাদের মৃত্যুর কোন ভয় নেই। যে কোন ভাবে হোক শত্রুপক্ষের কেন্দ্রে গিয়ে আক্রমণ করা তাদের অন্যতম রণকৌশল।আজমির শহর ধ্বংস করা শেষ হতেই খাজা মইনুদ্দিন চিশতী দিলো সন্ধ্যার আযান। শব্দ লক্ষ্য করে ঘুরি আযানের উৎসে পৌঁছে গেলো, সেখানে নামাজের জামাত প্রস্তুত।খাজা গরীবে নেওয়াজ মইনুদ্দিন চিশতীর ইমামতিতে মুহম্মদ ঘুরি দাঁড়িয়ে গেল মাগরিবের নামাজে।

Reference:
1. S.A. Rizvi in ‘A History of Sufism in India’, Vol. 1 (Munshiram Manoharlal, 1978)
2. Jawahar-i Faridi, written in 1033AH/1633 AD by Ali Asghar bin Shaikh Maudud of Fatehpur near Alllahabad, is another famous biographical work of the seventeenth century.
3. Medieval India: From Sultanat to the Mughals (1206–1526) by Satish Chandra .
4. A History of India By August Friedrich Rudolf Hoernle, Herbert Alick Stark
5. The Story of Civilization and The Case for India by Will Durant.
6. Rewriting Indian History (1996) by Francois Gautier
7. A Study of History by Arnold Joseph Toynbee
#Mu'izz-al-din#MuhammadIbnSam
#মুইজউদ্দিন_মুহম্মদ_বিন 

Rezaul Manik

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted