মুসলিম নারীরা কেন বেশি পিছিয়ে?

মুসলিম নারীরা কেন বেশি পিছিয়ে?

কোন ধর্মগ্রন্থে নারীদের কতটা স্বাধীনতা দিয়েছে সেটা আর গুরুত্ববহন করে না। কোন ধর্মের অনুসারী নারীরা কতটা স্বাধীনতা ভোগ করে সেটাই বড় কথা। অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থের প্রভাব নারীদের উপর কতটা পড়ছে সেটাই মূল প্রভাব রাখছে। পৃথিবীর ৪৩০০টি ধর্মের মধ্যে আমরা দেখি ধর্ম যত প্রাচীন সেই ধর্মগ্রন্থে নারীদের জন্য তত কঠিন আইন রয়েছে। যেমন ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে ভয়ানক নারী বিদ্বেষী আইন রয়েছে। সেসব আইন ইহুদী সমাজে আর বাস্তবায়িত হয় না। তাই ধর্মগ্রন্থে থাকা আইন তাদের নারীদের জন্য আর ক্ষতির কারণ নয়। হিন্দুদের জীবন বিধান রয়েছে মনুসংহিতাতে। সেখানেও নারীদের বিরুদ্ধে ভয়ানক ও কঠোর আইন রয়েছে আবার নারীদের খুবই নিচু দৃষ্টিতে দেখার কথা বলা হয়েছে। সেসব আইনের অধিকাংশই আর হিন্দু সমাজে কার্যকর নেই। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজেও ধর্মীয় আইন শতভাগ বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন চাইলেই তিন তালাক দেয়া যায় না বা চারটি বিয়ে করা যায় না। অবগুণ্ঠিত থাকা মুসলিম নারীদের ক্ষমতায়নে ধর্ম মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। মুসলিম সমাজেই ধর্মীয় আইন সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলেই এখন প্রধান ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে মুসলিম নারীরাই সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানে ধর্মীয় আইন সবচেয়ে বেশি কার্যকর আর বর্তমান পৃথিবীতে আফগানিস্তানের নারীরাই সবচেয়ে ভয়ানক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ধর্মীয় কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই মুসলিম নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেনি। তারা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন৷ নারীদের নিয়ে মুসলিম ধর্মগ্রন্থের কিছু আইন—

ক। নারীদের নিয়ে কোরআনের আইনঃ
১। আল বাকারার ২২৩ আয়াতে বলা হয়েছে- “তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র, অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর।”
২। আল বাকারার ২৮২ আয়াতে বলা হয়েছে- “তোমাদের পছন্দমতো দুইজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে, আর যদি দুইজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক সাক্ষী হবে।”
৩। সুরা আহজাব ৫০ আয়াতে বলা হয়েছে- “আমি তোমার জন্য তোমাদের স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি, যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ এবং বৈধ করেছি তোমার ডানহাতের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে। 
৪। সুরা নিসা ৩-৪ আয়াতে বলা হয়েছে- “যদি তোমরা আশঙ্কা বোধ কর যে, ইয়াতীমদের প্রতি ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না, তবে (তাদেরকে বিবাহ না করে) অন্য নারীদের মধ্যে থেকে যাকে তোমাদের পছন্দ হয় বিবাহ কর দুই, তিন অথবা চারজনকে। অবশ্য যদি আশংকা বোধ কর যে, তোমরা তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে এক স্ত্রীতে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীতে (ক্ষান্ত থাক)। স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যাওয়া থেকে বিরত থাক ও তারপরও অনুগত না হলে তাদেরকে প্রহার করো।
৫। সুরা আত তালাক এর ৬৫ আয়াতে বলা হয়েছে, “হে নবী (বল) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিবে তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তালাক দাও।” আল বাকারার ২৩১ ও ২৮৬ আয়াতেও এমনটা বলা হয়েছে। ইদ্দতের মধ্যে তালাক দিতে হবে। দুই বার তালাক বলার পরেও স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে। এজন্য একসাথে তিন তালাক দিতে বারণ করা হয়েছে। তবে একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাও অবৈধ হবে না। 

খ। নারীদের জন্য হাদিসের বিধান
১৷ সহিহ বুখারী ৫০৯৬: পুরুষের জন্য স্ত্রী জাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোন ফিতনা আমি রেখে গেলাম না৷
২৷ সহীহ মুসলিম ১০২৬: সালাত আদায়কারীর সামনা দিয়ে নারী, গাধা ও কুকুরের চলাচল সালাত নষ্ট করে দেয়৷
৩৷ সহীহ বুখারী ৩০৪: আমি দেখেছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে নারীরাই অধিক৷ তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাকো আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও৷ একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আর কাউকে দেখিনি৷
৪৷ সহীহ মুসলিম ৩৫৩৯: পাজরের একটি বাঁকা হাড় দিয়ে নারী সৃজন করা হয়েছে৷ তুমি তাকে সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে ফেলবে৷
৫৷ সহীহ বুখারী ৭০৯৯: সে জাতি কখনোই সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোন স্ত্রী লোকের উপর অর্পন করে৷
৬৷ সুনান আবু দাউদ ২১৪২: স্বামী স্ত্রীর মুখমণ্ডলে প্রহার করতে পারবে না৷
৭৷ সুনান আবূ দাউদ: কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে (শালীন শিক্ষার জন্য) আঘাত করলে কোন দায় থাকবে না৷
৮৷ সহীহ মুসলিম ৩৪৩৬:/সহীহ বুখারী ৪১৩৮: যুদ্ধে বন্দী বাঁদীদের সাথে আযল ছাড়াই সেক্স করা যাবে৷
৯৷ সুনানে ইবনে মাজাহ ১৮৫৩: যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে সেজদাহ করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম স্বামীকে সেজদাহ করতে৷ স্বামী জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে চাইলে স্ত্রীর তা প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত৷ ১৮৫৪: স্বামী খুশি থাকা অবস্থায় কোন স্ত্রীলোক মারা গেলে সে জান্নাতি৷
১০: সহীহ বুখারী ৬৯৪৬: বিয়ের জন্য কুমারীর কাছে অনুমতি চাইলে লজ্জাবোধ করে নীরব থাকলে, নীরবতাই তার অনুমতি৷
১১: সহীহ মুসলিম ৩২৯৮: স্ত্রীলোক সামনে আসে শয়তানের বেশে এবং ফিরে যায় শয়তানের বেশে৷ কোন মহিলাকে দেখে কোন পুরুষের যৌন কামনা জাগ্রত হলে সে যেনো তার স্ত্রীর সাথে অথবা ক্রীতদাসীর সাথে গিয়ে মিলিত হয়৷
১২৷ সহীহ মুসলিম ৩৪৩৩: স্বামী যখন স্ত্রীকে বিছানায় আহ্বান করে এবং সে না আসায় স্বামী অসন্তুষ্ট হলে স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাগণ ভোর হওয়া পর্যন্ত লা'নাত করতে থাকে৷
১৩৷ সহীহ বুখারী ৩০৫: ঋতুমতী নারী হজ্বের যাবতীয় বিধান পালন করবে তবে ক্বাবাগৃহের ত্বওয়াফ ব্যতিত৷ 
১৪৷ সুনান আবু দাউদ: ঋতুবতী মহিলাদের মসজিদে যাতায়াত হালাল নয়৷
১৫৷ সুনান আত তিরমিজি ২১২০: স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে কিছু ব্যয় করবে না৷
১৬৷ সহীহ বুখারী ৩০০৬: কোন পুরুষ যেনো অপর মহিলার সঙ্গে নিভৃতে অবস্থান না করে৷ কোন স্ত্রীলোক যেনো মাহরাম সঙ্গী ছাড়া সফর না করে৷
১৭৷ সুনানে ইবনে মাজাহ ১৮৮২: যে নারী স্বউদ্যোগে বিয়ে করে সে যেনাকারিনী৷

এমন আরো বহু উদাহরণ দেয়া যায়৷ এসব তথ্য মুসলিম পরিবারে একটা ভাবাদর্শ তৈরি করে দেয়৷ জন্মের পর থেকেই মেয়েটির উপর পিতা, ভাই, দাদা, দাদী, মাতা, চাচা, চাচী, ফুফু, খালারা একটা চাপ তৈরি করে সেই ভাবাদর্শ অনুযায়ী৷ সাধারণত মেয়েটিও সেই ভাবাদর্শেই ঢুকে যায়৷ তার জীবনে আর সাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্য জন্মায় না৷ সে বিয়ে হওয়ার অপেক্ষায় থাকে৷ তার ক্ষমতায়ন ঘটে না৷ অবধারিতভাবেই অন্য ধর্মের নারীদের চেয়ে পিছিয়ে যায়৷

প্রধান ধর্মগ্রন্থ বাদেও ধর্মগুলোর অন্যান্য গ্রন্থেও নারীদের জন্য আরো বিভিন্ন আইন/বিধান রয়েছে। এসব বিধানগুলো এসময়ের বিবেচনায় নারীর অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধক বলেই মনে করেন সভ্য দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু মৌলবাদী মানুষ মাত্রই মনে করেন, শুধুমাত্র তাদের ধর্মেই নারীদের সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ও অধিকার দেয়া হয়েছে। অন্য ধর্মে আরো কঠোরতা রয়েছে নারীদের জন্য। এক্ষেত্রে হিন্দুরা যেমন দেখায় মুসলিম নারীরা কতোটা ধর্মীয় আইনের অধীনে থাকে সেটা। আর মুসলিমরা দেখার মনুসংহিতায় থাকা আইনগুলোকে। মুসলিমরা তাওরাত ও ইঞ্জিল শরীফের বিধানের সাথেও তুলনা করে নারীদের অধিক সুযোগ দেয়ার দাবি করেন। কিন্তু মানুষতো দেখবে কোন ধর্মের নারীরা কতটা বিধান পালন করতে বাধ্য হয়। আর সেই বিধান কতটা নারী বান্ধব বা নারী জাগরণে অসহযোগিতা করছে। 

ইসলাম নারীর সমতাকে সমর্থন করে না। সম্পত্তির অধিকার বা সাক্ষীর ক্ষেত্রেও তারা পুরুষের অর্ধেক। পর্দা ও মাহরাম পুরুষ অভিভাবকদের সাথে চলাচল করা নারীর পক্ষে চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য বা উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয় না। সীমিত হয়ে যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণও। ইসলাম নারী নেতৃত্বকেও সমর্থন করে না। ফলে অনেকেই ইসলামকে নারীবাদ বিরোধী ধর্ম  হিসেবেই চিহ্নিত করে। অথচ ইসলাম পূর্ব অবস্থায় নবী মুহাম্মদ সা. এর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা রা. কেবল একজন ব্যবসায়ীই ছিলেন না, তিনি মক্কার বণিক সমিতিরও প্রধান ছিলেন। এখনো ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটা অনেকটাই পারিবারিক কারণেই হচ্ছে। যেমন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা, জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া, ভুট্টোর কন্যা বেনজির। তবে সর্বস্তরে নারীর নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন সম্ভব হচ্ছে না ধর্মীয় বাধার কারণেই। কোন জাতি তাদের নারীদের পিছিয়ে দিয়ে সভ্য দুনিয়ায় এগিয়ে যেতে পারবে না— এটা মুসলিমদেরও ভাবতে হবে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted