১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাক ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের’ ঘোষণা দেননি ভারতের ভয়ে!
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর ডালিম রেডিওতে ঘোষণা করেছিলেন, ‘দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে এবং এখন থেকে বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হবে’। এই ঘোষণায় পাকিস্তান উল্লাসে ফেটে পড়ে। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড নিজ দেশকে এক বার্তায় জানান, পাকিস্তানের সরকার, গণমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষ মেজর ডালিমের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের সঙ্গে কনফেডারেশ করা যায় কিনা সে বিষয়ে আশান্বিত হয়ে উঠে।
ওদিকে সৌদি আরবসহ মধ্যপাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র হতে যাচ্চে জেনে এক এক করে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে যা বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। ডালিমের ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট মোশতাক কি বলেন সেটা জানার আগ্রহ ছিলো সকলের। প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বাংলাদেশের অবস্থান পরিস্কার না করে বরং ঘোলাটে করে রাখলেন। তিনি বললেন না বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। তিনি আসলে ডালিমের ঘোষণার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়া ‘বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত কি বলে সেটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ভারতের তখনকার রাষ্ট্রদুত সমর সেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে ভারতের অবস্থান জানানো একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। এ বিষয়ে সমর সেন ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকার সঙ্গে ১৯৯৮ সালে ২১ নভেম্বর কথা বলেছিলেন এবং কোলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানস ঘোষ এক কলামে একই রকম বিবরণ দিয়েছেন যা সমর সেন ফ্রন্টলাইনে দিয়েছিলেন। সমর সেন জানান, কটুনৈতিক নোটে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে লেখা ছিলো, ‘যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’
এরপরই ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সম্পর্কে তার দেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন মিশরের দৈনিক আল আহরাম পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশ ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সকল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সকল আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশ কাগজে কলমে ইসলামিক শাসনে চলে যেতে পারেনি ভারতের এই হুমকির পরই। বাংলাদেশ ভৌগলিক দিক দিয়ে ভারতের কাছে নানাভাবে টিকে থাকার জন্য নির্ভর। তাই ভৌগলিক রাজনীতি, অথনৈতিক রাজনীতিসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা হিসেব কষে ভারতকে ক্ষ্যাপিয়ে আনুষ্ঠানিক ইসলামী শাসনতন্ত্রে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বিসমিল্লাহ বসানোসহ অন্যান্য ইসলামিকরণ শুরু করে মোশতাক থেকে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত। কিন্তু বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন ও পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেরারেশন করা সম্ভব হয়নি ভারতের থ্রেটের কারণে এ কথা তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদুতও তার নোটে উল্লেখ করেছেন। ভারতের এই দাদাগিরি কখনোই বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি।
১৯৬৫ সালে পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গুজবে ছেয়ে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ার স্পাইয়ে ভরে গেছে। এরা দেশের তথ্য ভারতের পাচারের জন্য দেয়ালে কান পেতে আছে। এই দালালরা হচ্ছে দেশের মধ্যে থাকা হিন্দুরা। ৬৪-৬৫ সালে বড় রকমের হিন্দু খেদানো হলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভারত বিরোধীতা ছিলো বলেই পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে এখানে খাকা হিন্দুদের খেদানো এবং বাঙালী মুসলমানকে হিন্দু বাঙালী থেকে পৃথক এক জাতিসত্ত্বা করে গড়ে তুলতে নানা রকম প্রজেক্ট গ্রহণ করা সহজ ছিলো। যেমন বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধন, সিলেবাস থেকে বাংলা সাহিত্যের হিন্দু লেখকদের অপসারণ ইত্যাদি।
এর মাত্র কয়েক বছর পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই ভারত বিরোধী জনতাই ভারতের সেল্টার নিয়ে ভারতের মাটিতে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জলিলের ‘সম্মুখ সমরে’ বইতে এই অবস্থানটি তুলে ধরা হয়। তিনি লিখেন, ৬৫ সালে তিনি যাদের মারতে গুলি চালিয়ে ছিলেন তাদের সঙ্গেই আজ প্লাণ করছেন ওপারে গ্রামগুলো যারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে যাদের সঙ্গে কাধে কাধ রেখে ৬৫ সালে যুদ্ধ করেছিলাম। মেজর জলিলের দেশ স্বাধীনের পর তার ভারত বিরোধীতা ছিলো চরমে। ভারত বাংলাদেশ থেকে সব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে এটা দিয়েই তিনি শোরগোল শুরু করেন এবং পরবর্তীতে রাজাকার হাফেজ্জি হুজুরের শিষ্যত্ব নিয়ে ইসলামিক রাজনীতি শুরু করেন।
একথা অস্বীকার করা যাবে না ১৫ আগস্টের খুনিরা মুক্তিযোদ্ধাই ছিলো। কিন্তু তারা ভারতের সাহায্যে সেক্যুলার বাংলাদেশের জন্ম মেনে নিতে পারেননি। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষও তাই। আজকাল যখন ভারত বিদ্বেষের কথা উঠে তখন কেউ কেউ সাম্প্রতিককালের সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতির কথা বলে তারা দাবী করেন ভারতের এইসব কাজ কারবার বাংলাদেশের মানুষকে ভারত বিরোধী করে তুলেছে। এটা বলে তারা বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহাসিক ভারত বিরোধীতার নেপথ্যে যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব আছে তা আড়াল করতে চান। তাই এবার দেখা যাক সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ কেমন করে শুরুতেই ভারতের প্রতি তার পুরোনো বিদ্বেষ বজায় রেখেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে আশ্রয় দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে, নিজের সৈন্য দিয়ে সহায়তা করা একটা দেশ রাতারাতি বাংলাদেশের কাছে শত্রু হয়ে গেলো কেমন করে? দেখা যাচ্ছে ৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা তুঙ্গে উঠে যা ৭৪-৭৫ সালে সব বাধ ভেঙ্গে যায়। কুটনৈতিক সুত্রগুলো জানাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছিল। ভারত আসলে নিজের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশকে দিয়ে যুদ্ধ করিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গিয়েছে। যুদ্ধে ভারতেরই লাভ হয়েছে কারণ তারা বাংলাদেশের গোলাবারুদ টাকা পয়সা সম্পদ সব লুট করে নিয়ে গেছে। ভারতের রাষ্ট্রদুত সমর সেন বলেন, এরকম ভারত বিরোধী মনোভাবের সময়ই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্ট। যে লোকটি বাংলাদেশের গণহত্যার রক্ত তার হাতে মেখে আছে তাকে বাংলাদেশের মানুষ একনজর দেখতে রাস্তায় ভীড় জমান এবং স্বাদর অভিনন্দন জানান!
ভেবে আশ্চর্য লাগে যে মানুষটির বাংলাদেশর গণহত্যার দায় রয়েছে, অগুণতি নারীর ধর্ষিতার দায় যার, তাকে নিয়ে এদেশের মানুষ এত উচ্ছ্বাসিত ছিলো কেন? মাত্রই যে দেশের মানুষের ভালোবাসা আর সহযোগিতায় আমরা দেশ স্বাধীন করলাম তাদের কেন ফের শত্রু ভাবা শুরু করলাম? উপকারীকে এখন তার উপকারের জন্যই সন্দেহ করা হচ্ছে!
এই লেখাটি ভারতের সঙ্গে বর্তমান আমাদের হাজারটা সমস্যার প্রেক্ষিতে লিখিত নয়। এই লেখাটি দেখানোর উদ্দেশ্য ভারতের সঙ্গে আমাদের বৈরীতার একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে যে কারণটি আসলে কোন যৌক্তিক কারণ নয়। যেমন পাকিস্তান আমাদের ইতিহাসে ধর্ষণ গণহত্যা দেয়ার মাত্র কয়েক বছর পরই ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠেছিলো তাও কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। কাজেই আমাদের আজকের অন্ধ ভারত বিদ্বেষের পিছনে সীমান্ত হত্যা, ফেলানী, ক্রিকেট নিছক উছিলা মাত্র।
তথ্য সূত্র : ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি, আবেদ খান। মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান। ফ্রন্ট লাইন, ২১ নভেম্বর ১৯৯৮
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................