খ্রিস্টে আর কৃষ্ণে, বড় তফাৎ আছে ভাই!

খ্রিস্টে আর কৃষ্ণে,
বড় তফাৎ আছে ভাই!

ডিসেম্বর মাস আসলে পশ্চিমবাংলায় জনপ্রিয় একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। সেখানে বলা হয়, "খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কোনও তফাৎ নাইরে ভাই।" অর্থাৎ যিশু খ্রিস্ট এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একই; তাঁদের মতাদর্শও একই, তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ  যিশু খ্রিস্টের বাইবেল এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা গীতার আদর্শ একই। পঙক্তিটির ভাবটি ব্রিটিশ আমলের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগান থেকে নেয়া। তিনি অনেক উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে এ সমন্বয়ের গানগুলো রচনা করেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়েও কালীভক্ত শাক্ত ভাবাপন্ন ছিলেন। কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির এখনো রয়েছে।  তিনি শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি বিবিধ সম্প্রদায়ের ভাব নিয়ে সংগীত রচনা করেছেন। কবিগানের সভায় গায়ক রাম বসুর চাপানের উত্তরে তিনি গাইলেন:

"একবার রাম বসু অ্যান্টনিকে 'চাপান' দিলেন:

'সাহেব! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি, 
ও তোর পাদরী সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চূণ কালি।'

অ্যান্টনি 'উতোর' গাহিলেন:

খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই।
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই।। 
আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে
ঐ দেশ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে
আমার মানব জনম সফল হবে যদি ঐ রাঙ্গা চরণ পাই।"

(রমেশচন্দ্র মজুমদার,  ২০২১, পৃ. ৫৬৫-৫৬৬)

 কিন্তু একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বানী এবং বাইবেলের বাণী বা বিশেষ করে নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত যিশু খ্রিস্টের বাণী এক নয়। যে সর্বজনীন মানবতার কথা শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, সে কথাগুলো আব্রাহামিক  ধর্মগ্রন্থগুলোতে তেমন মত করে পাওয়া যায় না। বিষয়টি  যিশু খ্রিস্টের বাইবেল এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং শ্রীমদ্ভাগবতের তূলনামূলক সংক্ষিপ্ত   আলোচনাতেও সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ।

বিবিধ মতপথের স্বাধীনতা:
বিবিধ দেবদেবীর পূজা প্রসঙ্গে বাইবেলে বলা হয়েছে -

"তোমরা তাদের দেবতাদের পূজা কিংবা সেবা করবে না এবং সেখানকার লোকেরা যা করে তা করবে না। তোমরা তাদের দেবদেবতার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলবে এবং তাদের পূজার পাথরগুলোও টুকরো টুকরো করে ফেলবে।"
(পবিত্র বাইবেল: যাত্রাপুস্তক, ২৩. ২৪)

"সদাপ্রভুকে ছাড়া যদি কেউ কোন দেবতার কাছে কিছু উৎসর্গ করে তবে তাকেও মেরে ফেলতে হবে।"
(পবিত্র বাইবেল: যাত্রাপুস্তক,২২.২০)

"তোমরা তাদের বেদীগুলো ভেঙ্গে ফেলবে,তাদের পূজার পাথরগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলবে আর তাদের পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেলবে। তোমরা কোন দেবতার উপাসনা করবে না।"

(পবিত্র বাইবেল:যাত্রাপুস্তক,৩৪.১৩-১৪)

"তিনি যখন তাদের তোমাদের হাতের মুঠোয় এনে দেবেন এবং তোমরা তাদের হারিয়ে দেবে তখন তোমরা একেবারে ধ্বংস করে ফেলবে।তোমরা তাদের সঙ্গে কোন সন্ধি করবে না এবং তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাবে না। তোমরা তাদের সঙ্গে কোন বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করবে না। তোমাদের মেয়েদেরও তোমরা তাদের ছেলেদের হাতে দিবে না এবং  তাদের মেয়েদেরও তোমাদের ছেলেদের জন্য আনবে না। কারণ সেই মেয়েরা তোমাদের ছেলেদের আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে এবং দেব-দেবতার পূজা করাবে। তাতে সদাপ্রভুর ক্রোধের আগুন তোমাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের ধ্বংস করে ফেলবে।
তোমরা ঐ সব জাতির বেদীগুলো ভেঙ্গে ফেলবে, পূজার পাথরগুলো চুরমার করে দেবে, পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেলবে এবং মূর্তিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেবে।"

( পবিত্র বাইবেল:দ্বিতীয় বিবরণ, ০৭.২-৫)

"তাদের দেব-দেবতার মূর্তিগুলো তোমরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে।তোমরা তাদের গায়ের সোনা-রূপার লোভ করবে না নিজেদের জন্য তোমরা তা নেবে না, কারণ তা করলে তোমরা ওগুলোর ফাঁদে পড়বে।তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কাছে ওগুলো ঘৃণার জিনিষ।"
( পবিত্র বাইবেল:দ্বিতীয় বিবরণ, ০৭.২৫)

"সে হয়তো আমার আদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে দেব-দেবতা কিম্বা সূর্য, চাঁদ বা আকাশের তারাগুলোর পূজা করছে।"
( পবিত্র বাইবেল:দ্বিতীয় বিবরণ, ১৭.০৩)

 বাইবেলের পুরাতন নিয়মের যিহিস্কেলে বর্ণিত হয়েছে, সনাতন সূর্য দেবতার মন্দির নির্মমভাবে বিধ্বংস করার কথা:

"তারপর তিনি আমাকে সদাপ্রভুর ঘরের  ভিতরের উঠানে নিয়ে গেলেন আর সেখানে  উপাসনা-ঘরে ঢুকবার মুখে বারান্দা ও বেদীর মাঝখানে প্রায় পঁচিশজন লোক ছিল। সদাপ্রভুর ঘরের দিকে পিছন ফিরে পূর্ব দিকে মুখ করে তারা সূর্যের কাছে প্রণাম জানাচ্ছিল।

 তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, তুমি এটা দেখলে? যিহূদার লোকেরা যে  জঘন্য কাজ এখানে করছে তা করা তাদের পক্ষে কি একটা সামান্য ব্যাপার? তারা অত্যাচারে দেশটা ভরে তুলেছে এবং অনবরত আমার অসন্তোষ খুঁচিয়ে তুলছে। দেখ, তারা আমাকে কি ভীষণ অপমান করছে। কাজেই আমি ক্রোধে জ্বলে উঠে তাদের সংগে ব্যবহার করব; আমি তাদের মমতার চোখে দেখব না বা তাদের রেহাই দেব না। তারা আমার কানের কাছে চিৎকার করলেও আমি তাদের কথা শুনব না।

তারপর আমি ঈশ্বরকে জোর গলায় ডেকে 'বলতে শুনলাম, 'হে শহর-ধ্বংসের কাজে নিযুক্ত লোকেরা, তোমরা প্রত্যেকে ধ্বংসের অস্ত্র হাতে নিয়ে এখানে এস।' উত্তর দিকের উঁচু জায়গার ফটকের দিক থেকে আমি ছয়জন লোককে আসতে দেখলাম; প্রত্যেকের হাতে ধ্বংসকারী অস্ত্র ছিল। তাঁদের সংগে ছিলেন মসীনার কাপড় পরা একজন লোক আর তাঁর কোমরের পাশে ছিল লেখার সরঞ্জাম। তাঁরা ভিতরে ঢুকে ব্রোঞ্জের বেদীর পাশে দাঁড়ালেন।"

( পবিত্র বাইবেল:যিহিস্কেল,০৮.১৬-১৮; ০৯.০১-০২)

“তারা সেখানে ফিরে গিয়ে সব বাজে মূর্তি ও জঘন্য প্রতিমাগুলো দূর করে দেবে। আমি তাদের এমন অন্তর দেব যা কেবল আমারই দিকে আসক্ত থাকবে, আর আমি তাদের মধ্যে নতুন আত্মা দেব; আমি তাদের কঠিন অন্তর সরিয়ে দিয়ে নরম অন্তর দেব । তাহলে তারা আমার নিয়ম মত চলবে এবং আমার আইন- কানুন যত্নের সংগে পালন করবে । তারা আমার লোক হবে এবং আমি তাদের ঈশ্বর হব কিন্তু যাদের অন্তর বাজে মূর্তি ও জঘন্য প্রতিমাগুলোর দিকে, তাদের কাজের ফল আমি তাদের উপর ঢেলে দেব। আমি প্রভু সদাপ্রভু এই কথা বলছি।”

( পবিত্র বাইবেল: যিহিষ্কেল,১১.১৮-২১)

প্রতিমাপূজা নিয়ে বাইবেলের বা আব্রাহামিক মতাদর্শে  দেব-দেবতার মূর্তিগুলো ভেঙে এবং আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। দেবদেবতার পূজার বেদীগুলো ভেঙে ফেলাসহ দেবদেবতার পূজার পাথরগুলোও টুকরো টুকরো করে ফেলতে বলা হচ্ছে। এমন কী অন্য ধর্মীয় কোন দেবতার কাছে কিছু উৎসর্গ করলে তবে সেই ব্যক্তিকেও মেরে ফেলতে প্ররোচনা দেয়া  হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার পক্ষে থেকে। অথচ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাক্যে নেই কোন সংকীর্ণতা। আছে আকাশের মত উদারতা। তিনি বলেছেন, যে যেভাবে তাঁর শরণাগত হবে বা উপাসনা করবে; সে ঠিক সেভাবেই ভগবানকে পাবে। এরপরেও কী আমরা বলবো যে যিশুখ্রিস্ট এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতাদর্শ এক?

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ০৪.১১)

" হে পার্থ! যে ভক্ত যে যেভাবে আমার শরণাপন্ন হবে এবং উপাসনা করবে; সে ঠিক সেভাবেই তারা আমাকে পাবে। কারণ সকল মানুষ সর্বোতভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করছে।"

পিতামাতায় শ্রদ্ধাসহ পারিবারিক সম্প্রীতি:

 বাইবেলের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন যে, তিনি পৃথিবীতে শান্তি দিতে আসেননি।বরং তিনি এসেছেন  মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে। যেমন-ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে,মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বৌকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে। অর্থাৎ সন্তানকে জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রী পিতামাতার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে।

"আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে,মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বৌকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। একজন মানুষের নিজের পরিবারের লোকেরাই তার শত্রু হবে।"

(পবিত্র বাইবেল : মথি, ১০.৩৪-৩৬)

বাইবেলের এ উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পারি যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পিতামাতার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা এবং কর্তব্য প্রসঙ্গে কী বলেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে সাথে নিয়ে পিতামাতা দেবকী এবং বসুদেবকে উদ্দেশ্য করে, বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি সন্তানের করণীয় প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন-পিতামাতার ঋণ কোন মানুষই শতবর্ষ পরমায়ু লাভ করে পিতামাতার একনিষ্ঠ সেবার করেও আমৃত্যু  শোধ করতে পারে না। কারণ পিতামাতার ঋণ সন্তানের পক্ষে অপরিশোধ্য। 

সর্বার্থসম্ভবো দেহো জনিতঃ পোষিতো যতঃ।
ন তয়োর্যাতি নির্বেশং পিত্রোর্মর্ত্যঃ শতায়ুষা।।

যস্তয়োরাত্মজঃ কল্প আত্মানা চ ধনেন চ।
বৃত্তিং ন দদ্যাত্তং প্রেত্য স্বমাংসং খাদয়ন্তি হি।।

(শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ:১০.৪৫.০৫-০৬)

" মানুষের পক্ষে এ পাঞ্চভৌতিক দেহটি সর্বার্থসম্ভব। চতুর্বর্গের সকলেই লাভ হতে পারে দেহটি দ্বারা। সেই দেহের জন্ম, পালনপোষণ যাঁদের মাধ্যমে। যাঁদের স্নেহে এবং দয়ায় আমাদের এ জীবনের সবচেয়ে অসহায় সময়ে আমরা সুরক্ষিত থাকি; সেই পিতামাতার ঋণ কোন মানুষই শতবর্ষ পরমায়ুতে একনিষ্ঠ সেবার দ্বারাও শোধ করতে পারে না।

যে পুত্র সক্ষম হয়েও নিজের দেহ এবং ধন সম্পদের দ্বারা তার পিতামাতার সর্বপ্রকার সেবা এবং তাঁদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করেনা, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর পরলোকে যমদূতেরা তাকে নিজ মাংস ভক্ষণ করায়।"

শান্তি, সম্প্রীতি ও সমদর্শীতা প্রসঙ্গে:

বাইবেলে যিশু বলেছেন যে, তিনি শান্তি দিতে আসেননি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছেন। তার আগমন পরবর্তী থেকে এক বাড়ির পাঁচজন পাঁচভাগ হয়ে যাবে, তিনজন দুইজনের বিরুদ্ধে আর দুইজন তিনজনের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোতে সমাজে মানুষের শান্তি ও সম্প্রীতি যেমন বিনষ্ট হবে তেমনি পরিবারও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পারিবারিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে।

"আমি পৃথিবীতে আগুন জ্বালাতে এসেছি; যদি তা আগেই জ্বলে উঠতো তবে কতই না ভাল হতো!

তোমাদের কি মনে হয় যে, আমি শান্তি দিতে এসেছি? না তা নয়। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। এখন থেকে এক বাড়ির পাঁচজন পাঁচভাগ হয়ে যাবে, তিনজন দুইজনের বিরুদ্ধে আর দুইজন তিনজনের বিরুদ্ধে।"

(পবিত্র বাইবেল : লূক, ১২. ৪৯,৫১-৫২)

"তোমরা ছেলেদের এবং যারা কুমারী নয়, এমন সব স্ত্রীলোকদের মেরে ফেলো; কিন্তু যারা কুমারী তাদের তোমরা নিজেদের জন্যে বাঁচিয়ে রাখো।"

(পবিত্র বাইবেল :গণনা পুস্তক, ৩১. ১৭-১৮)

তোমরা শহরের মধ্যে ওর পিছনে পিছনে যাও এবং কোন মায়া-মমতা না দেখিয়ে লোকদের মেরে ফেলতে থাক, কাউকে রেহাই দিয়ো না।বুড়ো, যুবক, যুবতী মেয়ে, স্ত্রীলোক ও ছোট ছেলেমেয়েদের মেরে ফেল, কিন্তু যাদের কপালে চিহ্ন আছে তাদের ছুঁয়ো না । উপাসনা-ঘর থেকে তা করতে শুরু কর।” এতে তাঁরা উপাসনা-ঘরের সামনে যে বৃদ্ধ নেতারা ছিলেন তাঁদের দিয়ে শুরু করলেন ।

তারপর ঈশ্বর তাঁদের বললেন, “তোমরা নিহত লোকদের দিয়ে উঠানটা ভরে ফেলে উপাসনা-ঘরটা অশুচি কর । যাও, কাজ কর।” কাজেই তাঁরা বের হয়ে শহরে গিয়ে লোকদের মেরে ফেলতে লাগলেন। আমি তখন উপাসনা-ঘরে একা ছিলাম। সেই সময় আমি উবুড় হয়ে পড়ে আবেগের সংগে বললাম, “হায়,  সদাপ্রভু! যিরূশালেমের উপরে তোমার ক্রোধ ঢেলে দিয়ে তুমি কি ইস্রায়েলের বাকী সবাইকে ধ্বংস করে ফেলবে?”

(পবিত্র বাইবেল : যিহিষ্কেল, ০৯.৫-৮)

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সকলের প্রতি বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে সমদর্শী হতে।

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥
ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ॥ 

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৫. ১৮-১৯)

"আত্মবিৎ পণ্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।যাঁদের মন সমস্ত জীবের প্রতি সমদর্শী, ইহলোকে থেকেই তাঁরা জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মত নির্দোষ। তাই সেই সমদর্শী মহাপুরুষেরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।"

 একটি ঘরের চারিদিকে যদি একটি আয়না স্থাপন করা থাকে এবং যে ব্যক্তি সে ঘরে থাকবে তিনি শুধু আয়নাতে নিজেকেই দেখবেন। সে যদি সার্বক্ষণিক নিজেকেই দেখে তবে আর বিভেদ করবে কার সাথে? শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে বলা হয়েছে:

সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি ৷
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ ৷
সর্বথা বর্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ততে ॥

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৬. ২৯-৩১)

"প্রকৃত যোগী সমদর্শী হয়ে সর্বভূতে আত্মাকে দর্শন করেন এবং নিজ আত্মাতেই সর্বভূতকে দর্শন করেন ৷ 
যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূতের অবস্থিত দেখেন, আমি তাঁর অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না।
যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বন করে সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করে সর্বভূতস্থিত পরমাত্মারূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতে আমাতেই অবস্থান করেন"

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা হলো, সাত্ত্বিক ভাব আসলে, বহুধা বিভক্ত সকল প্রাণীর অভ্যন্তরে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়। তখন মানুষ নিজের মাঝে অন্যকে দেখতে পায় এবং অন্যের মাঝে নিজেকে। তখন প্রাণীমাত্রই বিদ্বেষ ভাব আপনিই চলে যায়।

সর্বভূতেষু যেনৈকং ভাবমব্যয়মীক্ষতে ।
অবিভক্তং বিভক্তেষু তজ্ জ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্॥ 

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৮.২০)

"যে জ্ঞানের দ্বারা বহুধা বিভক্ত সমস্ত প্রাণীতে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়, জীব আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর ভিন্ন হলেও চিন্ময় সত্তায় তারা এক, সে জ্ঞানকে সাত্ত্বিক বলে জানবে।"

শ্রীমদ্ভগবদগীতা বলছে, সকল জীবকেই সমদর্শী হতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই তিনি আছেন,তবেই মনের অভ্যন্তরে জন্ম নেয়া বিদ্বেষের বরফ গলবে, নচেৎ নয়। 

অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ ।
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী ।।
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।

( শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১২.১৩-১৪)

"যিনি সর্বভূতে দ্বেষহীন, বন্ধুভাবাপন্ন, দয়ালু, সমত্ববুদ্ধিযুক্ত, অহংকার বর্জিত, যিনি সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, সর্বদা সন্তুষ্ট, সবসময় সমাহিত চিত্ত, সংযতস্বভাব, দৃঢবিশ্বাসী এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত এই প্রকার ব্যক্তিই আমার প্রিয় ভক্ত।"

যে যিশু খ্রিস্ট বলেছেন, আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি , অথচ আমাদের ধর্মসভাতেই বলা হয়, যিশু খ্রিস্ট হিন্দুধর্মের অবতার, সে শান্তির, প্রেমের এবং করুণার অবতার ইত্যাদি । আমাদের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণও সর্বধর্ম সমন্বয়ের নামে অত্যাধিক আব্রাহামিক মতাদর্শের তোষণ করেছেন। বিষয়টির কোন প্রয়োজন ছিলো বলে মনে করি না। কারণ এ আব্রাহামিক মতাদর্শ তোষণ ধর্মান্তরে প্ররোচিত করে বা উস্কানি দেয়। অনেক বাঙালি ধর্মীয় গুরুরাই জেনে হোক অথবা না জেনে এ কাজটি করেছেন, যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আশেপাশেই রয়েছে। 

তথ্য সহায়তা:
১.পবিত্র বাইবেল( পুরাতন ও নূতন নিয়ম), বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা: ২০০০

২.রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, আধুনিক যুগ, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা: তৃতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর, ২০২১, পৃ. ৫৬৫-৫৬৬

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted