-জনাব আবদুল্লাহ ইবনে উবাই, স্বাগত জানাই আপনাকে। আমার সব সময় মনে হয়েছে আপনাকে না জানলে ইসলামকে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আপনাকে জানলে ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কেও পরিষ্কার একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
-ধন্যবাদ তোমাকে। বলো কী জানতে চাও।
-মদিনায় গোত্র যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপন করেছিলেন আপনি।
-হ্যাঁ। আমার নিজ গোত্র খাজরাজ যুগের পর যুগ বনু আউস গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ বিবাদে লিপ্ত ছিলো। আমি তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করি। ফলে দুই গোত্রই আমাকে তাদের প্রেসিডেন্ট বানানো মনস্থ করেছিলো।
-এই সময়ই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের নবী মুহাম্মদ মদিনায় আসেন?
-ঠিক তাই। আমরা তার কথা শুনছিলাম নতুন একটি ধর্ম প্রচার করছেন। মদিনায় ইহুদিদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একবার তারা আমাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছিলো। ঘনিষ্ঠতার কারণে ইহুদিদের মাধ্যমে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়ে। ফলে মদিনায় মুহাম্মদ আসার পর তার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। এমনকি অতশত না ভেবেই তাকে নবী বলে বিশ্বাস করে ইসলাম গ্রহণ করি।
-তখন তো আপনি মদিনার খুবই প্রভাবশালী নেতা। আপনি নিজেই তো মদিনাকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। তা না করে মুহাম্মদের মতো বিদেশিকে নেতা মানতে গেলেন কেন?
-শোনো, সেটা হচ্ছে ইসলামের বিজয়ের যুগ। মুহাম্মদের মধ্যে কিছু কারিশমা ছিলো যা তার দিকে মানুষকে অবনত করে ভক্ত বানিয়ে ফেলতো। প্রথম দিকে আমি নিজেই সেটা করেছি। ফলে তাকে নিজেদের রাজা মেনে নিতে কোন দ্বিধা হয়নি।
-মক্কা থেকে আসা এই শরণার্থীদের অবস্থা কেমন ছিলো তখন?
-এই তোমাদের দেশে আসা রোহিঙ্গাদের মতো! প্রথম দিকে তো আমরা জমিজমা দিয়ে, টাকা পয়সা, এমনকি নিজেদের বউ পর্যন্ত তাদের বিলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু দ্রুত মনে হচ্ছিলো খাল কেটে কুমির এনেছি! ঐ তোমরা এখন যেমন রোহিঙ্গাদের মনে করো আর কি।
-ইসলাম আপনাকে 'মুনাফিক' বা প্রতারক বলেছে। আপনাকে নিয়ে কুরআনে সুরা মুনাফিকুন, সুরা আল ইমরান ও সুরা তওবাতে নাম উল্লেখ না করেই আয়াত নামিয়ে স্পষ্টত 'ইসলামের শত্রু' বলা হয়েছে। এর কারণ কী?
-সাহেবদের মধ্যে একজন লেখক আছেন ইউলিয়াম মুর, তিনি লিখেছেন আমার সম্পর্কে- মুহাম্মদের রোষানলে পড়া লোকজনদের রক্ষা করতে গিয়ে আমি ইসলামের প্রথাগত ইতিহাসে ভিলেনে পরিণত হয়েছি। অথচ ইতিহাস পড়লেই জানা যায় আমি মানবাধিকার রক্ষায় সেই ১৪০০ বছর আগে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। বহু ইহুদি গোত্র আমার কারণে রক্ষা পেয়েছিলো। মদিনার কয়েকটি ইহুদি গোত্রের সকলকে হত্যার নির্দেশ আমি ঠেকিয়েছি। এগুলো অন্যায়? এর নাম প্রতারণা?
-কিন্তু আপনি মুহাম্মদের আড়ালে তার বদনাম করতেন।
-করতাম তো। সেটা তো মুহাম্মদও তার বন্ধু ওমর আবু বকরদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে করতো। সেটাও তো আমার আড়ালেই করা হতো। তার বেলায় এটাকে তুমি কী বলবে?
-মুহাম্মদের সঙ্গে প্রথম বড় বিবাদটা আপনার লাগে ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকা ইস্যুতে, তাই না? সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?
-মামুলি একটা ঘটনায় পুরো গ্রামবাসীকে হত্যা করার নির্দেশ ন্যূনতম মানবিকতা আছে এমন মানুষ মেনে নিতে পারে? ঘটনাটা কী হয়েছে শোনো, মদিনার একটা গয়নার দোকানে একটি মুসলিম মেয়ে কিছু কিনতে নাকি বন্ধক রাখতে গেছে জানি না। দোকানদার কার সঙ্গে লেনদেন করছে তা জানতে মেয়েটির মুখের কাপড় খুলতে বলে। কিন্তু মেয়েটি সেটা মানতে নারাজ। ইসলামের প্রচলিত কাহিনী মতে, এরপর দোকানের কোন কর্মচারী মেয়েটির পরনের কাপড়ের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বসার চেয়ারে আটকে দেয়। এতে মেয়েটি উঠতে গেলে কাপড় সরে যায়। খুবই অন্যায় কাজ হয়েছে কোন সন্দেহ নেই। এর জন্য বিচার জেলজরিমানার ব্যবস্থা আছে। তা না করে এইসব বিদেশি মুসলমানদের একজন সেই দোকানের লোকটিকে পিটিয়ে মেরে ফেললো। প্রতিক্রিয়ায় ইহুদিরা সেই মুসলমানকে মেরে ফেলে। এই ঘটনা দু'পক্ষ বসে যেখানে মিটমাট করা যেতো সেখানে পুরো ইহুদি কায়নুকা গোত্রকে আক্রমণ করে ১৫ দিন ধরে অবরোধ করে রাখে মুহাম্মদ। ইহুদিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। মুহাম্মদ তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। আমি বাধা হয়ে দাঁড়াই। আমার প্রশ্ন ছিলো এদের অপরাধ কী?
-হত্যা করা হয়েছিলো ইহুদিদের?
-আরে না। এই জন্যই তো আমি 'মুনাফিক'। ইবনে হিশামে লেখা হয়েছে আমি মুহাম্মদের জামা খামচে টেনে বলেছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার বন্ধুদের লঘু শাস্তি না দেবেন এখান থেকে যেতে দেবো না। মুহাম্মদ আমার কথা ফেলার সাহস করেননি। ইহুদিদের তিনদিন সময় দেন গ্রাম খালি করে অন্যত্র চলে যাবার। আমি আজো জানি না কী অপরাধে এদেরকে তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিলো।
-উহুদের যুদ্ধে আপনি যুদ্ধ না করেই ফিরে এসেছিলেন। এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
-দেখো ৩০০ সৈন্য নিয়ে আমি উহুদের যুদ্ধে রওনা দিলাম। আমার সঙ্গে ইহুদিরাও মুহাম্মদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছিলো। কিন্তু মুহাম্মদ তাতে নাখোশ ছিলো। সে ইহুদি একদমই দেখতে পারতো না। ইউলিয়াম মুর এ সম্পর্কে লিখেছেন, মুহাম্মদ আমাকে বলে পাঠিয়েছেন 'মূর্তিপূজক চাটুকার ইহুদিদের' বাদ দিয়ে যেন আমি আসি। আমার তখন মনে হয়েছে ঠিক কাদের জন্য আমি এই যুদ্ধে যাচ্ছি? সেখানে গিয়ে আমি ও আমার সৈন্যরা মরবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মদের শত্রু, আমাদের তো নয়? মদিনায় আমরা সকল জাতি ধর্ম মিলেমিশে বাস করেছি। কিন্তু এখন দ্রুত সব বদলে যেতে লাগলো…।
-যদি আপনি এমনটাই ভাববেন, তাহলে মুহাম্মদের দল ছাড়ার চেষ্টা করে পাল্টা কোন রাজনৈতিক শক্তি গঠন করলেন না কেন?
-করেছিলাম তো! আমি তেমন কিছু করতে চাই শুনে ওমর আমার গর্দান উড়িয়ে দেবার হুকুম চাইতে গেছিলো মুহাম্মদের কাছে। ঘটনাটা বলি। বনু মুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে হামলা করার জন্য তাঁবু পড়েছিলো। সেখানে মক্কা থেকে আসা মুহাজির (শরণার্থী) ও মদিনার আনসার (সাহায্যকারী) গ্রুপের মাঝে একটা বিবাদ লেগে যায়। এই বিবাদ ছাইচাপা আগুনের মতো শুরু থেকে ছিলো। পরে দাবানল বাঁধিয়েছিলো। তখন অবশ্য আমি বেঁচে নেই। যাই হোক, মুহাজিররা আনসারদের উপর চোখ গরম করে এমনভাবে কথা বলতো যেন ইসলাম তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আমি ততদিনে মুহাম্মদকে নবী বলে স্বীকার করি না। আমি বুঝেছিলাম মুহাম্মদ একটা রাজ্য বানাতে ইসলাম বানিয়েছে যা ঐ সময়ের জন্য আমার কাছে মনে হয়েছিলো কার্যকর। নতুন একটা প্রেরণায় মানুষ অন্যরকমভাবে জাগতে পারছে। কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো ততই আমি মুহাম্মদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াশীলতাকে মানতে পারছিলাম না। তাকে অন্ধের মতো অনুসরণ, তার কথাই শেষ এটা মানতে পারছিলাম না। কারণ আমি সেখানে অন্যায় দেখতে পাচ্ছিলাম। তো সেদিন আমার এত খারাপ লেগেছিলো যে আমি চিৎকার করে বলা শুরু করি, যে কুকুরদের তোমরা খাইয়ে মোটাতাজা করছো আজ সেই কুকুরই তোমাদের কামড়াচ্ছে! দেখো তোমরা নিজেদের কী সর্বনাশ করেছো! কাদের আশ্রয় দিয়েছো? সেদিন যদি তাদের আশ্রয় না দিতে তাহলে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হতো না! …আল্লার কসম, আমি মদিনায় ফিরে এই মুহাজিরদের মদিনা থেকে বের
করার ব্যবস্থা করবো!
করার ব্যবস্থা করবো!
-আপনি তো দেখি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভালো করেই!
-হ্যাঁ। আমাকে খুন করার জন্য ওমর প্রস্তাব নিয়ে মুহাম্মদের কাছে যায়। মুহাম্মদ তাতে সম্মতি না দিয়ে বলেন, যদি এখন আমি উবারকে হত্যা করাই তাহলে সবাই বলবে, দেখো মুহাম্মদ তার দলের লোকদেরই কীভাবে হত্যা করে। এটা বলার কোন সুযোগ আমি দিতে চাই না। এখনো সে সময় আসেনি…।
-তার মানে আপনাকে হত্যা করা সহজ ছিলো না?
-এটা সামাল দেয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি তখনো মুহাম্মদের ছিলো না। আমি খুবই প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ছিলাম আমার গোত্রে। ইসলামের প্রচলিত কাহিনী এমনভাবে বলে যেন আমাকে কেউ দেখতে পারতো না। অথচ দেখো, মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশার নামে ব্যভিচারী অভিযোগ উঠার পর যখন কুরআনে তাকে নির্দোষ বলে আয়াত নামলো তখন অভিযোগকারীদের ৮০টি বেত মারা হয়েছিলো। সেখানে আমিও ছিলাম অভিযোগকারী। আমাকে এমন শাস্তি দেয়ার সাহস পর্যন্ত কারোর ছিলো না।
-তো 'ইসলামের নাম্বার ওয়ান শত্রু' তারপর মারা গেলেন ৬৩১ সালে। আপনার মৃত্যুর পর আপনার জানাজায় মুহাম্মদ যোগ দিয়েছিলেন ওমরের নিষেধ অমান্য করে। তারপরই কুরআনে সুরা তওবার ৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়, এরপর যেন আর কোন মুনাফিকের জানাজায় মুসলমানরা যোগ না দেয়।
-হ্যাঁ, সর্বশক্তিমান আল্লার এর বেশি আর কী করার ক্ষমতা আছে বলো!
-আপনি কি জানেন আপনার মৃত্যুর পর ইহুদি বনু কুরাইজা ইহুদিদের সকলকে হত্যা করা হয়েছিলো সামান্য শত্রুতার অভিযোগ তুলে? এবং মদিনায় আর কোন ইহুদি গোত্র অবশিষ্ট ছিলো না।
-আমি বনু মুস্তালিন অভিযানের সময়ই মদিনাবাসীরা কাদের আশ্রয় দিয়েছে এসব বলে গালমন্দ করেছিলাম। কিন্তু তখন আর সময় ছিলো না। ইতিহাসের চাকা তখন ঘুরে গেছে। ইসলাম সব দখল করে নেবে এটাই তখন ইতিহাসের ইচ্ছা। সেটাই ঘটেছিলো। তবে সান্ত্বনা কী জানো, ইতিহাস হাজার বছর পর হলেও সে তার সত্যটা তুলে ধরে। সেটাই কিন্তু এখন ঘটছে। সবাই সত্য জানতে পারছে।
-আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে সময় দেয়ার জন্য।
-তোমাকেও।
[তথ্যসূত্র: সিরাতুন নবী, ইবনে ইসহাক/ সিরাতুন নবী, ইবনে হিশাম/ ইবনে কাথিরের তাফসির/ইউলিয়াম মুর, মুহাম্মদের জীবনী]
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................