ভারত না হিন্দুস্তান?

ভারত না হিন্দুস্তান?
ভারত বিভক্তির সময় জিন্নাহর যতগুলো বক্তব্য পাওয়া যায় সর্বত্র তিনি ভারতকে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান এই দুই রাষ্ট্রে ভাগ করার জন্য বলেছেন। তার বক্তব্যে কোথাও কোন অস্পষ্টতা ছিলনা। জিন্নাহ এও বলেছিলেন যদি স্বাধীনতা না চান তবে এভাবেই চলুক এক ভারত; কিন্তু যদি ইংরেজরা চলে যেতে চায় তবে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। 
আমরা জানি ভারত একটি উপমহাদেশ ছিল। ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইটা হচ্ছে "পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ"। বিভক্ত ভারতের জন্য এই গানটা কি উপযুক্ত হতে পারে? খন্ডিত পাঞ্জাব, আর খন্ডিত বঙ্গের টুকরা সমূহ পেলেও সিন্ধু সম্পুর্ণভাবে পাকিস্তানের অধীন। সেই সিন্ধুকে কি করে ভারতের অংশ হিসেবে জাতীয় সঙ্গীতে আনা হল? এবং কেন আনা হল? আসলে কংগ্রেসের নেতারা ভাবতেন পাকিস্তান কয়দিন পরই অচল হয়ে যাবে আবার ভারত এক হয়ে যাবে। অখন্ড ভারতের কল্পনা করতেন মৃত্যুর আগেও গান্ধী। তাই তারা বঙ্কিম চন্দ্রের "বন্দে মাতরম" কে জাতীয় সঙ্গীত করলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথের জনগণ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে মোটেও সম্পর্কিত ছিলনা। বন্দে মাতরম ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র প্রেরনার গান। রবীন্দ্রনাথ এটা লিখেছিলেন বড়লাটের ভারত আগমন উপলক্ষে। খন্ডিত ভারতের অংশ হিন্দুস্তানের জন্য নয়।  
এখনও কি সময় হয়নি ভারতীয়দের এটা বুঝার যে সিন্ধু, পাঞ্জাব, আর বংগ নিয়ে যে এক ভারতের স্বপ্ন তারা দেখতেন তা মিথ্যা প্রবঞ্চনা মাত্র?
 আসলে ভারত  ১৯৪৭ সনের ১৪ ই আগষ্ট ভেঙ্গে যায় সৃষ্টি হয় পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান। আমরা ১৯৭১ সনের আগে ভারত নাম শুনতাম না, একে সবাই বলত হিন্দুস্তান। আর তখন নিজেদেরকে মনে হত আসলে আমরাতো এদেশের নই আমাদের দেশ হবে হিন্দুস্তান। যখন বন্ধুরা বা শিক্ষকরা হিন্দুস্তানের প্রসঙ্গ টেনে বিশ্রী মন্তব্য করতেন, তখন মনের ভিতরে লুকানো ভারতের প্রতি যে অনুরাগ তার সাথে সংঘাত হত-কষ্ট পেতাম।.১৯৬৫ সনে ভারতের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার রাইফেল ট্রেনিং নিয়েছিলাম কেবল পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য। পাকিস্তান ভারতীয় অল ইন্ডিয়া রেডিও সংবাদ না শোনার কড়া নির্দেশ দিয়েছিল। হিন্দুদের লক্ষ্য করেই বলা হত "দেওয়ালেরও কান আছে; সাবধান"।সন্ধ্যা হলেই বাসায় ঢিল ছুড়তে শুরু করত পাশের বাসার ক্যাপ্টেন লষ্কর।গর্জে গর্জে বলত "মালাউনদের দেশ থিকি খেদাইতে হইব"। আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এরপরেও আমরা অল ইন্ডিয়া রেডিওর খবর শুনতাম এবং জানতে পারতাম পাকিস্তান হেরে যাচ্ছে। আনন্দ পেতাম। অথচ সেই আনন্দ প্রকাশ করতে পারতাম না। সম্ভবত ৭১ সনে হিন্দুরা সশস্ত্র সংগ্রামে দলে দলে ঝাপিয়ে পড়ার পিছনে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণাটাই ছিল প্রধান কারন। আমি যখন ১৮ই ডিসেম্বর দেশে ফিরি তখন বুকের মধ্যে পতাকাটা জড়িয়ে ধরে সারাটা পথ চোখের জলে ভেসেছি। 'দেশমাতৃকা' কি সেদিন অনুভব করেছিলাম কিন্তু সে ভুল ভাংতে সময় লাগেনি। ঠিক ২০ ডিসেম্বর বুঝলাম এদেশ আমার নয়। আমি ভারতে গিয়ে আমার বাসার সবাইকে বলেছিলেন "সর্বনাশ হয়ে গেছে। যা ভেবেছিলাম তা নয়। ওখানে থাকতে পারবেনা।" আমার একটা ফিফথ সেন্স অনেক সময় কাজ করে যা দ্বারা কোন কোন জিনিস আগাম বলে দিতে পারি। আজ যা লিখছি তাও সেই অনুভুতি থেকেই লিখছি।
   আমরা ১৪ই আগষ্ট খুব বড় করে উজ্জাপন করতাম বাসায়। এতো বিশাল পাকিস্তানের পতাকা আর কারও ছিলনা। পাশের মুসলিম বাসাগুলোতে পতাকা তুলতে দেখতাম না।  এটার জন্য বাবা রঙ্গিন কাগজ এনে দিতেন। আসলে নিজেদের প্রচন্ড দুর্বলতার স্থানটিকে এভাবে "পাকসার জমিন" গেয়ে ঢেকে রাখতাম। সকালে উঠেই ভাইবোনরা পতাকা তুলে একসাথে গাইতাম পাকিস্তানের সেই গান। 
 এই একই বিশ্বাস কাজ করে চলেছে ভারতে থাকা মুসলমানদের মধ্যে। তারাও তাই ভালোবাসে পাকিস্তানকে বাহ্যিক যা কিছু সব আমাদের সেই মতই।

এরজন্য হিন্দু বা মুসলমান কেউ দায়ী নয়। দায়ী আমাদের ভিন্ন কালচারে বিশ্বাস। এটা ঠিক ধর্ম নয় । এটা সংস্কৃতির দ্বন্দ। হিন্দুদের  দেবতা দেশের মাটি, দেশের নদী, দেশের জল, গাছ, লতা-পাতা। মুসলমানদের স্রষ্টা আকাশে-আসমানে। একজন পায়ের ধুলির মাঝেও ইশ্বর দেখে আরেকজন ঈশ্বরকে কোথাও দেখেনা। এই বিশাল দূরত্ব ঘুচাবার নয়। তুমি উপরে খুজে আমি নীচে খুঁজি। তোমার যা নিয়ম আমার তাইই অনিয়ম।  আমি মাটির বেদীতে ইশ্বরকে দেখি, তুমি দেখ সুদুর মরুর বুকে। তোমার সাথে আমার আত্মীয়তা হয়না। এ ধরনের দুই জাতি কি সহবস্থান করতে পারে?
 পাকিস্তান আমলে আমাদের বাসায় কোন আসবাব কেনা হতোনা, পুরানো আসবাব ঠিক করে চলতাম। আর জানতাম কোনক্রমে পরীক্ষা পাশ করে ফেললে ভারত চলে যেতে হবে। বাবাকে সময়সময় ভাবতে হত ভারতে কাকে কোথায় পাঠানো যায়। সব ফেলে যেতে হবে বলে বাসাটাও মেরামত করা হতোনা। 
 ১৯৭১ সনের পর সবাই বলতে শুরু করে ভারত। মনে আছে আমার মামা বলেছিলেন " এই যে বাংলাদেশ বাংলাদেশ করে দিনরাত খাটছো, সেদেশ হলে কি সেখানে থাকতে পারবে?" আমি বললাম " সেদিন চলে গেছে। আমরা আর হিন্দু মুসলমান নই। আমরা বুঝেছি এটা ভুল ।বাঙ্গালী এখন জেগেছে"।কী তর্কই না হল।এরপর রাগ করে মামার সাথে আর সম্পর্কই রাখিনি বহুকাল।
   পাকিস্তান বাংলাদেশ আর হিন্দুস্তানের ইতিহাস ভিন্ন। বাস্তব সত্যটা স্বীকার করতেই হবে যত দেরীই হোক। ভারত আর নেই। ১৪ই আগষ্ট ১৯৪৭, ভারতের সেদিন মৃত্যু হয়েছিল। মিথ্যা অখন্ড ভারতের কল্পনা ছেড়ে সত্যিকার নামেই একে ডাকুন। নিজেদেরকে বিগ ব্রাদার ভাববেন না। নিজেদেরকে ভারতীয় ভাবা ছাড়ুন।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted