বাঙালি মুসলমানদের নিজস্বতা বলতে কিছু নেই।

বাংলাদেশের ঘটনাক্রমের সঙ্গে মিল আছে ইরানের, আফগানিস্থানের। অনেকে বলেন, বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক মনন এখানে কখনোই কট্টর মৌলবাদী ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা হতে দিবে না। তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, বাঙালিদের মত শংকর একটা জাতির সংস্কৃতির চাইতে ঢের ঢের সমৃদ্ধ ও স্বাতন্ত্র সাংস্কৃতিক বলয় ছিল পারস্যদের। ওরা মুসলিম শাসনে পদাণত হবার পরও নামাজ রোজা খোদা হাফেজ জাতীয় অগ্নিপূজক ফার্সি শব্দগুলি বর্জন করেনি। সেই তারাই মুসলিম শাসনের যুগে নিজেদের বর্ণমালা রক্ষা করতে পারেনি। আরবী হরফে তাদের ফারসি লিখতে হয়। ‘পাহলভী’ লিপি হারিয়ে যায় মুসলিম শাসনে। গণহারে ধর্মান্তর হয়। ঠিক কি উপায়ে কেমন করে পারস্যবাসীদের মুসলমান করা হয়েছিল তার কোন ইতিহাস রাখা হয়নি।

এখন কেউ বলতে পারেন আমাদেরও পাকিস্তানীরা উর্দু শেখাতে পারেনি। আমরা বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছি। আসলে এখানে বাংলা ভাষা রক্ষার পিছনে মুসলমানদের কোন মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদই ছিল না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আগে কারোর কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তো পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ভয়ে ছিলেন তাকে কেউ পিটাতে আসে কিনা! আসলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষকদের ৯৫ ভাগ ছিলেন তখনো হিন্দুরা। এরাই বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ছাত্রদের উশকে দিতেন। ফলে ৬৪ সালে হিন্দু শিক্ষকদের টার্গেট করে হুলিয়া জারি করে এনিমি আখ্যা দিয়ে তাদের দেশছাড়া করা হয়। ২০২৪ সালেও একইভাবে হিন্দু শিক্ষকদের টার্গেট করা হয়েছে। এখনো তাদের নিয়ে ভীত শাসকরা। মনে করা হয় এরা মুসলমানদের শতভাগ মুসলমান থাকতে না দেয়ার পিছনে দায়ী।

আমার কথাগুলো সত্য কিনা তা ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে অনুসরণ করে গেলে জানতে পারবেন। বাঙালি মুসলমানদের নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। তাদের সাংস্কৃতি বন্ধন খুবই দুর্বল। তারা আত্মপরিচয় সংকটে ভোগে। তারা কোন উত্সবে প্রদীপ প্রজ্জলন, প্রভাত ফেরি, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘হিন্দুয়ানী’ মনে করে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। এরা কোন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে একশভাগ হয়ে গেলে তাদেরকে একশো ভাগ কট্টর খোমিনি স্টাইলের শাসনে নেয়া কোন ব্যাপার না। বিমানের চাকায় ঝুলে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী না হয় দেশ ছাড়বে। এমনটা তো ইরান আফগানিস্থানে হয়েছে। ফলে বাংলার ভাটিয়ালী ভাওয়াইয়া দিয়ে কিছু রক্ষা করা যাবে না। লালন হাসন রাজা দিয়ে রুখে দিতে পারবেন না। আপনারা কি জানেন ১৮২০ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত শরীতুল্লাহ তীতুমীর এই মাঝিমাল্লা গড়োয়ানদের গানের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন? ওহাবী আন্দোলন রাজনৈতিক হবার আগে ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। মুসলমানরা গান গাইবে না হিন্দুদের মত। এটাই ছিল তাদের প্রচারণা। হিন্দুদের মত ধূতি পরবে না। হিন্দুদের উল্টোটা করবে। হিন্দুদের মত নাম রাখবে না। নামের আগে ‘শ্রী’ লিখবে না যা ছিল বাঙালি সংস্কৃতি। নবান্ন, বর্ষবরণ, গানের আসর, বাউল সঙ্গ সব কিছুর বিরুদ্ধে ওহাবীরা পুরো বাংলাকে প্রভাবিত করে ফেলে। ওহাবীজম তখন থেকে মোল্লাদের মাধ্যমে মসজিদে গিয়ে ঢোকে। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা তখন থেকে মসজিদ গিয়ে ধাক্কা খায়। খুব প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমানও তাই সারা জীবন মনের গভীরে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে।

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা না জানানো অবশ্যই একটা সংকেত। ৭১-কে পছন্দ করে না কারা? তাদের মিশনটা কি? বাংলাদেশে শরীয়া শাসন বা ইসলামিক রিপাবলিক। বাংলাদেশ ইরান আফগান হতে পারবে খুব সহজেই। বাঙালি পারস্যদের মত উন্নত জাতি নয়। তারাই ইসলামী উপনিবেশ থেকে নিজেদের বর্ণমালাকে রক্ষা করতে পারেনি! আপনারা তো ১৯৭১ সালের নির্মমতা দেখেও ৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভূট্টকে দেখতে রাস্তায় ভীড় করেছিলেন! ইরানীরা কবি ফেরদৌসীর শাহনামাকে নিজেদের গর্ব মনে করে। সে শাহনামা ছিল ইসলাম আগমনের পূর্বের অগ্নিপূজক ইরানের শাসকদের বন্দনা। আপনারা তো ভারতবর্ষের উত্তরাধিকার হিসেবে মহাভারতকেই নিতে পারলেন না। এমনকি মনসামঙ্গলকেও না। রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের করে নিতে পারেননি যারা কে বাঁচাবে তাদের?

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted