রাশানরা তৈমুর লংয়ের কফিন খুলে নিশ্চিত হয়েছিলো এটি তারই কবর, তার একটি পা খোঁড়া আর একটি হাতের কব্জি পর্যন্ত নেই।

রাশানরা তৈমুর লংয়ের কফিন খুলে নিশ্চিত হয়েছিলো এটি তারই কবর, তার একটি পা খোঁড়া আর একটি হাতের কব্জি পর্যন্ত নেই। 
কাকতালীয়ভাবে এটা পড়তে পড়তে গুগল আমাকে একটি সার্চে ‘বাবুরনামা’ পিডিএফ ই-বুক সামনে এনে দেখালো! 
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি সম্রাট বাবুরের এই আত্মজীবনী ডাউনলোড করে পড়তে পড়তে মনে হলো এটা বিশ্লেষণ করা জরুরী বাবুর ভারত আক্রমন করে লুন্ঠন করে তার পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত রাজ্য ‘ফারগানা’ ফিরে গেলে কি এমন ক্ষতি ছিলো? তৈমুর লং, চেঙ্গিস খান উনারা কেউ বিদেশে সাম্রাজ্য স্থাপন করেননি। লুট করেছেন, সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন। 
বাবুর নামার শুরুতে বাবুর লিখেছেন, ফারগানার গাছপালা ফলমূল আর পর্বত্রের সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায় করে তিন-চার হাজার মানুষের পরিচালনা সম্ভব ছিলো। 
কিন্তু ভারতের দৌলত সে তো রূপকথার মত। বাবুরের মত যারা ভারতে থেকে গিয়েছিলো তারাও হাতি ঘোড়া বোঝাই করে রত্ম ভান্ডার উপঢৌকন পাঠিয়েছিলো নিজ দেশে। সুলতান মাহমুদ, তৈমুর লং-এর মত উজবেক স্থানে বাবুর ভারতের সম্পদ পাঠিয়েছিলো।

চেঙ্গিস খান ‘শামান’ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তিনি কখনোই অন্যের ধর্মের উপর অবমাননা করেননি। ধর্মান্তরিত করেননি। 
কোন মূর্তি ভাঙ্গেননি। বিশাল বিশাল বুদ্ধমূর্তি দেখেও চেঙ্গিস সেগুলো ভাঙ্গেননি। আলেকজান্দারও তাই। সেকালের সমরনীতিতে যা যা করা স্বাভাবিক ছিলো, লুটতরাজ, দাস, ধর্ষণ সবই করেছিলেন অবশ্য। 
জাপান কোরিয়াসহ এশিয়ার মঙ্গলীয় চেহারার মানুষজনগুলি চেঙ্গিস খান বাহিনীর শুক্রাণুর ফলাফল। আফগান ও পাকিস্তানের কিছু জনগোষ্ঠির সুন্দর সুন্দর লম্বা নাক খাড়া ফর্সা মেয়ে পুরুষদের পিছনে গ্রীক সৈনিকদের শুক্রাণুই দায়ী। 
পারস্য সম্রাট নাদির শাহ, ভারতের মুঘল সম্রাট ওরাঙ্গজেব, আফগান সম্রাট আবদুর রহমান কামান দেগে বুদ্ধমূর্তিগুলি ভেঙ্গেছিলো। 
দেখা যাচ্ছে ইতিহাসের মুসলিম শাসকরাই অন্যের বিশ্বাসের মূর্তি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পৈশাচিক আনন্দ পেতো। শুধমাত্র সোমনাথ মন্দির আক্রমন করার কারণে মুসলমানদের কাছে গজনির সুলতান মাহমুদ একজন বীর মুসলমান! 
পাকিস্তানের স্কুল পাঠ্যে মাহমুদের সোমনাথ মন্দির লুটকে বীরত্বপূর্ণ মুসলমান কীর্তি হিসেবে পড়ানো হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস বইতেও সুলতান মাহমুদের মন্দির লুঠকে হিন্দু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি বিজয় হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয় সকলেই মনে করত এই মন্দির জাগ্রত দেবতার মন্দির। একে কেউ হামলা করলে তার অনিষ্ঠ হবে। কিন্তু মাহমুদ সেসব কথায় কান না দিয়ে সোমনাথ লুন্ঠন করে বীরদর্পে চলে যায়…।

ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিজস্ব বলতে তো কিছু নেই। তৈমুরের মত একটা খুনি, বাবুরের মত চরম হিন্দু বিরোধী, বৌদ্ধ বিরোধী খ্রিস্টান বিরোধী উজবেকই তাই তাদের ইতিহাস। 
বাঙালি মুসলমানদেরও কোন নিজেদের ইতিহাস নেই। যে কারণে বখতিয়ার খিলজিকেই ওরা নিজেদের ইতিহাস মনে করে। ‘হিন্দুকুশ’ পর্বতমালা নামের যে স্থানের কথা আমরা জানি আফগান ও পাকিস্তান সীমান্তে, এটি ছিলো মাহমুদ, তৈমুর সহ বহিরাগত লুটেরাদের ভারত থেকে ধনসম্পদ ও হিন্দ বৌদ্ধদের দাস করে নিয়ে যাওয়ার রুট। পাহাড়ী বৈরী পরিবেশে এইসব সদ্য দাস হওয়া হতভাগ্যদের অনেকেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এই পথেই মরে পড়ে থাকত। 
পার্সি শব্দ ‘কুশ’ অর্থ মেরে ফেলা। অর্থ্যাত হিন্দুদের মেরে ফেলা বুঝাতে ‘হিন্দুকুশ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা স্থানটির নামকরণ হিসেবে টিকে গেছে। এইসব ইতিহাস বলতে গেলেই হিন্দু কমিউনিস্টদের কাছে আমি আরএসএস র’ এজেন্ট! মুঘলদের সাম্রাজ্য বৈচিত্রময় সন্দেহ নেই। বাবুর ভারতে জিহাদের কথা তার সৈনিকদের বলেছিলেন। এদিকে তার বংশধর হুমায়ুন আকবর সেলিম পর্যন্ত আমরা একদমই ভিন্ন শাসকদের দেথতে পাই। 
আকবর তো একদম রাজপুত বিশ্বাস মত কপালে চন্দন টন্দন দিয়ে যুদ্ধে যেত যেটা যোধাবাঈ আকবরের প্রতিটি যুদ্ধের আগে আনুষ্ঠানিকতা করে দিতো। 
সেলিম মনে হয় অনেকখানি খ্রিস্টীয় মনোভাবের ছিলো কারণ সে গলায় ক্রুশ পরিধান করত। আকবর তো তার রান্নাঘরে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করে পাঁঠার মাংস ঢুকিয়েছিলেন। কিন্তু ওরাঙ্গজেব যদি ইসলামিক সাম্রাজ্য না চালিয়ে থাকে তো কেন সে হিন্দুদের উপর ‘জিজিয়ার কর’ চাপিয়েছিলো? জিজিয়া কর তো কুরআনের আইন যা খিলাফতে কাফেরদের জন্য প্রজয্য।

তৈমুর জীবনে একশো সত্তর লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলো আর তার চেয়ে দ্বিগুণ মানুষকে দাস বানিয়েছিলো। 
বাবুর আত্মজীবনীতে দিল্লিতে ইব্রাহিম লোদীর বানিয়েকে কচুকাটা করে লোদী মুন্ডু ফেলে দেয়ার কাহিনী জানিয়েছেন। কাফের হিন্দুদের লাশ যত্রতন্ত্র পড়ে থাকার কথা বলেছেন। 
বাবুর পুরো শহর ধ্বংস করে ফেলেছিলেন লুট করতে করতে। এটা একটা বিশেষ ব্যাপার যে প্রাচীন ভারত বলতে আমরা যা বুঝি সেখানে যুদ্ধ কিন্তু এরকম ছিলো না। 
মহাভারতের মত যুদ্ধ তো ভারতে দ্বিতীয় বার ঘটেনি। সেই যুদ্ধে বেসমারিকদের কি হত্যা করা হয়েছিলো? যুদ্ধের ময়দান কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষের লোকজন মারা গিয়েছিলো। বলা হয় পান্ডব ও কৈরবদের বংশে বিবধা নারীদের আহাজারীতে খোদ পান্ডবরাই সহ্য করতে না পেরে কানে হাত চাপা দিয়ে ফের দেশান্তরিত হয়েছিলো। 
কিন্তু তৈমুর বাবুররা একটা নগরে ঢুকে নির্বিচারে মানুষের গলা কাটত। নারীদের ধর্ষণ করত। লুট করত। দাস বানাতো। ধর্মান্তরিত করত। আশ্চর্য সেই জোর করে ধর্মান্তরিতদের বংশধররাই এখন সবচেয়ে বড় হিন্দু কাফের মূর্তি বিরোধী! গজওয়াতুল হিন্দের একেকজন সৈনিক! আমি কি মিথ্যা বললাম?

তৈমুর লং বা সুলতান মাহমুদ ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করলে আজকে তাদের মুসলিম মহান বীর হিসেবে ভারতের হিন্দু কমিউনিস্টরা লালন করতো এবং তাদের খুন লুটপাট ও দাস বানানো নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তাদেরকে মুসলিমফোবিক হিন্দুত্ববাদী ও তাদের বলা ইতিহাসকে পাশ্চত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বানোয়াট ইতিহাস বলে বাতিল করে দিতো। 
বাবুর দিল্লিতে যে খুনখারাবী করেছিলো সেসব নিয়ে কারোর মনে কোন ঘৃণা আছে? 
বাবুরকে নিয়ে কবি গোলাম মুস্তফা কবিতা লিখলেন ‘জীবনবিনিময়’। 
সেখানে দেখানো হলো বাবুর পুত্র হুমায়নের জীবনের বদলে আল্লার কাছে নিজের জীবন বিনিময়ের আর্জি করলেন এবং তার দোয়া কবুল হলো ফলে হুমায়ুন সেরে উঠল আর বাবুর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে মারা গেলো…। যেন কোন অলিআল্লার জীবন পড়ছি আর কী! আসল সত্য হচ্ছে বাবুর মারা যায় ইব্রাহিম লোদীর মায়ের দেয়া বিষ প্রয়োগে। 
সেই বিষেই বাবুর ধীরে ধীরে মারা যায়। 
কিন্তু তাকে মহান এক পিতা ও শাসক বানাতে গোলাম মুস্তফা কেন ব্যস্ত হয়েছে? এই গোলাম মুস্তফা নিশ্চিত করেই কোন হিন্দু দাসের বংশধর যে দাশ ইসলাম কবুল করেছিলো একদা! 
আজ তারই বংশধর তার গোটা কবি জীবন নষ্ট করে গেছেন মুসলিম জাহানের হতগৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখে দেখে! বাবুর এত মদ খেতো যে নিজেই নিজের অকালে বুড়ো হওয়ার জন্য মদকে দায়ী করেছিলো। 
তার শিয়া বিদ্বেষ, হিন্দু বৌদ্ধ বিদ্বেষ তিনি গোপন করেননি। 
কী এমন ক্ষতি হতো যদি বাবুর লুটপাট করে তার দেশে ফিরে যেতো! সুলতান মাহমদু বা তৈমুর লংয়ের মত যদি নিজ দেশে ফিরে যেতো তাহলে ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। 
আফগান তুর্কি জাতিদের এই দেশে সাম্রাজ্য স্থাপন না হয়ে যদি চেঙ্গিস খানের হাত ধরে হতো তাহলেও কি ভিন্ন কিছু হতো? এই কথাটা প্রায়ই ভাবি। 
চেঙ্গিস মধ্যযুগের সবচেয়ে সহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। চেঙ্গিস খানের ভারতে ‘মুসলমান’ নামের কোন প্লাস্টিকের জন্ম হতো না যে কিনা ভারতবের্ষর মাটিতে সাতশো বছর কাটিয়েও মিশে যেতে পারল না। এখনো সে উজবেক, আফগান, তুর্কি আরবীদের স্বরে কথা বলে…। 
চীনের মত দেশে আহমেদ শাহ আবদালি গেলো তার সৈন্য নিয়ে, মেরেকেটে ধর্মান্তর করলো উইঘুরদের। সেই ধর্মান্তরিতদের বংশধররাই এখন চীনের জন্য মাথাব্যথার কারণ! পুরো চীনের অখন্ডতা ধরে টান মেরেছে উইঘুর মুসলমানরা। এখন এটা বলা কি সঙ্গত নয় যে সেখানে আহমেদ শাহ আবদালীর মত মুসলিম কেউ না গেলে ইতিহাস অন্যরকম হতো? চীনে তো অতীশ দীপঙ্করও গিয়েছিলো বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে। তাতে তো কোন সমস্যা হয়নি।

বাবুর সম্পর্কে গুরুনানক বলেছিলেন, সে একটা জীবন্ত যম! তার অত্যাচার নির্যাতন নিষ্ঠুরতা থামাতে কেন ঈশ্বর পারছেন না সে আক্ষেপ নানক করেছিলেন। এই ইতিহাস কেন বলা যাবে না? 
ভারতের মুসলিম শাসনের সুখ্যাতি করা কমিউনিস্ট ও ইসলামিস্টরা এসব ইতিহাস তুলে ধরলেই কেন সেটাকে ‘মুসলিমফোবিক’ বলবে? কিন্তু বাবুরনামাতে নিজের আত্মজীবনী হলেও নিজেকে মহাপুরুষ বানিয়ে বাবুর গালগল্প লিখে রাখতে বলেননি তার জন্য তার ধন্যবাদ প্রাপ্য। নিজে সমকামী ছিলেন তা লিখতে কোন ভয় পাননি। তার হাতে প্রচুর মানুষ খুন হওয়া স্বীকার করেছেন। 
তার হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ শিয়া বিদ্বেষ নিয়েও রাখঢাগ করেননি। 
এগুলি ইতিহাসের সোর্স। ইতিহাস পড়ে সত্যটাকে মাথা খাটিয়ে অনুমান করে নিতে হয়। 
লেখার শুরুতে তৈমুর লংয়ের কফিন খুলে রাশানদের পরীক্ষা করে তৈমুরকে নিশ্চিত হওয়ার কথা লিখেছি। সোভিয়েত রাশিয়া নাস্তিক ছিলো বলেই এগুলো করতে সাহস পেয়েছিলো। যেসব মহাপুরুষ আর বীরদের এখনো সমাধি কবরের কথা আমর জানি, তার সবগুলি খুঁড়ে ভেতরে কোন হাড় কংকাল থাকলে তার বের করে কার্বন ডেটিং টেস্ট করে বের করা উচিত আসলেই এখানে যে শুয়ে আছে সে কে? তার পরিচয়, তার গড়ন, তার বংশ, কোন যুগের মানুষ সব জানার অধিকার আজকের যুগের মানুষের আছে। মিথ আর গালগল্প দূর করে যতটা সম্ভব রক্তমাংসের ইতিহাস বের করা উচিত…।

(সহায়তা নিয়েছি: The Babur-nama in English translated by: ANNETTE SUSANNAH BEVERIDGE/কাফি হাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি, মলয় রায়চৌধুরী।)

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted