ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিনিসপত্রের আকাশ পাতাল তফাতের আফসোস আসলে একটি অবচেতন আফসোসের বহিঃপ্রকাশ।

চীন নামটি এসেছে চৌ রাজ বংশের (খ্রিস্টপূর্ব ১১২২-২৪৯) একটি দখলকৃত রাজ্য 'চিন' থেকে। কানসু ও শেনসি নামের দুটি জেলা নিয়ে সেই প্রাচীন 'চিন রাজ্য' গঠিত হয়েছিলো। এই রাজ্যটি আগ্রাসনের মাধ্যমে অন্যান্য রাজ্যগুলো দখল করে নেয়। ফলে সেসময় পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা এই সুবিশাল অঞ্চলকে যা বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে শাসিত হচ্ছিলো, তাদের সকলকেই 'চিন' নামে অভিহিত করেছিলো। এভাবেই বাইরের পৃথিবী এই সুবিশাল অঞ্চলের সমস্ত জাতিগুলোকে 'চীন' নামে ভাবতে শুরু করে। এই সুবিশাল অঞ্চলে বহু জাতির বাস। তারা কেউ 'চিন' রাজ্যের পরিচয় বহন করে না। 'চাইনিজ' জাতি আসলে বিদেশীদের দেয়া একটি ভ্রান্ত নাম। কালক্রমে এই পরিচয়েই এই অঞ্চলের সকল জাতিগুলো ঐক্য স্থাপন করে। 
তবে সকল কথাটা সঠিক হলো না। তিব্বতি, তাইওয়ান নিজেদের 'চাইনিজ' বলে না। চীন যে কোন জাতিসত্তা নয়, এই বর্তমানকালেও এই দুটি অঞ্চলের বিদ্রোহ, ছাইচাপা আগুনের মতো আমাদের সেকথা মনে করিয়ে দেয়।


'ভারতবর্ষ' নামের সুবিশাল এই অঞ্চল নিয়ে আজকের যে 'ভারত' রাষ্ট্র, যাদের রাজনৈতিক নাম 'ভারতীয়' তার সঙ্গে চীনের রাজনৈতিক পরিচয়ের মিল তো আছেই, উল্টো চীনের চেয়ে অনেক দিক দিয়ে 'ভারতীয়দের' সংস্কৃতিগতভাবে একটি বৃহৎ পরিবার বলা চলে। 'ভরত' নামের একজন শাসকের নামেই ভারতবর্ষ নামকরণ। সেই ভারতকে বামপন্থীরা মানতেই চান না! ভারত নামে নাকি কোন দেশ জাতি কিছু বুঝায় না। তাই 'ভারত' নামের যুক্তরাজ্যের কোন ভিত্তি নেই। কোন জাতিগত অবস্থান নেই। তাই এটিকে ভেঙে কমিউনিস্টরা কিছু নিয়ে নিক, কিছু মুসলিম লীগাররা নিয়ে আরেকটা পাকিস্তান বানান- সমস্যা কী?

অথচ এরাই 'চীন' বলতে অজ্ঞান! একবারও বলে না চীন বলতে কোন জাতি গোষ্ঠীকে বোঝায় না! বলবে না যদি চীন ভেঙে যায়! এই দ্বিচারিতারই সমালোচনা করি আমি।

'চাইনিজ' বলতে এখন আমরা যে 'জাতির' কথা জানি তা আসলে মোঙ্গলীয়, তাতার, তিব্বতি, বর্মী, সান, মাঞ্চু জাতিদের আলাদা আলাদা জাতিসত্তার রাজনৈতিক ঐক্য। 'ভারতীয়' বলতে যেমন একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষদের যাদের সংস্কৃতি ভাষা খাদ্য লোকাচার ধর্মবিশ্বাস ও পোশাকের দারুণ মিল, মুখমণ্ডল, গায়ের রঙ যাদের মধ্যে অভিন্নতা এনে দিয়েছে, চীনের এই জাতিদের মধ্যে সেটাই ঘটেছে । অথচ 'ভারতীয়' বলতে যারা মানতে রাজী নন তারা 'চাইনিজ' মেনে নিতে কোন দ্বিধা করেননি!

'চীনের' একটি বড় সুবিধা ছিলো তাদের ভাষা। এই গোটা অঞ্চলে বলতে গেলে একটি ভাষায় সকলে কথা বলে। মান্ডারিন ভাষা খুব সহজে এক পর্যায়ে চীনের সমস্ত জাতিদের 'চাইনিজ' ভাবতে বাধ্য করেছিলো। ২০৬-২২০ খ্রিস্টাব্দের সময় মান্ডারিন রাজভাষার মর্যাদা লাভ করে। এই ভাষা ছিলো হাং রাজবংশের ভাষা। এই ভাষার ছয়টি ধরণ তখন থেকে প্রচলিত হতে থাকে। রাজকাজ, ধর্মাচারণ, যুদ্ধে, বিচারকার্যে...। তাই বলা চলে প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের সকলেই একই ভাষায় কথা বলতো না। ভারতের বহু জাতির বহু ভাষা। এটি যেমন বৈচিত্র‍্য তেমনি ভাষাগত জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে স্বতন্ত্র জাতি পরিচয় সৃষ্টি করেছে। ফলে মাও পুরো চীনকে কমিউনিস্ট শাসনে আনতে পারলেও, পৃথিবী ধ্বংস হবার আগ পর্যন্ত এই ভারতকে না কেউ কমিউনিস্ট শাসনে আনতে পারবে, না ইসলামিক শাসনে। এখানে গণতন্ত্র, উন্মুক্ত শাসনতন্ত্র ছাড়া আর কিছুর স্থান নেই। কারণ বহু জাতির বহু ভাষা সংস্কৃতির জাতীয়তাবাদ এখানে বিদ্যমান। কমিউনিস্ট বা ইসলামিক রাজ্যে দুদিনেই এক জাতি অন্য জাতি দ্বারা নিপীড়নের দাবীতে জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠবে। তখন আর কেউ কমিউনিস্ট নয়, কেউ ইসলামিক নয়। উদাহরণ পাকিস্তান! পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানরা জাতিতে বাঙালি হওয়াতে, ভিন্ন ভাষাভাষী হওয়াতে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আর মুসলিম জাতীয়তাবাদে ঐক্য রাখতে পারেনি। তারা আলাদা হয়ে আরেকটা পাকিস্তানেরই (বাংলাদেশ) জন্ম দিয়েছে সত্য কিন্তু 'পাকিস্তান' নামের বৃহৎ  মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙতেই হয়েছে।

এ কারণেই ভারতের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে পেরেছে। ভারত কী করে একটি দেশ হয়ে এতগুলো জাতিকে ধরে রেখেছে সেটি ভেবে পণ্ডিতরা ব্যাকুল হয়েছে। কেউ কেউ ভারতের ঐক্যের পেছনে বলিউড ও ক্রিকেটকে দায়ী করেছেন! কিন্তু কেউ বোঝেনি বৈচিত্র‍্যই ভারতকে ঐক্য ও অভিন্ন রেখেছে। ভারত ভাঙার আশায় আন্তর্জাতিক মুসলিম লীগ তীর্থের কাকের মতো বসে থাকলেও সেটি ঘটে না ঐ বৈচিত্র‍্যের গুণেই। এমনকি 'হিন্দুত্ববাদ' বলতেই আসলে এতগুলো জাতি সংস্কৃতি ভাষাকে বিশেষ কোন ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বাঁধা যায় না। 'হিন্দুত্ববাদের' সংজ্ঞাকে তাই পরিবর্তন করে সিন্ধুসভ্যতার সংস্কৃতিগত মানুষদের বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ 'সনাতন ধর্ম' বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোন জাতীয়তাবাদ যেটা মুসলমানরা 'মুসলিম লীগ' করে দেখিয়েছে তেমনটা সম্ভব হয়নি। ভারতে তাই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কোন জাতীয়তাবাদ টিকবে না। ভারত বেঁচে থাকবে জাতি ভাষা বর্ণের বৈচিত্র‍্যের সমাহারে।

পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থাই শেষকথা। ছোট ছোট খণ্ডে দুর্বল না হয়ে বহু জাতি ভাষা সংস্কৃতির মিলনমেলার যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থাই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দেবে। আজ 'মুসলিম লীগ' মনে মনে ভারত ভাঙার ভুল ভারতের দিকে চেয়ে অনুভব করলেও সেখান থেকে শিক্ষা নেয় না। ইউটিউবের ভিডিও ব্লগাররা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিনিসপত্রের আকাশ পাতাল তফাতের আফসোস আসলে একটি অবচেতন আফসোসের বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানে যেটি এখন প্রকাশ্যেই সেখানকার ব্লগাররা করে থাকে!

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted