মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল ভারত, আফ্রিকা, ইউরোপ- সবখানে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ তার উত্তরাধিকার রেখে গেছে। এরাই ইতিহাসের অধ্যাপক হয়েছে, স্থাপত্যবিদ হয়েছে, ইতিহাস লেখক হয়েছে- ফলে সাম্রাজ্যবাদের হয়ে এরা কথা বলেছে। একটা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে পৃথিবীতে গ্লোরিফাই করে বলা গল্প আর কোন সাম্রাজ্যবাদের কপালে জুটেনি।
যদি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের কথা বলি, তাদের শাসনামলে প্রগতির অগ্রগতির ঢেউ সেই উপনিবেশ দেশগুলিতে আছড়ে পড়েছিল। তবু কেউ যদি বলে ভারতে ইংরেজদের অমুক তমুক ভালো কাজ আছে- তাহলে সে সরাসরি ইংরেজদের দালাল হয়ে যাবে! কিন্তু ভারতে মুসলমানরা এসেছিল বলেই এখানে অমুক তমুক ভালো কাজ হয়েছিল বলা মনে হচ্ছে ‘ইসলামের ইতিহাস চর্চা’! স্পেন তথা ইউরোপে ইসলামী শাসন, আফ্রিকা, ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন এসব নাকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে বুঝতে হবে। না হলে ইসলাম সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা তৈরি হবে। কোন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ নিয়ে সাহিত্য ইতিহাস স্থাপত্যবিদ তৈরি করার নজির আর কোথাও নেই। কারণ সাম্রাজ্যবাদ একটি নিন্দনীয় কাজ। তাহলে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের বেলায় পৃথক ঘটনা ঘটল কেন? এর কারণ আছে।
ধর্মান্তকরণ, বংশবিস্তার ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের হয়ে কথা বলার উত্তরাধিকার সৃষ্টি করেছে। আফগানিস্থানে যারা বুদ্ধ মূর্তি ভেঙেছে, মসুলে যারা জাদুঘরে মূর্তি ভেঙেছে এদের পূর্ব পুরুষ ভারত থেকে দাস হয়ে এসব অঞ্চলে এসেছিল। এইসব মূর্তি পুজারীরা গণিমতের মাল হিসেবে পারস্যের দাস বাজারে বিক্রি হয়েছিল। এরাই ধর্মান্তরিত মুসলমান। এদের বংশধররাই সুরমা চোখে ‘ইসলামী আমিরাত’ সৃষ্টি করেছে। চরমভাবে মূর্তি বিদ্বেষী হয়েছে। ভারতে তিনশো বছরের মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলার মত মুসলমানরা আছে। স্পেন-ফ্রান্সের মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কথা বলার মতও উত্তরাধিকার আছে। গোটা বিশ্বে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ‘ইসলামের ইতিহাস’ নামের এক সাবজেক্ট তৈরি করা হয়েছে যা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে গাওয়া এ স্তূতিগাথা।
মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ যেখানেই গেছে সেখানেই তারা নিজেদের দেশ বানিয়ে ফেলেছে। এটাই তাদের জন্য আজকে মুখরক্ষার একমাত্র অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ দখলকারী দেশকে নিজেদের দেশ বানালেই কি ইতিহাস সেটাকে সাম্রাজ্যবাদ বলবে না? আমেরিকার সাদারা ইংলেন্ড থেকে এসে আমেরিকার আদিবাসীদের মেরেধরে দখল করে নিয়েছিল। আমেরিকার রাজ্যগুলোর নামগুলো খেয়াল করে দেখবেন সেগুলো আদিবাসীদের ভাষায় রাখা। সাদারা আমেরিকাকে নিজেদের দেশ বানিয়ে নিয়েছিল। এমনকি ব্রিটিশ অধিনতা অস্বীকার করে এই সাদারাই আমেরিকাকে স্বাধীন করেছিল। তবু আজো আমেরিকার ইতিহাস বলা হলে সাদাদের উপনিবেশ উল্লেখ করা হয়। তাহলে ভারতে মুসলিম শাসনের হানাদারী ইতিহাস কেন বলা যাবে না? ইরফান হাবিব কি ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়ানো একজন ঐতিহাসিক নন? বামপন্থীদের জানের দুশন হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, অথচ তারা ভারত, স্পেন, ফ্রান্স, আফ্রিকায় ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কেন?
মুঘল আমলে কোলকাতা বা দিল্লিতে থাকা কোন লোক ভারতবর্ষকে নিজের “দেশ” হিসেবে কল্পনাই করতে পারে নাই। সেই ধারণাই ছিল না। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকালেই ভারতবাসী গোটা ভারতকে নিজের দেশ হিসেবে বুঝতে শিখেছে। ইংরেজ আমলেই দেশপ্রেম কি সেটা ইংরেজদের খোলা স্কুলে পড়ে ইংরেজি সাহিত্য থেকে দেশ, দেশপ্রেম প্রথম ভারতের মানুষ জেনেছে। পরাধিনতার জ্বালা, স্বাধীনতার আকাঙ্খাও সেদিন ভারতবর্ষের মানুষ বুঝতে পেরেছে। সারা দুনিয়াতে ইংরেজরা তাদের উপনিবেশে কম অবদান নেই। এসব বলা রীতিমত নিষিদ্ধ। তাহলে আপনি সাম্রাজ্যবাদের দালাল। কলোনিয়াল যুগের দাসত্ব বহন করছেন। আপনাকে হেগেল মার্ক্সস দিয়ে ধরে, এডওয়ার্ড সাঈদ দিয়ে ডলে, অরুন্ধতি রায়কে পিষে প্রমাণ করবে আপনি ইংরেজদের দালাল! নয়া সাম্রাজ্যবাদী! কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আপনি স্তুতি করুন, বলনু, স্পেনে মুসলমানদের অপদান, ফ্রান্সে মুসলমানদের কীর্তি, ভারতবর্ষে মুসলমানদের গৌরব- আপনি অমুসলিম হলে হবেন সেক্যুলার, মুসলমান হলে হবেন ‘মুসলিম ঐতিহাসিক’। কিন্তু এই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করলেই আপনি ইসলাম বিদ্বেষী! আপনি হিন্দুত্ববাদী!
বখতিয়ার খিলজি, তৈমুর লং, সুলতান মাহমুদ, মুহাম্মদ বিন কাশিম ভারতবর্ষে এই লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের পক্ষে কথা বলার মত উত্তরাধিকার ইসলামী সাম্রাজ্যবাদে সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মান্তরকরণ, দাস, ধর্ষণ একটি সাম্রাজ্যবাদের গর্বিত উত্তরাধিকার সৃষ্টি করে দেয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ ভারতে সেটি সংগত কারণেই করতে পারেনি। ইউরোপীয়ান জ্যাতাভিমান তাদেরকে নেটিভদের সঙ্গে রক্তের মিশ্রণ ঘটাতে দেয়নি। নইলে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে হুবহু ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের মত ইতিহাস রচিত হতো। ইংরেজরা যে ইতিহাস লিখেনি তা নয়। কিন্তু সে ইতিহাস সাহেবদের লেখা বলেই সহজেই বামপন্থী ও মুসলিম লীগাররা উড়িয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু ইংরেজ উত্তরাধিকার থাকলে সেটি সম্ভব হতো না।
আমার পয়েন্ট এখানেই। ইসলামের ইতিহাস, মুসলিম ইতিহাস নামে যা প্রচলিত তা একটি সাম্রাজ্যবাদের গুণকীর্তি। সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে মুসলিম ইতিহাসকে আগে স্বীকার করে নিতে হবে। হানাদার ও সাম্রাজ্য স্থাপন কোন গুণ কিনা সেটি বিবেচনা করে তারপরই পৃথিবী সকল সাম্রাজ্যবাদের কপালে একই ফলাফল আমি দিতে চাই। একই যাত্রায় পৃথক ফল নয়...।
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................