আমাদের চার্বাক দর্শন

আমাদের চার্বাক দর্শন

ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দর্শন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই পঠিত হয়। তবে এতো আগে যে দেশের মানুষ এমন উন্নত ভাবনা ভাবতে পেরেছিল সে জাতি কিভাবে আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হল সেটাই ভাবনার বিষয়। তারা এক অন্ধকার থেকে ঝাপিয়ে পড়েছে আরেক অন্ধকারে। ভারতে প্রথম বস্তুবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল এই মতবাদে। চার্বাক দর্শন ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুবাদী দর্শন। বৈদিক সাহিত্যে যে ছয়টি শ্রেণীর নাস্তিকের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে চার্বাক একটি। অন্য ৫টি হল— মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রান্তিক, বৈভাষিক ও দিগম্বর। এমন শক্তিশালী একটা মতাদর্শের টিকে না থাকা বা অগ্রগতি না হওয়া বিস্ময়কর। আমাদের পশ্চাৎপদতা আর বিজ্ঞানবিমুখতার সেটাই প্রধান কারণ। 

চার্বাক দর্শন হল নিরীশ্বরবাদী ও অনাত্মাবাদী দর্শন। চার্বাক দর্শন প্রায় আড়াই হাজার বছরের বেশি প্রাচীন। চার্বাক দর্শন আধ্যাত্মবাদে বা কোন অলৌকিক প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী ছিল না। তারা মনে করতো প্রমাণই জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য। বিরুদ্ধবাদীরা বলেছিল, দেবগুরু বৃহস্পতি বিষয়সুখে প্ররোচনাত্মক বিভ্রান্তিকর শাস্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে অসুরদের ভুল পথে চালিত করার কাজে বতী হন। অথচ আজ আড়াই হাজার বছর পরে এসে মানুষ বুঝতে পারে, বৃহস্পতি ভুল বলেননি। তাদের বিরুদ্ধে বলা খারাপটা থেকেই যেহেতু তাদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই কিছুতো অতিরঞ্জিত ছিলই। বাকিগুলোকে আজকের বস্তুবাদী দর্শনের সাথে মেলাতে পারি। জাগতিক সুখভোগ জীবনের চরম লক্ষ্য কিনা অথবা জাগতিক সুখভোগ আসলে কি তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। একজন মানবিক মানুষের সুখ পরার্থেও হতে পারে আবার একজন উগ্রপন্থী মানুষের সুখ মানুষ খুনেও হতে পারে। তবে চার্বাকরা সাধারণ ও মানবিক মানুষের কথাই বলেছেন। ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও’ এর দ্বারা শুধু ভোগ করা ছাড়াও বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা হতে পারে।

চার্বাকদের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, তাদের জগত ইন্দ্রিয়গোচরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ বস্তুজ জ্ঞানই চার্বাকগোষ্ঠী প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তারা জানতেন জাগতিক বস্তুনিচয়ের সত্যাসত্য নির্ণয়ের মান বাস্তবিকপক্ষে কখনোই ত্রুটিমুক্ত না হওয়ার দরুন প্রমাণ ও প্রমেয় সম্বন্ধে ধারণাও ত্রুটিমুক্ত হয় না। আবার ন্যায় দর্শন দ্বারা স্বীকৃত অনুমানের দ্বারা প্রমাণকে চার্বাক মতে অনুমোদন করা হয়নি। অনুমানলব্ধ জ্ঞানের হেতু বা সাধনের সঙ্গে অনুমান বা সাধ্যের সম্পর্ক বা ব্যাপ্তিকে চার্বাকবাদী দার্শনিকেরা ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে অভ্রান্ত ব্যাপ্তিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রত্যক্ষের সাহায্যে সম্ভব নয়। এর প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেশ, কাল ও স্বভাবের ব্যবধানকে এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে। এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুজগত ও তার ধর্ম প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, তাই অনুমান দ্বারা ব্যাপ্তিজ্ঞানকে চিরকাল ধরে নেয়া যায় না। অনুমান সম্ভাবনার আভাষ মাত্র।

আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি যা ব্যক্তির ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাসের ওপর অধিকাংশ সময়ে নির্ভরশীল হওয়ায় তা চার্বাক মতে গ্রাহ্য নয়। প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা চারে সীমিত রাখেন। এগুলি হল ক্ষিতি বা মাটি, অপ বা জল, তেজ বা আগুন ও মরুৎ বা বায়ু। এই চার থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি, ধ্বংসে সবই আবার এই চার ভূতেই বিলীন হয়। এজন্য তাদের ভূতবাদীও বলা হয়। ব্যোম বা আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে একে জগতের মূল উপাদানের মধ্যে তাঁরা ধরেন নি। তাই জগত স্রষ্টারুপী ঈশ্বরের অনুমান করার কোন প্রয়োজন নাই। ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী এই মতবাদকে লক্ষ্য করে তীব্র আক্রমণ করে আসছেন আড়াই হাজার বছর ধরেই। তারা এহেন নিন্দাবাক্য নেই যা দিয়ে আঘাত হানেন নি চার্বাকদের। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। সেই গালিগালাজের মধ্যেও যে অমৃত থেকে গিয়েছিল।

আত্মা অবিনশ্বর হলে তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ-নরক ভোগের প্রশ্ন, জন্মান্তর পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি প্রশ্ন। আত্মা নশ্বর হলে এইসব প্রশ্নই অর্থহীন হয়ে যায়। চার্বাক বা লোকায়ত-দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলো তৎকালীন সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। চার্বাক দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা 'অমর' কি 'মরণশীল' এই নিয়ে। লোকায়ত চার্বাক দর্শন মতে- কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি। চার্বাকগণ বলেন, আত্মারই যেখানে কোন সত্তা নাই সেখানে আত্মার মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর মাত্র। তাঁদের মতে ইন্দ্রিয়-সুখই মানুষের পরম কল্যান। তাই এই ইন্দ্রিয়-সুখই তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত। চার্বাকগণ আরো বলেন, অতীত চলে গেছে, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত, কেবল বর্তমান মানুষের আয়ত্বে আছে। সুতরাং বর্তমান জীবনে মানুষ যে উপায়েই হোক, যত বেশি সুখ করতে পারে তা করা উচিত। দুঃখমিশ্রিত বলে বা অন্য কোন কারণে বর্তমান সুখকে বিসর্জন দেয়া মানুষের পক্ষে মূর্খতা ।

প্রমাণের জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিল। অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে 'পূর্ব প্রত্যক্ষ' অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখলে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তারা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, ঋষি নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে যার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ বা আধ্যাত্মবিদ্যা। 

আজও যারা বলেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং আধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং আধ্যাত্মতত্ত্বই 'পরম বিজ্ঞান', তারা এটা ভুলে যান— প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতেও পা রাখাই সম্ভব নয়। আর আধ্যাত্মতত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে 'আত্মা অমর' এই বিশ্বাসের উপর, যা বিজ্ঞান-বিরোধী বিশ্বাস। লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানের উপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিল- চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র। আর 'আধ্যাত্মতত্ত্ব' বা আত্মার অবিনশ্বরতার উপর নির্ভর করে ওঠা তত্ত্ব বিজ্ঞানের লক্ষণ নয়, অজ্ঞানের লক্ষণ।

ভাববাদীরা বলতেন, অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেয়া উচিৎ- চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। ভাববাদীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলতেন— জড় বা অচেতন পদার্থে গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে? লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছিল- মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরণের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আবার যেমন– পান, সুপারি ও চুন এই তিনটি বস্তুর ভিতর কোনটিরই লাল রং নেই। তবু এই তিনটি বস্তুকে একসাথে চর্বন করলে লাল রং দেখা যায়। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা। এমন যুক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারা যায় না। তবুও তারা বলবেন, চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে চার্বাক দর্শনটি হয়তো টিকে যেতে পারতো। আজ বৈজ্ঞানিকভাবেই বলা হয়, দেহ কোষের সমন্বিত কাজের ফলে সচল থাকে। আর চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া। কোষ নিয়ে ওই সময়ে চার্বাকদের ধারণা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এমনকি বিবর্তনবাদ নিয়েও তাদের মধ্যে ধারণা ছিল না। তারপরেও লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক যুক্তি দেখান হয়েছে, যেসব যুক্তি ইউরোপীয়ান দার্শনিকরনাও অনেক পরে মানে দুই হাজার বছর পরে আয়ত্ব করেছেন।

চার্বাকদের প্রতি ব্রাহ্মণদের তীব্র বিদ্বেষের প্রধান কারণই ছিল যে, তাদের জীবিকা নিয়েই টান দিয়েছিল। চার্বাকরা বলতেন, ‘ব্রাহ্মণেরা তাদের জীবিকার তাগিদেই 'শ্রাদ্ধ' নামক নিয়ম চালু করেছে। পয়সা কামানোর অজুহাত ছাড়া শ্রাদ্ধ আর কিছুই নয়। জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে পশুবলি দিলে যদি পশু স্বর্গেই গিয়ে থাকে, তাহলে পিতাকে স্বর্গে পাঠানোর জন্য তাকে ধরে-বেধে যজ্ঞে বলি দিলেই তো হয়, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দরকার কী? ব্রাহ্মণেরা পশুহত্যা মহাপাপ বলেছিলেন। তারা হিন্দুদের নিরামিষ ভোজনের বিধান দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা মাংস খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেন নি। তাই ব্রাহ্মণদের আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও যজ্ঞে উৎসর্গকৃত পশুর মাংস তারা খেতেই পারতেন। তাই তারা যজ্ঞে পশুবলির বিধান দেন। শ্রাদ্ধকর্মের ফলে যদি মৃতের তৃপ্তি হয় তাহলে নেভা প্রদীপে তেল দিলেও আগুন জ্বলা উচিৎ। বিদেশে থাকা পরিবারের সদস্যের জন্য দেশে বসে রান্না করা বৃথা, ঠিক তেমনি মৃতের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করাও বৃথা। আত্মার কি পাকস্থলী আছে? যদি না থাকে তাহলে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করলে সে খাবে কিভাবে আবার হজম করবেই বা কিভাবে? চার্বাকরা আরো মনে করতেন, মানুষের বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন। পরজন্ম বলে কোন কিছু নেই। কারণ পরজন্মের অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই। সুতরাং মৃতুর পরেও মানুষকে তার কুকর্মের জন্য দুঃখভোগ এবং সুকাজের জন্য মানুষ সুখভোগ করবে – এইসকল কথা অর্থহীন। ভগবানের কাহিনী পৌরনিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং পরজন্মে সুখভোগের জন্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য তাঁর পূজা অর্চনা করা বোকামী মাত্র। চার্বাক আরও বলেছেন ভন্ড, ধুর্ত, নিশাচর তারাই বেদের কর্তা। বেদও এই প্রতারক পুরোহিতদের সৃষ্টি। সুতরাং চার্বাকগণের মতে বেদকে বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয়।

যে শোষিত সাধারণ মানুষদের উপকারের জন্য চার্বাক দর্শন আত্মাবাদ ও ঈশ্বরবাদকে শানিত যুক্তিতে খণ্ডন করেছিল, সেই শোষিত সাধারণ মানুষই একসময় চার্বাক দর্শনকে এক নীতিহীন দর্শন বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি 'চার্বাক' শব্দটিকে লোকে গালাগাল বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। ব্রাহ্মণরা হয়তো তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমনই করেছিলেন। ফলে চার্বাক মতাদর্শের লোকেরা হারিয়ে গিয়েছিল বা ব্রাহ্ম ধর্মে বা বৌদ্ধ ধর্মে মিলিয়ে গিয়েছিল। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের কিছু চিন্তাবিদ কী অসাধারণ বিপ্লবাত্মক চিন্তায় পৌঁছেছিলেন- সব কিছুই মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত এবং মৃত্যুর পর মৃতদেহ মৌলিক পদার্থে বিলীন হয়ে যায়। দেহাতীত আত্মা বলে কিছু নেই। এমন চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সম্ভবত মৃত্যুর পর দেহের পরিণতি দেখে, অস্ত্র ও তৈজস্পত্রের ভঙ্গুরতা দেখে। মৃতদেহকে পচে-গলে মাটিতে মিশে যেতে দেখে, পুড়ে ছাই হয়ে শেষ হয়ে যেতে দেখে। তাদের এসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছিল। 

সে সময়ের প্রেক্ষিতে চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বকে অবশ্যই অসাধারণ বলতেই হয়। বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। এই মতবাদ অনুসারে অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা এবং মন, প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি জগতের সব বস্তুই জড় পদার্থ হতে তৈরী। এই মতের অনুসারীরা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। আমরা তাদের সম্পর্কে ধারণা পাই মূলত তাদের বিরুদ্ধ মতের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকেই। বেদ, রামায়ন-মহাভারত এবং বৌদ্ধ দর্শনে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া ভারতের অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় এই চার্বাক দর্শনের মত খন্ডন করতে গিয়ে যে ব্যাখা দিয়েছেন সেখান থেকেও চার্বাক দর্শন ও এর প্রাচীনত্বের প্রমান পাওয়া যায়। চার্বাক দর্শনের সিদ্ধান্তগুলি দর্শনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও জড়বাদ একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ বলে চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায়। সাধারণ মানুষের কাম্য হলো জাগতিক সুখভোগ, এই দর্শনের মতেও জীবনের চরম লক্ষ্য সুখভোগ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাধারণ লোকের চিন্তা ও ভাবধারা এই দর্শন তুলে ধরেছে। এ কারণে এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন ।

চার্বাকরা হারিয়ে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া মতাদর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় দর্শনকে ব্যাখ্যা করতে গেলেও চার্বাক দর্শনকে গুরুত্ব দিতেই হয়। এই দর্শন মূল্যহীন নয় এবং নিন্দনীয়ও নয় । চার্বাক দর্শন কুসংষ্কার, অন্ধবিশ্বাস ও অর্থহীন প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল। এই বিদ্রোহ ব্রাহ্মণ্যবাদের চাতুবর্ণ প্রথার ভিত্তি উৎপাটিত করে সাম্যতার দর্শনের ভিত্তি রচনা করতে পারত। এই দর্শন সাধারণ মানুষকে আত্ম-নির্ভরতার পথ দেখিয়েছিল। দর্শনে যে অবিচারিত তত্ব ও মতের স্থান নেই চার্বাক দর্শন তা পতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রকে চার্বাক দর্শন কঠোর আঘাত করেছিল। টিকে না থাকলেও এখানেই এ দর্শনের সার্থকতা এবং ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক হিসেবে আলোচনাতেই থাকবে।

তথ্যসূত্র:
১। ভারতীয় দর্শন- ড. দেবব্রত সেন
২। চার্বাকের খোঁজে- রণদীপম বসু

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted