|সরস্বতীর মন্ত্র ও নারীর অপমান|| ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে ভূল ব্যাখ্যা।

হিন্দুবিদ্বেষীদের দ্বারা সৃষ্ট হিন্দুধর্মে নতুন এক বিকৃতি
||সরস্বতীর মন্ত্র ও নারীর অপমান||

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
হিন্দুবিদ্বেষীদের কুৎসা :-
'কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে' 'কুচ' অর্থ 'স্তন (breast)', যুগ- জুগল বা জোড়া, শোভিত- শোভা বর্ধণ বা সৌন্দর্য্য প্রকাশ। এখানে দেবী সরস্বতীর অঞ্জলীতে দেবী সরস্বতীর বর্ণনা এই ভাবে করা হয়েছে –সরস্বতী এমন দেবী যার স্তন দুটো শোভা বর্ধন করছে মুক্তার হারে। যে দেবী বীনা দ্বারা রঞ্জিত হয়েছে, হাতে পুস্তক আছে। সেই ভগবতী ভারতী দেবী কে নমস্কার করি।এই প্রোপাগাণ্ডাটা মূলত ফেসবুকে ছড়িয়েছে "মূল নিবাসী " নামক একটি ওয়েবসাইট যা বৌদ্ধ ও কমিউনিস্ট দ্বারা পরিচালিত, শেষে গিয়ে প্রত্যেকটি হিন্দু ফোবিক মঞ্চই এটাকে গ্রহণ করেছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রচারে।


বিশ্লেষণঃ
এটা নতুন কোনো ব্যাপার না, এক শ্রেণীর হিন্দুবিদ্বেষীরা এইসব বিকৃতি ঘটিয়ে আসছে সেই বুদ্ধের মৃত্যুর ১০০ বছর পর থেকেই। যাতে কিছু হিন্দুদের ব্রেনওয়াশ করে তাদের ধর্মান্তকরণ করা যায়।
সম্ভবত হিন্দুবিদ্বেষীরা এখানে কোন বাংলা অভিধান থেকে "কুচযুগ" শব্দের অর্থ "স্তনযুগল" বের করেছে। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের জ্ঞান না থাকাই বিকৃতিটিকেও ঠিকভাবে করতে পারেনি, খুব সহজে তাদের এই বিকৃতি ধরা পরে। উক্ত যে মন্ত্র টিকে ওরা বিকৃত করছে তা একমাত্র আমাদের বঙ্গভূমিতেই কেবল প্রচলিত আছে।
এখানে "কুচযুগশোভিত" তে ৩টা শব্দ যুক্তাক্ষরের দ্বারা যুক্ত হয়ে আছে। যথা - কুর্চ+যুগঃ+শোভিত, এখানে "কুর্চ" শব্দের "রেফ" টি যুক্তাক্ষরের সময় লোপ পেয়ে হয়েছে "কুচ", কিন্তু এখানে মূল শব্দটি হল "কুর্চ"। এর বাংলাতে উচ্চারণ হয় "কুর্চ" হিসাবে ও সংস্কৃতে উচ্চারণ হয় "কূর্চ/kUrca" হিসাবে। সুতরাং, উক্ত মন্ত্রের শুদ্ধ অনুবাদ নিম্নরূপ-
(মন্ত্র)
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
(শব্দার্থ)
(ওঁ)পরমাত্মা/ঈশ্বর (জয় জয়)জয় জয়কার (দেবী)দেবী (চরাচর সারে)সর্ব্ব্যাপি, (কুর্চ)বৃদ্ধা ও মধ্য অঙ্গুলীর অগ্রাংশ (যুগ)দীপ্তিময় (শোভিত)শোভাবর্ধক (মুক্তাহারে)মুক্তো মালা দ্বারা। (বীনারঞ্জিত)বীনা দ্বারা রঞ্জিত (পুস্তক হস্তে)পুস্তক হাতে,(ভগবতী)নারী রূপী পরমাত্মা/ঈশ্বর (ভারতী)বাণী (দেবী)দেবী (নমহস্তুতে)করজোড়ে প্রণাম।।
(ভাবার্থ)
সর্ব্ব্যাপি পরমাত্মারূপী দেবীর জয়,যাহার অঙ্গুলীর অগ্রাংশ দীপ্তিময় মুক্তোমালা দ্বারা শোভিত। যিনি বীণা দ্বারা রঞ্জিত, হস্তে পুস্তক(বেদ) ধারণকারী,সেই পরমাত্মারূপী বাণীদেবীকে করজোড়ে প্রণাম।
(মন্তব্য)
ইতর হিন্দুবিদ্বেষীদের স্বভাব দেখুন, এই সুন্দর মন্ত্রটির মধ্যে "স্তন" ঢুকিয়ে দিল! ওদেরই অনুবাদে ওদের জোচ্চুরি ধরা পরে যায় যখন অনুবাদ করে "কুচযুগ" এর অর্থ "স্তনদ্বয়" অর্থ্যাৎ কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে = স্তনদ্বয় শোভিত মুক্তোমালা দ্বারা অর্থ্যাৎ স্তনে মুক্তোর মালা পরতে হবে!!
এছাড়া দ্বিতীয় বারেও ওদের জোচ্চুরি ধরা পড়ে যায়, কারণ "কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে" এরপরেই আছে "বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে" অর্থ্যাৎ যেখানে মন্ত্র বলে দেবীর ৪ হাতে ৩টি জিনিস ধারণ করে আছে - দুই হাতে বীনা, এক হাতে পুস্তক এবং এক হাতে মুক্তোর জপমালা - সেখানে এই হিন্দুবিদ্বেষী ইতরেরা আগেই স্তনে মুক্তোর মালা ভেবে নিল, তারপর দেখছে এক হাতে পুস্তক ও আরেক হাতে বীনা আছে! তবে দেবীর আরেক হাতে মু্ক্তোর জপ মালা কোথাই গেলো? মূর্তিতে দেবী ৪হাতে ৩টা জিনিস ধারণ করে আছে,আমি ২টোর বর্ণনার দেবো তখন আরেকটাকে বাদ দিলাম কেন!! এইসব জোচ্চুরিপনা করতে ইতর হিন্দুবিদ্বেষীরাই নিপুন।
দেবীভাগবত পুরাণে , নবম স্কন্ধ, অধ্যায় ১, ২ ও ৪ তে উল্লেখ আছে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ নিজে দেবীর পূজা করে দেবী পূজার প্রবর্তন করেন এবং দান স্বরূপ তিনি দেবীকে সর্ব্বত্তম একটি মু্ক্তোমালা দান করেন, যা দেবী জপমালা হিসাবে গ্রহণ করেন। যার জন্য দেবীমূর্তিতে দেবীর এক হাতে মুক্তোর জপমালা বর্তমান।
(এইসব পৌরাণিক উপাখ্যান)
এরপর যদি আমরা বেদ থেকে বিশ্লেষণ করি তবে বীনা, পুস্তক ও জপমালা এই তিনটির উল্লেখ পাবো প্রতীকী হিসাবে! ঋগ্বেদের আধিদৈবিক ভাষ্যে ১.৩.১০-১২ ও ৬.৬১.১-১৪ তে দেবী সরস্বতীকে মূলত সর্ব্ব্যাপি সূর্যাগ্নি ও নারীরূপী ঈশ্বরের একটি স্বরূপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদ ১.৩.১০-১২ তে তিনি বাণী, মূর্তিতে যার প্রতিক এই বীনা। ঋগ্বেদ ১.৩.১০ ঋগ্বেদ ৬.৬১.১-৩ তিনি জ্ঞান, মূর্তিতে যার প্রতিক এই পুস্তক(বেদ)। ঋগ্বেদ ৬.৬১.৪-৫ তিনি দীপ্তময় জ্যোর্তির মাতা এবং অন্ধজ্ঞানের নাশক, মূর্তিতে যার প্রতীক শ্বেতশুভ্র এই মুক্তো জপমালা।

✍️ সুমিত ভট্টাচার্য

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted