"পারস্য দেশের রাম এবং জরাথ্রুষ্টের কা'বা"
বিষ্ণুর অবতার আছেন দশজন। এনাদের ভেতর প্রথম তিনজন মানুষ নন (মৎস, কূর্ম, বারহ), চতুর্থজন অর্ধেক সিংহ অর্ধেক মানুষ (নৃসিংহ)।
পাঁচ নাম্বার অবতার (বামন) থেকে সম্পূর্ণ মানুষরুপী অবতারদের আসা শুরু হলো। খেয়াল করলে দেখবেন প্রাণীরুপী অবতারদের আসার যুগ হচ্ছে সত্যযুগ। বামন অবতার থেকে শুরু হয় ত্রেতাযুগ। এরপর একে একে আসা ষষ্ঠ ও সপ্তম অবতার পরশুরাম ও রাম আসেন এই ত্রেতাযুগে। এরপর দ্বাপরযুগে আসেন অষ্টম অবতার ভগবান কৃষ্ণ।
এরপরে শুরু হয় কলি যুগ। কলির সূচনা হয় বিষ্ণুর নবম অবতার বুদ্ধকে দিয়ে, আর কলিযুগ শেষ হবে কল্কি অবতার নিয়ে। কল্কি নিয়ে উত্তেজনার শেষ নেই, যীশু খৃষ্ট, নবী মোহাম্মদ, বা'ব, ইমাম হোসাইন, ইমাম মাহাদী এরকম অনেককেই কালে কালে কল্কি দাবী করা হয়েছে। অনেকে ভাবেন উনি এসে গেছেন, অনেকে ভাবেন উনি আসবেন।
আমাদের আশেপাশের এলাকায় রাম আর কৃষ্ণই বিষ্ণুর সবচেয়ে বেশি আলোচিত অবতার হিসেবে চর্চিত হয়ে থাকেন। মাহবুব লীনেন ওনার অভাজনের মহাভারতের ভূমিকাতেই পরিস্কার করে বলেছেন আমাদের এই দুই ক্যারেক্টারকে মিলিয়ে দেখার কিংবা খুব কাছাকাছি সময়ের লোক হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা আছে, কিন্তু তারা দুইজন আলাদা যুগের বেশ দূরের সময়ের এবং বেশ অনেকটা দূরের এলাকার মানুষ।
কথা হচ্ছে মহাভারত আর রামায়ণের ম্যাশআপের যতোই ডিম্যান্ড থাক, আমাদের জানতে এবং মানতে হবে রামায়ণ ত্রেতাযুগের কালাম আর মহাভারত দ্বাপর যুগের প্রোডাক্ট।
এবারে হিন্দু মাইথোলজিতে যুগ কিন্তু অনেক অনেক লম্বা টাইম। এই চক্রাবর্তী যুগ আছে চারটা। এই চতুর্যুগ বা যুগচক্র হলো হিন্দুধর্মে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির কালগণনা পদ্ধতি। এই চার যুগ হচ্ছে: সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ।
চারটি যুগ চক্রক্রমিকভাবে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। এভাবে ১০০০ চতুর্যুগ সম্পন্ন হলে এক কল্প হয়, যা হিন্দু সৃষ্টিচক্র ধারণা অনুযায়ী সৃষ্টির অর্ধ সময়। যেহেতু যুগ চক্র চারটি যুগের মধ্য দিয়ে অগ্রগতি লাভ করে, সেহেতু প্রতিটি যুগের দৈর্ঘ্য এবং মানুষের সাধারণ নৈতিক ও শারীরিক অবস্থা পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনটি পূর্বের যুগের এক-চতুর্থাংশ করে হ্রাস পায়। বর্তমান সময়টি চারযুগের মাঝে কলি যুগ। কলি যুগে কল্কি অবতারের আগমন ঘটবে এবং আবারো নতুন যুগচক্রের জন্য সত্য যুগ সূচনা হবে।
আমাদের আলাপটা মূলত রামায়ণের একটু আগের। ত্রেতা যুগের অবতার শ্রীরামচন্দ্র সম্পর্কে আমরা জানি। কিন্তু রামের ঠিক আগেই যেই অবতার এসেছিলেন তার সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা অল্প। বলছি অবতার পরশুরামের কথা। তার কাছে কি কোন কিতাব নাজেল হয় নাই? কিংবা অন্তত তার বলবার গল্পটা আসলে কি ছিলো? রামের চরিত যদি হয় রামায়ণ তাহলে পরশুরামের চরিত কি তবে পরশুরামায়ণ?
যতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় ওনার রামচন্দ্র ও জরাথুস্ট্র গ্রন্থে দাবী করছেন অবতার পরশুরাম তথা পারস্য দেশের রামের রামায়ণটি-ই হচ্ছে গাঁথা বা আবেস্তা। পরশুরাম স্বয়ং, কিংবা তার খানিক আগে পরেই সম্ভবত জরাথুস্ট্রের আগমন ঘটে। যতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় দাবী করছেন দ্বাপর আর কলিযুগে অসুর আর দেবতাদের বাইনারিতে অসুর যেভাবে একেবারেই বিপরীতক স্বত্বা হিসেবে দেখা হয় ত্রেতাযুগে বিষয়টা এমন ছিল না। তখন মাত্র বিভেদের সূচনাটা হচ্ছে।
ভগবানের বুকে লাথি মারা ভৃগু এবং তার বংশের হাত ধরে একেশ্বরবাদী নিরাকারের উপাসনা যে শুরুটা হয় সেটাকে একনলেজ করে ঋগ্বেদেও ভৃগুকে অসুরদের পুরোহিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভৃগুবংশের এক সন্তান জমদাগ্নি। অনেক ঐতিহাসিক জমদাগ্নিকেও জরাথুস্ট্র রুপে কল্পনা করেছেন। এই জমদাগ্নির সন্তান হচ্ছে পরশুরাম, এটাও অনেকে দাবী করেন উনিই জরাথুস্ট্র। কেউ কেউ বলেন জমদগ্নির স্ত্রী'র ছোটভাই বিশ্বামিত্রা হলেন জরাথুস্ট্র।
অর্থাৎ সম্ভাবনা আছে জরাথুস্ট্র হয়তো একজন একক ব্যাক্তি না। জরাথুস্ট্র হয়তো একটা বংশ বা পরম্পরা বা সিলসিলার নাম।
আমি দেখতে পাচ্ছি ভৃগু, জমদগ্নি, পরশুরাম, রাম ও বিশ্বামিত্র গবেষকেরা কোথাও না কোথাও এই চারটি নামেই জরাথ্রুষ্টকে ডেকেছেন।
এবারে অন্যদিকে নবী ইলিয়াস, মূসা, ইজিকিল এবং নবী ইব্রাহিমকে আলাদা আলাদা ভাবে জরাথ্রুষ্ট বলা হয়েছে অনেক জায়গায়। যেমন করে পরশুরাম একজন রাম, বলরামও একজন রাম এবং স্বয়ং রামচন্দ্রও একজন রাম। একইভাবে ইব্রাহীমের সন্তানদের (প্রধানত নবী ইয়াকুব পরবর্তী) 'বনি ইজরায়েল' টাইটেল দেয়া হয়। অর্থাৎ যেমন রাম একটা টাইটেল, যেমন বনি ইজরায়েল একটা টাইটেল, জরাথ্রুষ্টও হতে পারেন একটা টাইটেল, একটা সিলসিলা, একটা বংশ।
অর্থাৎ এই রুটে হয়তো সত্যিই এই তিন নামের লোক থেকে থাকতে পারেন অথবা এই তিনটা লোক হয়তো একই লোক হতে পারেন। গিয়াম তার 'The Prophet' গ্রন্থে দেখাচ্ছেন জরাথ্রুস্টের অনেকগুলো নামের একটা নাম হচ্ছে 'Ibrahim Zerdascht', অর্থাৎ 'ইব্রাহিম জেরদাসক্ত'।
লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সুজান মার্চ্যান্ড জরাথ্রুষ্টের নাম ও সময়কালের সেমেটিক জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। উনি শনাক্ত করে দেখিয়েছেন সেমিটিক নবী ইজিকিল, নবী ইলিয়াস এবং নবী ইব্রাহিমকে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন গবেষক জরাথ্রুষ্ট হিসেবে কল্পনা করেছেন।
তো ভগবানের বুকে লাথি মারা বিদ্রোহী ভৃগুর বংশধরদের অসুর পূজারী বলে মহাভারতে বনপর্বে বলা হচ্ছে:
"ভৃগুভির অঙ্গিরোভিশ্চ হুতং মন্ত্রৈঃ পৃথক-বিধৈ", বনপর্ব- ২২৩:১৪
অর্থ: ভৃগুর শিষ্য অসুর পূজারিরা পৃথক মন্ত্রে আহুতি দেয়
ভৃগু ঋষি থেকেই একটা নীরাকার উপাসনার ইঙ্গিত বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। এদিকে ভৃগুর ভগবানের বুকে লাথি মারার সাথে নমরুদ ডাইনেস্টিতে ইব্রাহীমের কুঠার দিয়ে ভাস্কর্য ভাঙার একটা কানেকশন পাওয়া যায়। এই ইব্রাহীম পরবর্তী সবগুলো নবীর মূর্তি বা প্রতীমাবিরোধী অবস্থান সর্বজনবিদিত।
এদিতে ভৃগু বংশের পরশুরামও ছিলেন কুঠারধারী, সুরবিরোধী তথাকথিত অসুর লেবেল্ড (তখনো অসুর মাত্রই খারাপ এই কথা বলা শরু হয়নি)। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পরশুরাম ২১ বার পৃথিবীর সমস্ত অপক্ষত্রীয়দের হত্যা করে বিশুদ্ধ ক্ষত্রীয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
এদিকে জরাথ্রুস্টও বলছেন ঈশ্বর এক আর কাওমও এক, সেই কাওমের সমস্ত বর্ণপ্রথা তুলে দিয়ে তিনি শুধু একটা কাওমের কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে যোদ্ধা বা ক্ষত্রীয়।
তো জরাথ্রুষ্টকে সেমেটিক নবী বিবেচনা করলে এই রেইলর গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম ইসলাম তো চলেই আসে। গবেষক ক্লাউড ফিল্ড ওনার পার্সিয়ান লিটারেচার গ্রন্থে বলেছেন:
"ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কোরআন আর আবেস্তার মিল এতো বেশি, যেকেউই একে জিন্দাবেস্তার দ্বিতীয় সংস্করণ বলে মনে করতে পারে" (Cloud field, persiacn Literature, p:33)
ব্যাপারটা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?
হিন্দু মাইথোলজি মনে করছে, দুনিয়াটা যেমন সূর্যের চারপাশে ঘুরছে একইভাবে কাল বা সময়ও ঘুরছে, চার যুগ ফিরে ফিরে আবার আসছে। সত্যযুগের পর ত্রেতাযুগ এরপর দ্বাপরযুগ তারপর কলিযুগ, কলিযুগের পর আবারো সত্যযুগ। এভাবে চলতেই থাকবে। ত্রেতাযুগের শুরুতে আসলো গাঁথা বা আবেস্তা আর শেষে আসলো রামায়ণ, দ্বাপর যুগের আসলো মহাভারত, কলিতে আসলো ত্রিপিটক।
এই আলাপগুলো আবার ডেভলাপ হচ্ছে বিভিন্ন আলাদা আলাদা স্থানে, কোন একক ট্রাইবের কাছে আসছে এমন কিন্তু না। এবারে অন্যদিকে গাঁথাকে যদি সেমেটিক রেইলে তাওরাতের টাইমলাইনের সাথে মেলাই দেখা যাবে ইহুদি দাবীতে তাওরাত আর গাঁথা সমসাময়িক বা তাওরাত খানিক আগে এসেছে। এরপরের জাবুর, ইঞ্জিল আর কোরআন অন্যদিকে মানীদের কিতাবাদি কিংবা ইয়াজিদিদের উপকথাগুলোতে স্বর্গ-নরক, ফেরেশতা, আজান, নামাজ, যাকাত, কিয়ামত সহ বিভিন্ন বিষয়ে স্লাইটলি চেইঞ্জড যেই কমন আলাপ পাওয়া যায়, আবেস্তার স্টোরি ডেভলপমেন্ট দেখবেন প্রায় একই ঘরনার আলাপ দিচ্ছে। ইভেন এমনকি জোরাস্টার প্রসিদ্ধ ধর্মীয় একটা স্থান আছে যার নাম হয় "কা'বে জোরাস্টার", চারকোণা একটা ঘর যেটাকে কা'বার মতোই লাগে দেখতে। আর মেরাজের গল্প তো আপনাদের সাথে আগেই করেছি।
সবচাইতে মজার বিষয় হচ্ছে এই যে মিথগুলোর পথচলার ভেতর আমরা শ্রীলংকা, নেপাল, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সৌদিআরব, ফিলিস্তিনি ও মিশর এইরকম একটা ম্যাপ দেখতে পাবো। গল্পগুলো ডেভলাপমেন্টের আইডিয়াল টাইমলাইন আমি বলতে পারবো না। কিন্তু সবচেয়ে অলীক আর সবচেয়ে রক্ষণশীল দুই বিবেচনায় এই পুরো লাইনআপে গল্পগুলো (কিংবা সত্য ঘটনাগুলো) ডেভলাপমেন্টের সময়টা খৃষ্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে থেকে খৃষ্টের জন্মের এক হাজার বছর পর পর্যন্ত ডেভলাপ হয়েছে।
এই পাঁচ হাজার বছরে এই আলোচনার এলাকার স্টোরিগুলো একে অপরকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই লাইনাপের ডালা মেলে বসলে একটা অদ্ভুত সুন্দর সঙ্গীতায়োজনের মত মনে হয় আমার কাছে, যেখানে সুরগুলোর মিল ধরতে পারার ভেতর একটা অনাবিল আনন্দ আছে। আমরা কে কার থেকে উচ্চ কিংবা কে কার আগে এসেছে কিংবা কে সত্য এইসব প্রশ্নে হানাহানি করতে করতে পুরো সুরের সিম্ফোনিটাকেই হারিয়ে ফেলছি।
এই ছন্দের মিলগুলো খুঁজে বের করার পেছনে আর অনেক বেশি মেহনত দরকার। দরকার একটা প্রতিষ্ঠানের। সেই ডাক দিয়েই আজকের আলাপ শেষ করছি।
-
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................