বাঙালি মুসলমান নামাজ বলে এটা ফার্সি শব্দ। আরবিতে এটা ‘সালাত’। এখন আরো সহি মুসলমান হতে সালাত বলা শিখছে। নামাজ ও সালাত কোনটাই বাঙালি মুসলমানের নিজের ভাষা নয়। ফার্সিতে রোজা বলছে, আরবিতে সেটা সওম। এখন সওম ব্যবহার বাড়ছে। বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতা কোথায় এখানে? বাঙালি হিন্দু থেকে ওহাবি আন্দোলনের মাধ্যমে যে আলাদা হবার সাম্প্রদায়িক আন্দোলন, সেখানে থেকে কায়কোবাদ, ফরুখ আহমদ, গোলাম মুস্তফা হয়ে আহমদ ছফা-সলিমুল্লাহ-রাইসুদের বাঙালি মুসলমানবাদীত্বের ব্যবহারিক সামাজিক ও ধর্মীয় শব্দের কোথায় নিজস্বতা? হয় আরবি, না হয় ফার্সি না হয় উর্দু, অন্যের বাপকে নিজের বাপ বলার নাম নিজস্বতা?
নামাজ বা সালাতের বদলে প্রার্থনা, রোজা বা সওমের বদল উপবাস ব্যবহার করেনি কেন বাঙালি মুসলমান? ধার্মিক মুসলমান সন্তানের নাম রাখে ‘আবদুল্লাহ’। অর্থ খোদার দাস বা আল্লার দাস। খোদা ফার্সি শব্দ। খোদা মানে ঈশ্বর। হরি অর্থও ঈশ্বর। তাহলে বাঙালি মুসলমানের নাম ‘হরিদাস’ রাখা হলো না কেন? ঠিক কি কারণে মুসলমানের নাম হরিদাস রাখা গেলো না? পারস্যবাসী যদি আজো অগ্নিপুজারীকালের প্রার্থনাকে নামাজ বলে সেটাকেই সালাতের সমার্থক শব্দ বানাতে পারল তাহলে আপনাদের ‘হরি’ শব্দটি খোদা বা আল্লার বদলে ব্যবহার হলো না কেন? এটাই তো নিজস্বতা! পারস্যকে ইসলাম দখল করে ফেললেও ওরা ওদের নিজস্বতা ভাষায় ধরে রেখেছিল। তাই অগ্নিপুজারী থাকার সময়ও নামাজ রোজা বলত, মুসলমান হবার পরও প্রার্থনাকে আরবি সালাত বলেনি। মূলত পারস্য দেশ থেকে আসা ধর্ম প্রচারকদের কাছ থেকেই এদেশের লোক নামাজ রোজা শিখেছিল। তারা জানত না এ দুটো শব্দ কুরআনে নেই। সাধারণ ধার্মিক মুসলমানদের কথা বাদ। স্বঘোষিত ‘বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকরা’ তাদের সাহিত্য ভাষা হিসেবে কেন নামাজ রোজা পানি নানা নানী চাচা চাচী ব্যবহার করলেন? মীর মোশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধুতে আল্লার বদলে ‘পরমেশ্বর’ লিখলেন। আমার প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতার সোনার পাথরবাটিটি কোথায়? আরবি ফার্সি উর্দু শব্দ কেমন করে তার নিজস্বতা হলো?
বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যে মুসলমানদের জীবন তুলে ধরবেন, সেখানে তাদের নিজস্বতার ভাষায় তারা কথা বলবেন। কোথায় সেটা? ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, এশার- এই নামাজগুলো বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের কেউ নিজস্ব ভাষায় উল্লেখ করেছে? উল্টো কোন লেখক যখন নিজের বই বের করার আশাবাদের সঙ্গে ইনশাল্লাহ লিখেন, আলহামদুরিল্লাহ বলেন- তারা আবার নিজেদের নিজস্বতার দাবী করে কিভাবে!
রোজাকে আজ থেকে উপবাস বলে ডাকা শুরু করুন তো দেখি! কোন যুক্তিতে এটা বাতিল করবেন? বাঙালি হিন্দু এটা ব্যবহার করে তাই তো? বেশ, তাদের থেকে আলাদা হবেন, হোন। তাহলে নিজেদের ভাষাটা কোনটা? রোজা (ফার্সি), সওম (আরবি)! ছফা ভাইয়ের নিজস্বতার ভাষা এখানে কোথায়? বাংলাদেশের উপন্যাসে চোখের পানি, খাবার পানি লেখে। কেন লেখে? মুসলমান সামাজিক সংলাপে এটা ঠিক আছে। কিন্তু সাহিত্যের ভাষায় ঠিক কেন পানি ব্যবহার হয়? এই যে আলাদা হতে চাওয়া, সেটা অন্যের ভাষায় কেমন করে নিজস্বতা হলো?
আসিফ নজরুল ইনশাল্লাহ আলহামদুরিল্লাহ জাজাকাল্লা খয়রান ব্যবহারকে তার মুসলমানিত্ব বলেছেন। এই মুসলমানিত্ব আরবি শব্দে। এই মুসলমানিত্ব আরবি ভাষার উপনিবেশনে। আরবি না জানা ননআরবদের উপর এটা আরবি ভাষার উপনিবেশ। আরবিতে লেখা পর্ণগ্রাফি দেখলেও এরা পবিত্র জ্ঞানে চুমু খাবে। আসিফ নজরুল ধার্মিক এতে আমার কোন সমস্যা নেই। তিনি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, হিন্দি ভাষা টেনে এনেছেন। কেন এসব নিয়ে প্রগতিশীলদের মাথা ব্যথা নেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলা ভাষার আদিরূপ হচ্ছে চর্যাপদ যা ছিল বৌদ্ধ ধর্মীয় গীতি। ফলে এই ভাষাটা ‘হিন্দুয়ানী’ এতে কোন সন্দেহ নেই। হিন্দুয়ানী আবার সনাতন ধর্ম ঠাউড়াবেন না। হিন্দুয়ানী মানে সিন্ধু সভ্যতার সকলের সংস্কৃতি। আসিফ নজরুলের নামটাই সিন্ধু সভ্যতার নামগুলোর মধ্যে পড়ে না। এটা আরবি নাম। তাদের নিজস্বতা দাবীর শুরুটাই হাস্যকর। নিজেদের নামটাই আরবি। ইনশাল্লাহ, আলহাদুরিল্লাহ, জাজাকাল্লা খয়রানের নিজস্ব পরিভাষা ব্যবহার করে নজরুল সাহেবরা ধর্ম চর্চা করলে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। বাঙালি হিন্দু বৌদ্ধদের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করতে আরবি ফার্সি উর্দু গ্রহণ করা মানে অন্যের বাপকে নিজের বাপ বলে গর্ব করা!
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................