“অনেক সময় শব্দকে কলঙ্কিত করা হয়। ইচ্ছা করেই করা হয়। শব্দেরও শত্রু আছে। যেমন— জায়োনিজম বা জায়োনবাদ। যদিও ‘জায়োনবাদ’ কথাটি ‘জায়োনিজম’ শব্দের ভুল, বিভ্রান্তিকর, ও বিকৃত অনুবাদ, কিন্তু বোধগম্যতার স্বার্থে এ শব্দটিই আমাকে ব্যবহার করতে হচ্ছে। জায়োনবাদ কী? ধরা যাক কোনো পরিবার একটি বাড়িতে বহু শতক ধরে বাস করছে। ফর ম্যানি জেনারেশন্স। হঠাৎ বাড়িটি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হলো, বা কোনো কারণে বাড়িটি তারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। পরিবারটি দূরে, বহু দূরে, অন্য কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিলো, এবং অনেক দশক ধরে সেখানেই বাস করতে লাগলো। কিন্তু পুরাতন বাড়িটিকে তারা ভুলতে পারলো না। একদিন পুরাতন বাড়িটিতে ফিরবে, এ স্বপ্ন প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন করতে লাগলো। নানা অনুষ্ঠানে, খাওয়ার টেবিলে, অবসরে, বছরের পর বছর ধরে তারা সন্তানদেরকে ঐ পুরাতন বাড়ির গল্প বলতে থাকলো। বাড়িটিকে ঘিরে নানা আফসোস ও স্মৃতি তাদের ভেতর জীবিত রইলো। এবং একসময়, পরিবারটি অর্থ, সাহস, ও ক্ষমতা সঞ্চয় করে পুরাতন বাড়িটিতে ফেরার উদ্যোগ নিলো। এই যে আমার হারিয়ে যাওয়া বাড়ি, হারিয়ে যাওয়া জন্মস্থান, সেটি ফিরে পাওয়ার অদম্য উদ্যোগ, অদম্য স্পৃহা, অদম্য আয়োজন, এটিই জায়োনিজম।
হাজার হাজার বছর আগে ইহুদীরা, অর্থাৎ বনী ইসরায়েলরা, ‘ফিলিস্তিন অঞ্চল’-এ বসবাস করতো। এ কথা কোরানে আছে, বাইবেলে আছে। ইতিহাসের মোটা বইগুলোতেও এর প্রমাণ মেলে। কিন্তু বিভিন্ন শতকে, নানা অত্যাচার, নির্যাতন, দখলী কাণ্ডের শিকার হয়ে বনী ইসরায়েলরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে থাকে। বসতি গড়তে থাকে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে। এই যে একটি সম্প্রদায়ের এমন কালেক্টিভ ডিসপার্সন, মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যাওয়া, যেটিকে আমরা ডায়াস্পোরা বলি, সেটির পেছনের কারণগুলো তো সুখকর নয়। নবী মুহাম্মদও এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। মক্কা থেকে মদীনায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর প্রাথমিক উম্মতরা, তারা তো ইহুদীদের মতোই ডায়াস্পোরা ছিলেন। বাড়িছাড়া হতভাগ্য মানুষ। নবী কি একসময় মক্কা ফেরত যান নি? একদিন পুরাতন বাড়িতে ফিরবেন, এ স্বপ্ন কি তাঁর ভেতর ছিলো না? নবীর সাহাবীরা কি পুরাতন বাড়িতে ফেরার জন্য যুদ্ধ, চ্যালেঞ্জ, ও বাধার সম্মুখীন হন নি? আপনি বনী ইসরায়েলদের জায়োনিস্ট বলছেন, আপনার মত ও বিশ্বাসের সাথে কারও মিল না হলে তাকে জায়োনিস্ট আখ্যা দিয়ে বিদ্রুপ করছেন, কিন্তু পছন্দের মহাপুরুষরাও যে জায়োনিস্ট ছিলেন, এটি ভেবে দেখছেন না। পৃথিবীর বহু মহারুষই জায়োনিস্ট। জায়োনিস্ট কোনো খারাপ শব্দ নয়। আমি জায়োনিস্ট, এর অর্থ হলো, আমি একদিন আমার পুরাতন বাড়িতে ফিরবো, এবং বাড়িটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।
বিষয়টি এমন নয় যে, থিওডর হার্জেল বই লেখার কারণে ইহুদীরা জায়োনিস্ট হয়ে গেলো। বরং প্রথম যেদিন তারা ঘর ছেড়েছিলো, সেদিন থেকেই জায়োনিস্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মানুষ ভারতে চলে গিয়েছিলো। শখ করে যায় নি। যেতে বাধ্য হয়েছিলো। তাদের ভেতর কি ঘরে ফেরার তাড়া বা জায়োনিজম ছিলো না? ইহুদীদের ভেতর সাম্প্রদায়িক ঐক্য ঐতিহাসিকভাবেই প্রবল। তারা যখন মার খেয়েছে, একসাথে মার খেয়েছে। যখন সুখে থেকেছে, একসাথে সুখে থেকেছে।
রাশেদুন খলিফারা যখন ফিলিস্তিন জয় করে, কেবল তখন থেকে ফিলিস্তিনে মুসলিমদের বসবাস। মাত্র সপ্তম শতকের ঘটনা। নবীর জীবদ্দশায় ফিলিস্তিনে কোনো মুসলমান ছিলো না। নবী মারা যান ৬৩২ সালে। খলিফারা ফিলিস্তিন জয় করেন ৬৩৪-৬৩৮ সালে। ৬৩৬ সালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে বাইজ্যান্টিনরা পরাজিত না হলে, ফিলিস্তিনে কোনো আরব বা মুসলিম বসতি থাকতো না। হাজার হাজার বছর ধরে সেখানে ক্যানানী, বনী ইসরায়েল, ও ফিলিস্টিনরা ছিলো। এই পুরো জায়গাটিকে একসময় ক্যানান বলা হতো। নবী ইব্রাহিম, নবী মূসা, নবী ইয়াকুব, তাদের গল্পে জায়গাটাকে আমরা ক্যানান হিশেবেই পেয়েছি। এই যে জেরুজালেম, এটি ক্যানানীদের নগর-রাষ্ট্র ছিলো। উগারিত, সিডোন, তাইয়ার, এ নগর-রাষ্ট্রগুলোও ক্যানানীরা সৃষ্টি করেছিলো। ক্যানানীরা কি মুসলিম ছিলো? মোটেও নয়। এরা পলিথিস্টিক ছিলো। নবী ইব্রাহীমের বাবার মতো। বাল, এল, ও আশিরা— এই তিন দেবতার উপাসনা করতো। আরবি ভাষার, অর্থাৎ কোরানের ভাষার, আদি উৎসও কিন্তু ক্যানানীদের বলা ভাষা।
এবং এই ক্যানানীরা, ইব্রাহিম ও অন্যান্য নবীর প্রভাবে, একসময় বনী ইসরায়েল বা ইসরায়েলী হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে। মূল ক্যানানীদের সাথে এদের পার্থক্য হল, এরা ছিলো একেশ্বরবাদী। উপাসনা করতো সর্বশক্তিমান তাওহিদী ঈশ্বর ইয়াহওয়ের। আমরা এখন যাকে আল্লাহ ডাকি, একসময় তিনি ছিলেন ইয়াহওয়ে। বাদশা ড্যাভিড বা দাউদ (আঃ), বাদশা সলোমন বা সোলায়মান (আঃ), তাঁরা এই বনী ইসরায়েলের সদস্য। ইসরায়েল ও জুডা, এই দুই রাজ্য বনী ইসরায়েলদের তৈরি।
এবং এই ক্যানান অঞ্চলে, আরেকদল মানুষ ছিলো ফিলিস্টিন নামে। তাদের আদি উৎস ছিলো অ্যাইজিয়ান বা এনাটোলিয়া এলাকা। তারা মূলত সমুদ্রঘেঁষা সাগরজীবী মানুষ। গাজা, আশকেলোন, আশদোদ, এক্রোন, ও গাথ, এই নগর-রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্টিনরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো। ফিলিস্টিনদের সাথে বনী ইসরায়েলদের একটি দাঙ্গা সবসময় লেগেই থাকতো। বাইবেলে যে স্যামসন ও দেলিলা, বা ড্যাভিড ও গোলিয়াথের গল্প পাই, তা মূলত ফিলিস্টিনদের সাথে বনী ইসরায়েলদের সংঘাত। বনী ইসরায়েল বা ইহুদীদেরকে যদি মুসলমানদের পূর্বপুরুষ ধরা হয়, তাহলে এটাও ধরতে হবে যে, ফিলিস্টিনরা ছিলো মুসলমানদের পূর্বপুরুষের আদি শত্রু।
ফিলিস্টিনরা তো মুসলমান ছিলো না। নাকি বেকুবরা ফিলিস্টিন নাম দেখে তাদেরকে মুসলমান কল্পনা করবে? ফিলিস্টিনরাও পলিথিস্ট ছিলো। তারা দেবতা দাগোন, বাল-জেবুব, ও দেবী আশতোরেথের উপাসনা করতো। ফিলিস্টিনদের কোনো আল্লাহ ছিলো না। হিব্রু বাইবেলে উল্লেখ আছে, গাজা শহরে দেবতা দাগোনের মন্দির ছিলো। ফিলিস্টিনরা মুসলমান হওয়ার কোনো সুযোগ পায় নি। কারণ ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের বহু আগেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো, বা মিশে গিয়েছিলো অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে। খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকের দিকে তাদের আবির্ভাব হয়েছিলো, এবং হারিয়ে গিয়েছিলো অষ্টম শতকের দিকে। যদিও ফিলিস্তিনে কোনো আদিবাসী ফিলিস্টিন এখন নেই, আছে শুধু আরব ফিলিস্তিনী, কিন্তু তাদের নামটা, প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনের সাথে আজও গেঁথে রয়েছে। কারণ তাদের প্রাচীন আবাসভূমিটি ফিলিস্তিয়া নামে পরিচিত ছিলো। এই যে আমরা এতো ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন বলি, এ নামটাও মুসলমানদের দেয়া নয়। এটা গ্রিকদের দেয়া। যারা হেরোডোটাস পড়েছেন, তাদের তা জানার কথা। আমি আশ্চর্য হয়েছি যে, কোরানে ‘ফিলিস্তিন’ শব্দের কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের পাঁচশো বছর আগে লেখা কাফের হেরোডোটাসের বইয়ে আছে। নাকি নবী যা জানতেন না, তা জিব্রাইলও জানতেন না? নবীর জীবদ্দশায় মুসলিমরা ফিলিস্তিন আবিষ্কার করতে পারে নি বলেই কি ‘ফিলিস্তিন’ শব্দটি কোরানে নেই?
সুতরাং বলবো— জায়োনিজম, জায়োনিস্ট, জায়োনবাদী, এসব শব্দ শুনলেই ঘৃণায় নাক কুঁচকানোর দরকার নেই। সব ধর্ম, সব সম্প্রদায়, সব জাতির মধ্যেই কমবেশি জায়োনবাদী চেতনা আছে। হয়তো নাম বা রঙটা ভিন্ন। বুদ্ধির নখ দিয়ে রঙটুকু খুটলেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে।”
.
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
(অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে / জায়োনিস্ট কে?)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................