'সুষুপ্ত পাঠক' ছদ্মনামে কোনো একজনের লেখা একটি চিন্তা-উদ্দীপক প্রবন্ধ, যা ভারতের সাম্প্রতিক বাতাবরণে হয়তো 'ঘোর সাম্প্রদায়িক' বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে। এই বাতাবরণটি তৈরী করেছে মোহনদাস গান্ধী, এর সঙ্গে পা মিলিয়েছে বামপন্থীরা। এই বাতাবরণ বস্তুত নিজেদের ধোঁকা দেওয়া কিছু রাজনৈতিক ন্যাকামি ছাড়া আর কিছু নয়, এবং এর বলি হতে যাচ্ছে সর্বাগ্রে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা। কিন্তু যারা নিজেরাই নিজেদের ধোঁকা দেয় তাদের কপালে আর কি থাকতে পারে?
"পাকিস্তানী ক্রিকেটার রানা নাভেদুল হাসান বলেছেন, বিশ্বকাপে 'ভারত পাকিস্তান ম্যাচে' ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তান সাপোর্ট করবে! আমদাবাদ ও হায়দারাবাদে দুটি সিরিজ খেলার স্মৃতি মনে করে রানা জানিয়েছেন, ভারতীয় মুসলমানরা তাদেরকে সমর্থন করে থাকে।
রানা নাভেদুল হাসান পাকিস্তানের হয়ে ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি। তবে এ জন্য তার কথার কোন মূল্য নেই তা নয়। তিনি ক্রিকেট সম্পকৃত কোন কথা বলেননি যার জন্য তাকে ওয়াশিম আকরাম বা ওয়াকার ইউনুস হতে হবে। তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন যা ভারতে অসমাপ্ত রয়ে গেছে। কি সে অসমাপ্ত বিষয়? নাভেদুল হাসানের দাবী সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে হলেও তার কথাটা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে কিছু ক্লেদাক্ত বের হবে যা আমাদের উপমহাদেশের জন্য এক চরম নগ্ন সত্য কিন্তু কেউ মুখে ফুটে সেটা স্বীকার করবে না।
ভারতীয় মুসলমানদের কথা একটু পরে বলি। আগে বাংলাদেশের মুসলমানদের কথা বলা উচিত তাহলে পরিস্কার হয়ে যাবে সব। বাংলাদেশের মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাদেরকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। তারাই গণভোটে (সিলেট গণভোট) মুসলমানদের নিজস্ব দেশ ‘পাকিস্তানের পক্ষে’ গণজোয়ার এনেছিলো। যারা বলেন দেশভাগ সাধারণ হিন্দু মুসলমান চায়নি তারা স্বপ্নের ভেতর রসগোল্লা খান। পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিলো। তাই ভারতের মুসলমানদের বুঝতে হলে বাংলাদেশের মুসলমানদের আগে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশের মুসলমানদের কেন ভারত হারলে ঈদের খুশী লাগে? ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক কোন গণহত্যা যুদ্ধ কোন কিছুতে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়নি। সেটা হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে। তবু সাড়ে তিন বছরের মাথায় জুলফিকার আলী ভুট্ট বাংলাদেশ এলে, বা পাকিস্তান ক্রিকেট টিম স্বাধীনতার পর প্রথমবার ঢাকায় এলে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে তারা বিস্মিতই হয়ে যান। আশির দশক থেকে সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানরা সৌদি মুসলমানদের কাছে অপমানিত সম্বোধন লাভ করলেও তাদের সৌদি আরবের উপর এতটুকু ক্ষোভ নেই যেটা আছে ভারতের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের নারীদের গৃহপরিচারিকা হিসেবে সৌদি নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী করা হলেও এদেশের সৌদি বিরোধী কোন জনমানস তৈরি হয়নি। ফলে ভারতের প্রতি প্রচন্ড বিদ্বেষ ও পাকিস্তান সৌদিদের প্রকাশ্য অপমান অপকর্ম গণহত্যার মত দলিল থাকার পরও গভীর ভ্রাতৃত্বসুলভ দাসত্ব কোন নিরপেক্ষ অবস্থান নয়। এটাকে বলে ‘উম্মাহ’। আপনি মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড না হলে ‘মুসলিম উম্মাহ’ কোনদিনই পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। কোলকাতার কফি হাউসে বসে লেনিন ক্লাস নেওয়া ঝোলা কাঁধের বিপ্লবীও কোনদিনও বুঝতে পারবেন না ‘উম্মাহ’ কি বস্তু।
পাকিস্তানের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী একটা যুদ্ধ শেষেও যে চমৎকার সম্পর্ক বাংলাদেশের মানুষ নিজে থেকে তৈরি করেছে পাকিস্তানের প্রতি সেটাকেই মুসলমানরা 'উম্মাহ' বলে। এটা একটা জাতিগত নৈকট্য অনুভব করা। এই বিজ মুসলমানদের কোন দেশেই একটি অভিন্ন জাতি হতে দেয়নি।
চীন বার্মা ভারত কোথাও তারা স্থানীয় জাতিতে বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে বিশ্বাস করেনি। ফলে ভারতবর্ষ ভাগ করে মুসলমানদের জন্য দুটি দেশের (পাকিস্তান বাংলাদেশ) জন্ম হয়েছে। এই ‘উম্মাহ’ চেতনা থেকে বাঁচতে চীন বার্মা তাদের জাতিগত ঐক্য রক্ষার্থে মুসলমানদের কোথাও খেদিয়েছে কোথাও থেরাপি দিচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকাতে কেবল মুসলমানদেরই দেখবেন সন্ত্রাসের জন্য শিরোনাম হতে। এখানেও উম্মাহ চুলকানি প্রধান।
ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তান সাপোর্ট করা তাই অলীক বা অবাস্তব নয়। এটা কেন হয় সেটাই এতক্ষণ বললাম। পুরো পৃথিবীকে তারা মুসলিম ও অমুসলিম এই দুই ভাগে দেখে। তারা "মুসলিম বিশ্ব" বলে আলাদা মানচিত্রে বিশ্বাস করে। ভারতের মুসলমানরা শিক্ষা কালচারে এমন কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি যার জন্য তারা নিজেদের ভারতীয় হিসেবে গৌরব করবে।
নাভেদুল রানারা আসলে দেশভাগের সময় মুসলিম লীগের থেকে যাওয়া জনসমর্থনকে উশকাতে চায়। দেশভাগের সময় "মুসলমানদের আলাদা দেশ" হলেও ভারতে ও পাকিস্তান মুসলমান ও হিন্দুরা থেকে গেলো। এটা ভারতের জন্য বেশি সত্য। কারণ পাকিস্তানের পূর্ব অংশ থেকে হিন্দুরা ও পশ্চিম অংশ থেকে শিখরা উচ্ছেদ হয়। কিন্তু ভারতের মুসলমানরা সেখানেই থেকে যায় যারা একদা মুসলিম লীগ দর্শনের জন্য জান দিতে রাজি ছিলো।
ভারতীয় টিমে মোহাম্মদ সিরাজের মত খেলোয়াড় যিনি জাতীয় সংগীতের সময় আবেগে কেঁদে ফেলেন, কিংবা ইরফান পাঠানের মায়ের পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের সাম্প্রদায়িক উশকানির জবাবে প্রতিবাদের কথা মাথায় রেখেই আমি কথাগুলো লিখছি। এটি সিরাজদের মত তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা এমন একটি বিষয় যা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের বিষবৃক্ষ রাজনীতির কথা যার সমর্থক ভারতের মুসলিম কমিউনিটিতে বৃহত আকারে আজো রেয়ে গেছে। এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না।
কেন জনবিনিময় হলো না এই প্রশ্ন তোলা উচিত। তাহলে আজকে মুসলমানদের চরিত্র এতখানি কলংকিত হতো না। মুসলমানরা তাদের মুসলিম দেশের সাপোর্ট করবে এটাই স্বাভাবিক ছিলো। এখন ভারতে থেকে মুসলিম উম্মাহ চেতনা এপ্লাই করা, যে কোন অমুসলিম দেশে এটা এপ্লাই করে মুসলমানরা তাদের নিজ দেশে পরবাসী সাজতে হয়। “মুসলমান” যে কোন জাতি পরিচয় নয়- এটি ভারতের সেক্যুলার, বামপন্থী পন্ডিতরাও মুসলমানদের শেখাতে চান না। কারণ ‘মুসলিম লীগের’ একচেটিয়া ভোটটি তাদের দরকার!
আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা একসঙ্গে নামাজ পড়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া দুই দল সফরকালে কখনো দেখেন তারা একসঙ্গে রবিবার গির্জা গিয়ে প্রার্থনা করছে? তারা নামাজ পড়ার মত করে সিরিয়াস ধর্ম পালন করে না সেটা অন্য বিষয়। সেটা বাদেও খ্রিস্টান হিসেবে তারা কেউ ‘ইউনাইটেড’ মনে করে না। ভারতীয় মুসলমানরা বাংলাদেশ আফগানিস্তান পাকিস্তানের মত নিজেদের মুসলিম টিম থাকবে তেমন স্বপ্নই তো একদা দেখেছিলো। এটাই লাহোর প্রস্তাব। লাহোর প্রস্তাব মাটি ফুড়ে বের হয়নি। ইসলামের "দারুল ইসলাম" নামের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বাস থেকে তার জন্ম হয়েছিল। এসব কথা বলা মানে মুসলমানদের ভিলেন বানানো নয়। তাদের আত্মসমালোচনা তৈরি করা। আমি সেটাই করাতে চাই। সত্য না জানলে আত্মসমালোচনা করবে কিভাবে"?
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................