চোখের সামনে এত বড় একটা নিঃশব্দ আগ্রাসন ঘটতে দেখে চেয়ারে বসে বসেই কেঁপে উঠলাম।

কেএফসি থেকে এক বালতি মুরগি ভাজা কিনে বেশ জাঁকিয়ে বসেছি। ঝলমলে মল, চারিদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব গন্ধ। এরই মধ্যে দুই হিজাবী মহিলার আগমন। এসেই প্রথম প্রশ্ন- "আচ্ছা, এই দোকানের মাংসগুলো সব হালাল তো?" কেএফসি-র মেয়েটি একটু থতমত খেয়েই  ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ করে দিল। হিজাবিনী বোধয় এই উত্তরে খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না।
আবার জিজ্ঞেস করলেন, প্রমাণ কি? কেএফসির মেয়েটি এবার হাত ঢুকিয়ে দেরাজের ভিতর থেকে বের করে আনল একটা কাগজ। আন্দাজে বুঝলাম ওটাই হালাল সার্টিফিকেট। হিজাবী মহিলার চোখ খুব দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল সার্টিফিকেটের ইঞ্চি ইঞ্চিতে। বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে সার্টিফিকেট ফেরত দিয়ে দিলেন।

তারপর হাত নেড়ে ইশারা করতেই ছুটে এল আরও ৮ জন, চারটে বাচ্চা আর চারজন জোয়ান। কেএফসির মেয়েটার মুখে এক গাল হাসি, ভাগ্যিস সার্টিফিকেটটা ছিল। নইলে এতগুলো খদ্দের এক্ষুনি হাতছাড়া হত। চোখের সামনে এত বড় একটা নিঃশব্দ আগ্রাসন ঘটতে দেখে চেয়ারে বসে বসেই কেঁপে উঠলাম।

থালের উপর নেতিয়ে পড়ে থাকা ঠ্যাং গুলোকে হঠাৎ করেই দুঃস্বপ্নের মত বিস্বাদ মনে হতে লাগল। বেরোনোর সময় চোখে পড়ল, দরজার পাশেই জ্বলজ্বল করছে, "হালাল" লেখা বোর্ড।

তারপর থেকে এয়ারপোর্ট, হোটেল, রেস্তোরাঁ সর্বত্র চোখে পড়তে লাগল হালাল লেখাগুলো।  আমিষ মানেই হালাল। নিরামিষের উপর হালাল ছাপ লাগা এদেশে এখনো শুরু হয়নি।

কলকাতায় মিত্র ক্যাফেতে খেতে গিয়ে দেখি, একটা কম্পিউটার থেকে ছাপানো কাগজ সাটা। "আমাদের মুরগির সমস্ত রান্না ১০০% হালাল"! উপরে মুরগির জোগান দেওয়া দোকানের নাম লেখা- "জয় মা তারা চিকেন সেন্টার"! দোকানের মালিক হয়তো বাঙালি কিন্তু দোকানের কসাইরা সব মুসলমান। নইলে মাংস হালাল হবে না যে।

এখন "জয় মা তারা" যদি গ্যারান্টি সহকারে হালাল মাংস বিক্রি করে, তাহলে কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ডের দোষ কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে তবুও মুরগির মাংসের ব্যবসায় বাঙালি মালিকদের আধিপত্য রয়েছে; মহারাষ্ট্রে তো মুরগি থেকে পাঁঠা, হিন্দু দোকানদার খুঁজতে গেলে পাকাপাকি মাংস ত্যাগ ছাড়া কোন গতি নেই। বাড়ি থেকে ৩০ কিমি এগিয়ে গিয়েও একটা হিন্দু পাঁঠার দোকান খুঁজে পেলেও, দেখা যাবে কসাইরা প্রত্যেকে মুসলমান।

ফলে কিনতে গেলে হালাল ছাড়া গতি নেই। মুরগির দোকানেও একই অবস্থা। অনেক খুঁজেপেতে হিন্দু দোকানী বের করলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না যে কসাই ঝটকায় কাটবে না আড়াই প্যাঁচে। কারণ, দোকানের নাম "গাঁওদেবী" হলেও তার উপরে ইসলামী চাঁদ-তারা এঁকে ছোট করে খাজা গরীব নওয়াজ (কেজিএন) লেখা।

কোথাও আবার "একবীরা দেবী"-র নামে উৎসর্গ করা মাংসের দোকান, অথচ সামলানোর ভার সম্পূর্ণ ভাবে "মুসলিম খটিক সমাজ"-এর। হিন্দু কসাই হারিয়ে যাচ্ছে, ঝটকা-র কৌশল প্রায় বিলুপ্ত। 

অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়, পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে বলির মাংসের দোকান ছিল। অফিস পাড়ায় দুপুরের খাবার সারার জন্য থাকত "আদর্শ হিন্দু হোটেল"! যেখানে মালিক, রাঁধুনি, ঠাকুর, চাকর থেকে মালের জোগানদার- সকলেই ছিল হিন্দু।

হিন্দুর অর্থে হিন্দুর কর্মসংস্থান। মুসলমানদের জন্যেও ছিল "মুসলিম হোটেল"! তারপর আধুনিকতা এল, আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আদর্শ হিন্দু হোটেল হারিয়ে গেল; কিন্তু মুসলিম হোটেল শুধু টিকে গেল না, বাড়তে বাড়তে গোটা পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলল।

হালাল-এর শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ভারতের সবকটা আমিষ হোটেলই এখন বৃহত্তর "মুসলিম হোটেল"! হালাল সার্টিফিকেট ঝোলানো থাকুক বা না থাকুক, গোটা মাংসের ব্যবসাটাই যখন মুসলমান কসাইয়ের হাতে, নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি না জানলেও হালালই পাচ্ছেন। 

ধর্ম রক্ষা করতে পারলে ধার্মিকও রক্ষা পায়। কয়েক দশক আগেও বাঙালি এই জিনিসটা বুঝত। কোথাও খেতে ঢোকার আগে এতটুকুনিও সন্দেহ হলে সটান জিজ্ঞেস করে বসত- "এটা হিন্দু হোটেল তো"? ঠিক ঠিক উত্তর পেলে হোটেলের ভিতরে তন্ন তন্ন করে চোখ বুলিয়ে নিত, কোথায় ঝুলছে ঠাকুর-দেবতার ছবি।

ঝটকার তো কোন সার্টিফিকেট হয় না, দোকানে মা কালীর ছবি থাকা মানেই সেটা শাস্ত্রীয় দোকান। মুসলিম হোটেলে খেলে "না জানি পাঁঠা বলে কি খাইয়ে দেবে", এই ভয়টা ২০ বছর আগে পর্যন্তও ছিল। যার লাভ প্রত্যক্ষ ভাবে পেয়েছেন এই বাংলার সমস্ত বাঙালি হোটেল মালিকেরা। রক্ত জল করে রোজগার করা বাঙালির সমস্ত আয়, বাঙালি হোটেলগুলোর কাছে গেছে।

যেদিন থেকে স্বধর্ম ভুলে আমরা আরসালান-আমিনিয়াতে মেতেছি, সেইদিন থেকে বাঙালি কসাই, মাংসের দোকানী এবং রেস্তোরাঁ মালিকদের দুঃখের দিন শুরু। স্বজাতির টাকায় ফুলে ফেঁপে এই কলকাতারই বুকে বাড়ি-গাড়ি হাঁকাচ্ছে বিজাতীয়রা।

এ দোষ একান্ত ভাবেই আমাদের। প্রায়শ্চিত্ত শুরু করতে হবে কসাই দিয়েই। প্রাচীনকালে যেমন দূর দূরান্ত থেকে ডেকে এনে, প্রতিটি গ্রামে এক ঘর ব্রাহ্মণ বসতি করানো হত; এখন একই ভাবে বাঙালিকে প্রতিটি পাড়ায় একজন করে বাঙালি কসাই দাঁড় করাতে হবে।


পাড়া সুদ্ধ লোকদের সেই কসাইয়ের খদ্দের হয়ে, তার ব্যবসা সুনিশ্চিত করতে হবে। হালাল সাম্রাজ্যকে আটকানোটা লক্ষ্য নয়, দিকে দিকে ঝটকার রাজ্য গড়ে তোলাটাই আসল লক্ষ্য। 

#ঝটকা_হালাল
C@Smritilekha

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted