ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা জায়গায় দলবেঁধে কাতার দিয়ে নামাজ পড়ার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। যেখানে নামাজের চর্চা হয় সেখানে আধুনিকতা, প্রগতিশীলতার চর্চা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জামে মসজিদ আছে। স্বাধীনতার পর বিশিষ্ট পন্ডিত লেখক ভিসি সৈয়দ আলী আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ নির্মাণে বিরাট ভূমিকা রাখেন। জ্ঞান চর্চার জায়গায় মসজিদ বানালে সেখানে মুক্তচিন্তা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ বানানোর কোন কারণই ছিল না। তখনই ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হতো। ছত্রতত্র মসজিদে ছয়লাব।
স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ আসলে কাদের ধারণ করবে, কাদের ধর্ম সংস্কৃতিকে আইকনিক করবে সেটি স্পষ্ট হয় যখন সরকারীভাবে রমনা কালীমন্দির তৈরি করতে বাঁধা দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দির গুড়িয়ে দিয়েছিল বোমাবর্ষণ করে। ঢাকায় অনেক দূর থেকে এই মন্দিরের চূড়া দেখা যেতো। রমনা কালীমন্দির ঢাকার একটি আইডেন্টি বলা চলে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালি মুসলমানের একটা বড় উপকার করে গিয়েছে। নিজেদের কাঁধে দায় নিয়েছে তারা। নয়ত বাঙালি মুসলমানকে রমনা কালী মন্দিরের এতবড় চূড়া কি করে হজম করত?
আমরা দেখতে পাই দেশ স্বাধীনের পর রমনা কালীমন্দির আবার আগের মত গড়তে চাইলে সরকার বাঁধা দেয়। পরিস্কার হয়ে যায় বাংলাদেশ বাস্তবিক মুসলমানদের দেশ। পাঞ্জাবীদের কাছে অধিকার চাইতেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলতে হয়েছে। দেশ স্বাধীনের মাধ্যমে সে সংকট যেহেতু দূর হয়েছে তাই দ্রুত মুসলিম জাতীয়তাবাদে ফিরতে দেরি হয়নি...।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীলতার খুব বেশি উদাহরণ নেই। এমন কোন মুভমেন্টের ইতিহাস দেখাতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রও এক। তাহলে এরকম খোলা জায়গায় নামাজ পড়ছে কেন? কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেমেয়েরা একত্রে আড্ডা দেয়, স্টাডি করে, এটাই সহ্য হচ্ছে না। আড্ডার জায়গায় এরকম নামাজ পড়লে অস্বস্তি তৈরি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা মসজিদ বানিয়েছিল তারাই এই খোলা জায়গায় নামাজ পড়াদের পূর্ব পুরুষ। সৈয়দ আলী আহসান শিল্প সাহিত্য বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। তিনি যদি মনে করে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ দরকার, তাহলে অন্যরা কেন মনে করবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের একত্রে উঠাবসা বন্ধ করা দরকার। দুটোই ‘কান টানলে মাথা আসা’র বিষয়। নামাজ আপনাকে ছেলেমেয়েদের ‘ফ্রি মিক্সিং’ বিরোধী করে তুলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ধর্ম থাকলে সে কি করে প্রগতিশীলতার চর্চা করবে? যে রাষ্ট্র ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, রমনা কালীমন্দিরের চূড়াকে আর সুউচ্চ করতে দেয় না, সেখানে যে মুসলিম আধিপত্যবাদ বিরাজ করে সেখান থেকেই তো কট্টর মুসলিম মানসিকতার নাগরিক বের হবে।
ঢাকা শহরের নামকরণে সঙ্গে জড়িয়ে আছে হিন্দু কিংবদন্তি। বল্লাল সেনের মা তীর্থ করতে গিয়ে এখানে ঢাকনার নিচে একটি দেবী মূর্তি পেয়েছিলেন। তাই দেবীর নাম হয়ে যায় ঢাকেশ্বরী। সেখানে একটি মন্দির গড়ে বল্লাল মাতা। নাম হয়ে যায় ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’। সেই ঢাকেশ্বরী থেকেই ‘ঢাকা’ শব্দের জন্ম। সেটাই হয়ে যায় ঐ স্থানের নাম। বিস্তৃত হতে থাকে ঢাকার আকার। এই ইতিহাস বা কিংবদন্তি বাঙালি মুসলমানের কাছে আজ অস্বস্তিকর। তাই বরাংবার সুবে বাংলা, সুলতানী আমলের বাংলা বলেই আইডেন্টি তৈরি করতে চেয়েছে। বাংলা একাডেমির গবেষণা বইপত্র দেখলে সেটি বুঝা যায়। আমাদের মননের মধ্যে সমস্যা ছিল। ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। ফলে বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়- সেটাই ঘটছে আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা জায়গায় নামাজ পড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চরিত্রের কোন বদল করা হয়নি। একটা সহিষ্ণু মাল্টি কালচারাল সোসাইটি, ঐতিহ্যের ধর্মনিরপেক্ষ লালনের কোন রকম মানসিকতা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না বলেই রমনার কালীমন্দিরের চূড়াকে আমার আর গড়তে দেইনি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের সে সুযোগটা দিয়েছে। কেউ তো আর বলতে পারবে না রমনা কালীমন্দির আমরা ভেঙেছি!
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................