মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ছোটদের জন্য ভূতের উপন্যাসের নাম ‘ভূতের বাচ্চা সুলাইমান’ রাখায় তাকে ছুরি মেরেছিল তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ছোটদের জন্য ভূতের উপন্যাসের নাম ‘ভূতের বাচ্চা সুলাইমান’ রাখায় তাকে ছুরি মেরেছিল তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অথচ দেখুন, পিনাকীর লেংটা কান্ডের পর তাকে ‘লেংটা সুলেমান’ ডাকা হচ্ছে। যারা নাম দিয়েছে তারা সেক্যুলারপন্থী না। বিএনপি ঘরোনার এক্টিভিস্ট, ফলে এখানে ইসলামের নবী অবমাননা হচ্ছে না! একইভাবে মিজানুর রহমান আজহারী যখন নবী স্ত্রী খাদিজাকে বলেন, ৪০ বছরের বুড়ি, বিধবা, ইনটেক না... তখন ইসলাম অবমাননা হয় না। চরমোনাই পীর যখন বলে, এখন কুরআন লেখা হলে তার বাপ-দাদার নাম লেখা থাকত... তখন ইসলাম অবমাননা হয় না। জামাত ইসলাম প্রতিষ্ঠাতা মাওদুদি কুরআনের তাফসির করতে গিয়ে এক জায়গায় একটি আয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, বাক্যটি এভাবে না লিখে এভাবে লিখলে ভালো হতো... কোথাও এ জন্য মুসলমানরা কারোর লাশ ফেলে দেয়নি। কিন্তু কোলকাতার ভোলানাথ সেন তার প্রকাশনী সেন ব্রাদার্স থেকে মনিষিদের কথা বইতে মুহাম্মদের জীবনী ভক্তিভরে স্থান দিলেও খুন হন! সেই বইতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা মুহাম্মদের কাল্পনিক একটি ছবি লেখার সঙ্গে ছেপেছিলেন বলে অবিভক্ত বাংলার ৩০ এর দশকে চাপাতি নিয়ে প্রকাশক ভোলানাথ ও তার দুই কর্মচারীকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। খেয়াল করুন, ৩০ এর দশক যখন জিন্নাহ ধীরে ধীরে, আল্লামা ইকবাল ধীরে ধীরে মুসলিম জাতিসত্ত্বার কথা বলা শুরু করছিলেন। ১৯৩১ সালে ভোলানাথ সেন খুন হলো নবী অবমাননায়, ঠিক কয়েক বছর আগে ১৯২৯ রঙ্গিলা রসূল বই কান্ডে খুনি ইলমুদ্দিনের হয়ে ফ্রি ওকালতি করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ইলমুদ্দিনের জানাজা পড়ান কবি ইকবাল। বিষয়গুলো যে রাজনৈতিক জাগরণ তোলার জন্য করা হয়েছিল তা পরিস্কার। মওদুদি কুরআনের তাফসির করেন ১৯৪২ সালে। তার বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে মুসলমানরা কেউ তার মাথার দাম হাঁকেনি!



ভাবেন জাপানের মত দেশে রুশদির বই অনুবাদকারীকে হত্যা করা হয়েছিল। সেখানে মুসলমাররা তো সংখ্যালঘু! বেজিয়ামের মত জায়গায় মসজিদে ঢুকে এক ইমাম যিনি রুশদির মাথার দাম হাঁকার সমালোচনা করেছিলেন তাকে হত্যা করে লেবানন কেন্দ্রিক এক ইসলামিক গ্রুপ। শার্লি এবোদ, ফ্রান্সে লবি কান্ড, আমেরিকায় আকায়েদ উল্লাহ নামের বাংলাদেশী যুবক যে ফেডারেল ব্যাংক উড়িয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করেছিল। ভাবুন ভ্যাটিকান সিটি উড়িয়ে দিতে কতবার চেষ্টা করা হয়েছে? ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে রেজেনসবুর্গ (জার্মানি) বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতায় পোপ বেনেডিক্ট ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে মধ্যযুগীয় বাইজান্টাইন সম্রাট ম্যানুয়েলের একটি মন্তব্য কোট করেছিলেন যেখানে ম্যানুয়েল ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম বলেছিলেন। এই ভাষণের পর পোপের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়ে। নেহাত পশ্চিমারা পৃথিবী চলায় না হলে ভ্যাটিকান সিটিকে হাইয়া সোফিয়ার মত সমজিদ বানিয়ে ফেলা হতো! পোপকে অবশ্য এ জন্য ক্ষমা চাইতে হয়। আচ্ছা, আপনি কি দেখেছেন পৃথিবীতে কোন ইসলামী আলেম ওলামা খ্রিস্টান ইহুদী হিন্দু ধর্ম নিয়ে অবমানকর কথা বলে ক্ষমা চেয়েছে? এই যে তারা রাতদিন বলে, ইহুদী খ্রিস্টানরা বাইবেল বিকৃত করে ফেলেছে এ জন্য তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হয়? ইহুদীদের অভিশপ্ত জাতি বলা হয়েছে কুরআনে- এ জন্য তারা ক্ষমা চায়? আর সহিংসতার ধর্ম বলা কি অন্যায় হয়েছে? কুরআনে সাড়ে তিনশো বার অস্ত্রহাতে জিহাদ করতে বলা হয়েছে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে। মধ্যাযুগেই যদি ইসলামের এই সমালোচনা শুনতে হয় এখন এই ইন্টারনেট যুগে ইসলাম কি কারোর অজানা?

ইতিহাস তো অনেক লম্বা। কত উদাহরণ দিবো? সাম্প্রতিক সময়ের কথা বলি। ২০০২ সালে নাইজেরিয়ায় বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। ৯২ জন প্রতিযোগী বা সুন্দরী নাইজেরিয়াতে পা রাখলে এটা হবে অনৈতিক, পাপ, অনাচার। ইসলামপন্থীরা এটা প্রতিহতের ডাক দেয়। নাইজেরিয়া মুসলিম প্রধান দেশ। সেদেশে খ্রিস্টানদের কিছুদিন পর পর নানা রকম ধর্মীয় অবমাননায় জেলে ভরা হয়। দেশছাড়া করা হয়। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পাশ্চত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান ও খ্রিস্টানদের আসলে টার্গেট করা হয়। তেমনই একজন ইসিওমা ড্যানিয়েল। তিনি UK-এর University of Central Lancashire থেকে Journalism and Politics বিষয়ে ২০০১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন এবং দেশে ফিরে ফ্যাশন সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ছিলেন নাইজেরিয়ান খ্রিস্টান। ইসলামপন্থীদের বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরোধীতা প্রেক্ষিতে তিনি এক কলামে লিখেন, “মুসলমানদের মনে হয়েছিল ৯২ জন নারীকে নাইজেরিয়ায় আনা অনৈতিক … মুহাম্মদ (সা.) কী ভাবতেন? … তিনি হয়তো তাদের মধ্যে একজনকে স্ত্রী হিসেবে বেছে নিতেন”। এই কথা দিয়ে তিনি বুঝাতে চাইলেন ইসলামপন্থীরা যেভাবে ঘৃণা করেন বিশ্ব সুন্দরীদের তেমন কিছু এটা নয়। বরং নবী এখন থাকলে তাদের মধ্যে কোন সুন্দরীকে হয়ত বিয়েই করে ফেলতেন...। ড্যানিয়েলের এই মন্তব্যে নাইজিয়ার মুসলমানরা খ্রিস্টানদের উপর এমন ম্যাসাকার চালায় তাতে ২৫০ জন মারা যায়। এক হাজারের উপর আহত আর এগারো হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ড্যানিয়েল পালিয়ে নরওয়েতে আশ্রয় নেয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল ড্যানিয়েলের মত মানুষদের নাইজেরিয়ায় না রাখা। তাতে নাইজেরিয়ায় মোল্লাদের একক আধিপত্য বজায় থাকবে।

বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের, আদিবাসীদের না রাখার চেষ্টা হচ্ছে। দু্‌ইভাবে কাজটা করা হচ্ছে। একটা শান্তিবাদী দাওয়াতি কার্যক্রমে। যেমন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে দাওয়াত দেয়া, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আজান, পাহাড়ে মসজিদ মাদ্রাসা বানানো। এটা হচ্ছে হোমিওপ্যাথি স্টাইল। নবী বা ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে নির্মূল হচ্ছে এ্যালোপ্যাথি স্টাইল। রামু মালোপাড়া নাসির নগর কুমিল্লা রংপুরসহ সারাদেশে হিন্দু, বাউল, নারী- যারা সমাজে বৈচিত্র ধরে রেখেছে, তাদের নির্মূল করে মোল্লাদের আধিপত্য শতভাগ করা। নইলে কোন ইসলামপন্থীই তাদের নবীকে ভালোবাসে না। নবীকে নিয়ে তাদের কোন আবেগই নেই। যদি থাকত তাহলে মোল্লাতন্ত্র কুরআন পড়িয়ে অর্থ গ্রহণ করে কিভাবে? এটা তো কুরআন মতে হারাম! আজহারী তারেক মুনায়ের মানুনুল হক এদের কেউই ইসলাম বিশ্বাস করে না। কেউ ইসলাম বিশ্বাস করলে শহিদুল ভাইয়ের বউকে নিয়ে রিসোর্টে যায়? তারা জানে না এগুলো জিনা? দাসী ছহবত হালাল। কিন্তু শহিদুল ভাইয়ের বউকে ছবহত করতে হলে নিকা করে নিতে হবে, অন্তত মুতা বিয়া করতে হবে!

যদি মানব জাতিকে অন্য গ্রহে গিয়ে বসবাস করতে হয় পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, তাহলে সেই নতুন বসতিতে যেন কোন সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, মৌলবাদ অভিবাসী হতে না পারে। ফলে সেখানে কুরআন হাদিস মুসলমান নেয়া যাবে না। সাদা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি, গোঁফ চাঁছা, দাড়িওয়ালা, টাকনুর উপর তোলা কাবলী পয়জামা, কপালে নামাজের কালো দাগ- এরাও যদি সেই নতুন বসতিতে গিয়ে পৌঁছায় তাহলে নারীদের পর্দা করতে ফতোয়া দিবে, খিলাফত চাইবে, নবী অবমাননার জন্য গন্ডগোল শুরু করে দিবে। মুসলমান- এমন কী পশ্চিমবঙ্গের মুহাম্মদ সেলিমের মত কমিউনিস্ট হলেও, বদরুদ্দি উমরের মত মার্কসবাদী হলেও, আহমদ ছফার মত জাতীয়তাবাদী নাস্তিক হলেও সেই নতুন বসতিতে গিয়ে এরা এদের মুসলিম পরিচয় আগে পিছে লাগিয়ে নিজেদের আইডেন্টি তৈরি করবে।

এতক্ষণ যা পড়লেন, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না? মনে হচ্ছে না আমি উগ্র কথাবার্তা বলছি? কিন্তু একবার ভেবে দেখেন তো, বর্তমান পৃথিবীতে কারা তাদের নবী ও তাদের ধর্ম ইসলাম অবমাননরার অভিযোগে খুন রাহাজানি করে বেড়াচ্ছে? আর কোন ধর্ম ও সেই ধর্মের প্রধান ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা করতে এভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে রাহাজানি করা হয়? আপনি গত এক দশকের ডাটা নিন গোটা বিশ্ব থেকে ইসলামের নবীর নামে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। উত্তর পেয়ে যাবেন।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted