বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। সেই সময় যশোর ছিল আধা গ্রাম, আধা শহরটি ছিল তাঁর অপছন্দ। ম্যালেরিয়া রোগে ভরা। দুষিত পানি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এমন নানা কথা তিনি শুনেছিলেন কলকাতায় বসেই। তবুও তাঁকে এই শহরে আসতে হয়। কেননা চাকরি বলে কথা। তাছাড়াও এটি তাঁর প্রথম কর্মস্থল। অবশেষে তিনি সেই অপ্রিয় শহরটিকে ভালবেসেও ফেলেন। 

কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হয় এখানে এসে। আবার ব্যাক্তিগত জীবনের গভীর শোকাঘাতও পান তিনি এখানে। সেদিনের সেই আধা গ্রাম আধা শহরটি হল আজকের যশোর। আর চাকরিজীবী ব্যাক্তিটি হলেন প্রথম বাঙালী আমলা বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়। বাংলা গদ্য যাঁর হাতে আধুনিকতার স্পর্শ পেয়ে পূর্ণতাও পায়।

আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৫৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৮ সালে বিএ পরীক্ষা প্রবর্তিত হলে ১৩ জন এই পরীক্ষা দেন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন মাত্র দু’জন। ১৮৫৮ সালের ২৩ আগস্ট তিনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ পান। পরের বছর অবশ্য তিনি আইন পরীক্ষা দিয়ে উর্ত্তীণ হন। যশোর শহরে এসে তিনি এই পদে যোগ দেন। অভিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা ছিল যশোর। ১৭৮১ সালে মিঃ টিলম্যান হেংকেলকে কালেক্টর হিসাবে নিয়োগের মাধ্যমে যশোরের জেলা প্রশাসনের কাজ শুরু হয়। তখন জেলা সদর কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল যশোর শহরের মুড়লীতে। মুড়লী ছিল এক সময় সমতট রাজ্যের রাজধানী। এখানে বৌদ্ধ মঠও ছিল। কিন্তু কাল প্রবাহে ধবংশ হয়ে গিয়েছিল তার অনেক কিছুই। 

মুড়লী থেকে নতুন কালেক্টর ভবনে প্রশাসনের সমস্ত কর্মকর্তারা চলে আসেন ১৮০১ সালে। ওটিই ছিল যশোরের প্রথম কালেক্টর ভবন। নির্মিত হয় ১৮০১ সালে। উল্লেখ্য বর্তমানে যেটি কালেক্টরেট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। পুরানো কালেক্টরেট যেখানে স্থাপিত হয় তার নাম ছিল সাহেবগঞ্জ। এখন অবশ্য ওই এলাকার নাম পুরাতন কসবা। আর সেই কালেক্টরেট পরে জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কালেক্টর ভবনে এসেই ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন। এই ভবনেরই একটি কক্ষে ছিল তাঁর কার্যালয়।

সে সময় যশোরের সাথে কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্গম। রেল লাইন বসেনি। নৌকা পথে যশোরে আসতে ব্যয় হতো তিন থেকে চার দিন। যদিও কলকাতা থেকে যশোরের দুরত্ব মাত্র ১শ’ ১০ কিলোমিটার। কিন্তু এই এলাকার নদী গুলোর অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণবাহী। অথচ যশোর থেকে কলকাতা সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে। ভাগীরথী, আপার ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ ও লোয়ার ভৈরব দিয়ে যশোরে আসতে হতো। আবার দক্ষিণে সুন্দরবন ঘেষেও কলকাতার সাথে যশোরের নদী পথে যোগাযোগ ছিল। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নৌকা ছাড়াও ব্যবহার করতেন পালকী। যশোর থেকে তখন কলকাতা পর্যন্ত যশোরের কালীপোদ্দারের একক ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে একটি কাঁচা সড়ক। আজ আজকের প্রখ্যাত যশোর রোড নামে পরিচিত।

বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণত কলকাতা থেকে যশোরে যাতায়াত করতেন পালকীতে। যশোর শহরে পুরানো ঐতিহ্য থাকলেও তখন তা লুপ্ত। শহরের চারপাশে ঘনজঙ্গল। খানা-খন্দে মশককুল বংশ বিস্তার করে। ম্যালেরিয়ায় হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর শহর জন মানব শুণ্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল পত্রে যা জানা যায়-তাতে দেখা যায়, প্রথম প্রথম যশোর শহর বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে অসহ্য ঠেকত। তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ভয়ে ভীত থাকতেন। কিছু দিন পর এই শহর তাঁর ভাল লেগে যায়। এখানে তার পরিচয় ঘটে ‘নীলদপর্ন’ নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সাথে। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন যশোর ডিভিশনের পোষ্ট অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। দু’জন ‘প্রভাকর’ ও ‘সাধুরঞ্জন’ পত্রিকা সূত্রে একে অপরের পরিচিত ছিলেন। তবে চাক্ষুশ সাক্ষাৎ ঘটেনি। যশোরে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হয়। 



১৮৫৪ সালে যশোরে স্থাপিত হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরির সাথে খেলাধুলার ব্যবস্থাও ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এই লাইব্রেরিতে যেতেন নিয়মিত। যশোর থাকাকালীন ম্যালেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে মানুষজনকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতেও তিনি সচেস্ট হন। যশোরে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের ব্যাক্তিগত একটি শোকের অধ্যায় যুক্ত হয়। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর পাশের গাঁয়ের এক পঞ্চমবর্ষীয় কন্যাকে বিয়ে করেন। তখন বঙ্কিম বাবুর বয়স মাত্র এগারো। তাঁর স্ত্রীর বয়স যখন পনের তখন বঙ্কিম বাবু তাকে যশোরে তাঁর কর্মস্থলে নিয়ে আসেন। তখন বঙ্কিম বাবুর বয়স বাইশ। যশোরে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েক দিন রোগ ভোগের পর মারা যান তাঁর স্ত্রী। বঙ্কিম বাবুর দাম্পত্য জীবন কার্যত যশোরেই শুরু হয় এবং তা ছিল মাত্র এক বছরের। এই বিয়োগযন্ত্রণা বঙ্কিম বাবুকে দারুণ পীড়িত করেছিল। তিনি লিখেছিলেন ‘মনে করি কাঁদিব না রব অন্ধকারে/ আপনি নয়ন তবু ঝরে ধারে ধারে/ গোপনে কাঁদিব প্রাণ সকলি আঁধার/ জীবন একই স্রোতে চলিবে আমার।’

বঙ্কিম বাবুর স্ত্রীর নাম ছিল মোহিনী দেবী। তিনি তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে আরও লেখেন-‘কেন কাঁদিব না শখে, কেন ভাবিব না/ সে কম মোহিনী মূর্তি নয়নরঞ্জন/তুমি কি জানিবে হায়, কতেক বৎসর আজ/ কতসুখ কত আশা দিয়া বিসর্জন/ পাগলের মত আহা বেড়াইয়াছ ছুটি ছুটি/ তীব্র হলাহল বুকে করিয়া ধারণ/ফেটেছে হৃদয় তবু ফোটেনি নয়ন। ১৮৬০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্কিম চন্দ্র যশোরে ছিলেন। এ সময় সর্বত্র নীলকরদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। এ সংক্রান্ত ঘটনার বিভিন্ন তদন্তে তিনি কৃষকদের আনুকুল্য দেখাতেন। এ জন্য নীলকররা তাঁকে প্রাণহানির হুমকিও দিয়েছিল। যশোর থেকে বদলী হয়ে যান মেদিনীপুর জেলার নাগোয়াতে। সেখান থেকে পুনরায় আবার তাঁকে যশোরে বদলী করা হয়।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted