হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে যে অলীক বিশ্বমানবতার পূজারী বামপন্থা তার চেতনাকে গ্রাস করল তাই বাঙ্গালী হিন্দুর সর্বপ্রকারে পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

এবার প্রশ্ন - বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে কি শরীরচর্চা অনুপস্থিত নাকি উত্তর ভারত থেকে আসা নতুন কোন ঝঞ্ঝার মাধ্যমেই তার  পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে বঙ্গীয় পরিমন্ডলে? 



বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই এক ব্যাপক অনুসন্ধানের প্রয়োজন।

অনুসন্ধান থেকে যা জানা যায়  -  আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী, স্বামী বিবেকানন্দের লৌহদৃঢ় মাংসপেশী; ইস্পাতকঠিন স্নায়ু; বজ্রভীষণ মনোবলের আহ্বানে উদ্ভাসিত হয়ে আরম্ভ করেন প্রতাপাদিত্য উৎসব। 

বাঙ্গালী বীর প্রতাপাদিত্যের স্মরণে বাঙ্গালী ছেলেদের একত্রে শুধুমাত্র কুস্তি, লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলা, বক্সিং ইত্যাদি। তার প্রথম প্রকাশেই বাঙ্গালীদের মধ্যে যে উৎসাহের সৃষ্টি হয় তা পাওয়া যায় তৎকালীন 'বঙ্গবাসী' পত্রিকার সম্পাদকীয়তে - "মরি মরি কি দেখিলাম! এ কি সভা! বক্তিমে নয়, টেবিল চাপড়া-চাপড়ি নয়, শুধু বঙ্গবীরের স্মৃতি আহ্বান, বঙ্গ যুবকদের কঠিন হস্তে অস্ত্র ধারণ ও তাদের নেত্রী এক বঙ্গললনার হস্তে পুরস্কার বিতরণ। দেবী দশভুজা কি আজ সশরীরে অবতীর্ণ হইলেন!"  তারই সাথে প্রারম্ভ হল বীরাষ্টমী উৎসবের, দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন। চৌধুরাণীর নিজস্ব ভাবনায় - বহুকাল ধরে বাঙ্গালীর সংস্কারে স্থায়ী বসবাসকারী, অথচ তার ব্যবহার থেকে লুপ্ত - তার পুনরুদ্ধার এক আবশ্যিক কর্তব্যও বটে। কেন? সেই এক - স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর নিজের কথায় - "তারপর এলেন এক dynamic personality - স্বামী বিবেকানন্দ। Dynamic সে-ই -- যার ভিতরে বারুদের ধর্ম আছে, প্রচন্ড তেজ, প্রচন্ড ভাঙাগড়ার শক্তি।  সেই বারুদের আগুন থেকে একটি স্ফুলিঙ্গ আমার ভিতরে এসে পড়েছিল - আমায় ভেঙে গড়েছিল।" (জীবনের ঝরাপাতা - সরলা দেবী)   

অতএব সূচনা হল বীরাষ্টমী  উৎসবের মহাষ্টমীর দ্দিন ২৬নং বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মাঠে ছেলেদের অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনী ঘোষণা করা হল। কলকাতার প্রায় সব ক্লাবই এতে  যোগ দিল। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হল, কেউ পেল মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা, কেউ চোরা, কেউ লাঠি, এবং প্রত্যেকেই একিট করে বীরাষ্টমী পদক - তার এক পিঠে লেখা 'বীরোভব' আর এক পিঠে 'দেবাঃ দুর্বলঘাতকাঃ'। বীরাষ্টমী উৎসবের একটি পৰিধা অঙ্গ ছিল একটি ফুলের মালায় সজ্জিত তলোয়ারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেশের পূর্ব পূর্ব বীরগণের বন্দনা স্তোত্র ও তাঁদের নাম উচ্চারণ করে তরবারীতে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান। 

এভাবেই বীরাষ্টমী উৎসব সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল। বছরে বছরে এ দিনে মায়ের হাত থেকে রাখি নিয়ে ছেলেরা যথার্থ শারীরিক বলবীর্যের অনুষ্ঠানে মেতে উঠল। আর এখানেই হল বিপ্লবী বাংলার গোড়াপত্তন। ভয় জয় করার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে উঠলো বাংলার যুবকগণ। (অগ্নিযুগ - শ্রী শৈলেশ দে)....   

"আমি যখন শ্রীহট্টে জেলা স্কুলে পড়ি, তখন বাংলার ছোটলাট ক্যাম্বেল সাহেব যে শিক্ষানীতি প্রবর্তিত করেন, তদনুসারে স্কুলে স্কুলে বিলাতী ধরণের ব্যায়ামচর্চার জন্য ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে যখন আসিলাম তখন এখানেও জিমন্যাস্টিক শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা হইয়াছিল। নবগোপালবাবুর জ্যেষ্ঠ জামাতা আমাদের জিমন্যাস্টিক শিক্ষক ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্গনে প্যারালাল বার, হরাইজন্টাল বার, ট্রেপিজ প্রভৃতি বিলাতী ব্যায়ামের উপকরণ স্থাপিত হইয়াছিল। নবগোপাল মিত্র মহাশয়েরও একটি জিমনাস্টিকের আখড়া ছিল। নবগোপাল মিত্রের পৈতৃক ভদ্রাসন ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের পাশে, শঙ্কর ঘোষ লেনে। এখানে লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলা এবং ডন, কুস্তি প্রভৃতি শেখানো হইত। সুন্দরীমোহন দাস, রাজচন্দ্র চৌধুরী এবং আমি, শ্রীহট্টের ছাত্রাবাসের আমরা এই তিনজন নবগোপাল মিত্র মহাশয়ের এই ব্যায়াম বিদ্যালয়ে ভর্তি হই; এবং তাঁহারই নিকট হইতে আমরা স্বাদেশিকতায় বা ন্যাশনালিজমে প্রথম দীক্ষালাভ করি।

সুরেন্দ্রনাথ আমাদিগকে প্যাট্রিয়টিজমে অথবা স্বদেশভক্তিতে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। নবগোপাল মিত্র ন্যাশনালিজম বা স্বাজাত্যাভিমানে দীক্ষা দিয়াছিলেন। ব্রাহ্মসমাজ সাধারণভাবে আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আদর্শে অনুপ্রাণিত করিয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ সেই স্বাধীনতার প্রেরণাকে স্বদেশের রাষ্ট্রীয় মুক্তির পথে পরিচালিত করিয়াছিলেন। নবগোপাল মিত্র আমাদিগকে নিজেদের সভ্যতা এবং সাধনার গৌরবে গরীয়ান করিয়া সত্য স্বাজাত্যাভিমানের প্রেরণা দিয়াছিলেন।" "সত্তর বৎসর" - শ্রী বিপিন চন্দ্র পাল (আত্মজীবনী).....

উল্লেখযোগ্য, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সূতিকাগৃহ/উৎসভূমি বঙ্গে - ১৮৬৭ সাল (হিন্দুমেলার স্থাপনা) থেকেই দেহচর্চা, শস্ত্রচর্চার সাথে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ এক অঙ্গে লীন হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে গুপ্ত সমিতির সময়েও এই একই ভাবধারা বহমান ছিল - '৪৭ পর্যন্ত। তারপরেই বাঙ্গালী হিন্দু বিপর্যস্ত, ক্ষীণ হয়ে ক্রমশ হ্রাসমান হয়। বর্তমানে এই জনজাতি তার নিজস্ব অস্তিত্বের শ্মশানভূমিতে বিচরণ করছে। কোন এক সময়ে বঙ্গ দেহচর্চার ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতে রাজধানী হিসেবে গণ্য হতো। দেহচর্চা (bodybuilding) ও কুস্তিতে ভারত শিরোপার উষ্ণীষ তারই করায়ত্ত ছিল একপ্রকার।

স্বাজাত্য বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে যে অলীক বিশ্বমানবতার পূজারী বামপন্থা তার চেতনাকে গ্রাস করল তাই বাঙ্গালী হিন্দুর সর্বপ্রকারে পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আজ এই তথ্য ইতিহাসের স্মৃতিচারণা নয়। মুখস্থবিদ্যার আকারে ইতিহাস আওড়ে লাভ হয়না কোনমতেই। কিন্তু তার মাধ্যমে যদি নিজস্ব ভূমি, উৎপত্তি ও আগামী দিনে কি করলে গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব - এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়, ধ্যেয়বস্তু (objective) precise (নির্দিষ্ট) করা যায়, নিরলস শ্রমের মাধ্যমে সেই ধ্যেয়বস্তু অর্জন করা যায় তখনই আপনার, আপনার ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, ধ্বংসাবশেষ থেকে পরিত্রাণ, উন্নতি একমাত্র সম্ভব। বঙ্গে যে identity politics র সূত্রপাত হয়ে গেছে তা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে? পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কি বলে? নিজস্ব স্বার্থ সম্বন্ধে যত্নবান হোন।.....Get back to basics......

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted