পাকিস্তান" আসলে একটা ভয়ংকর আইডোলজির নাম।

পাকিস্তান যদি কেবলই একটা রাষ্ট্র হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে মাথায় রেখেও একটা সম্পর্ক রাখার কথা ভাবা যেতো। কারণ রাজনীতিতে বন্ধু শত্রু হয়, শত্রু বন্ধু হয়। কিন্তু পাকিস্তান একটা দেশের নাম হলেও "পাকিস্তান" আসলে একটা ভয়ংকর আইডোলজির নাম। পাকিস্তানের সঙ্গে যে দেশের মৈত্রী সম্পর্ক থাকবে তাকে তারা নষ্ট করতে থাকবে তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র দিয়ে। আপনি সাধারণ আফগানদের কাছে যান, তারা তাদের সর্বনাশের জন্য এই পাকিস্তানী আদর্শকে দায়ী করে। আফগানিস্থানে মাদ্রাসাগুলো যারা চালায় তারা সকলেই পাকিস্তানী মাদ্রাসা ফেতর উচ্চ ডিগ্রীধারী। মোল্লা ওমর আফগানিস্থানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোই বদলে দিয়েছিল সে পাকিস্তানী মাদ্রাসা ফেরত ছিল। কিন্তু মাদ্রাসা পাকিস্তান আইডোলজি তৈরি করেনি। পাকিস্তানের যে সাম্প্রদায়িক বিজ সেটির দুটি ধারা আছে। একটি ইসলামিক জঙ্গিবাদ, অপরটি পাকিস্তানী চেতনা। খু্ব ক্রিটিকাল। বাংলাদেশের বহু মুসলমান মোল্লাদের পছন্দ করে না কিন্তু পাকিস্তান চেতনা পছন্দ। বহু মেয়ে ইসলামী শাসন চায় না কিন্তু প্রো পাকিস্তানী! কেন? এর তফাত কি আর যোগসূত্রই বা কি?

পাকিস্তান নামের যে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হবে সেটি কিন্তু ভারতে অবস্থিত দেওবন্দ মাদ্রাসার মুরুব্বিরা কোনদিন চায়নি। তারা হিন্দুস্থানে ইসলাম কায়েম করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান কেবল মুসলমানদের হলে, তখন কথা ছিল এপার থেকে মুসলমানরা সব চলে যাবে, হিন্দুরা সব থেকে যাবে। তাহলে হিন্দুস্থানে কিয়ামত পর্যন্তও ইসলাম কায়েম করা যাবে না। পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিল আসলে দেওবন্ধ মোল্লা বিরোধী সৈয়দ আহমদের মত ব্যক্তিদের। ছিলেন কবি পন্ডিত ইংরেজি শিক্ষিত ইকবাল। ইকবালকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। তারা কেউ মোল্লা ছিলেন না। তবু এদের মেলবন্ধটা কোথায় সেটা একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে উদাহরণ দেই।

ইলমুদ্দিন নামের এক কাঠমিস্ত্রির ১৯ বছরের ছেলে, গরীর অশিক্ষিত যে রঙ্গীলা রসূল বইয়ের প্রকাশক রাজপালকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল। এই খুন করতে সে প্রেরণা পেয়েছিল লাহোরের ওয়াজির খান মসজিদের এক ইমাম থেকে। মসজিদের ভেতর ১৯২৯ সালের ৬ এপ্রিল সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী জ্বালাময়ী এক ভাষণে আবেগভরে বলেন, মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে শাতিমে রাসূলকে খুন করতে পারে? এই ভাষণ শুনেই ইলমুদ্দিন ১ রুপি দিয়ে একটি ছুরি কিনে রাজপালকে তার দোকানের মধ্যে নির্মমভাবে খুন করে। এই বইয়ের লেখক রাজপাল নন। মুসলমানরা রামের স্ত্রী সীতাকে পতিতা আখ্যায়িত করে একটি বই লেখার পর হিন্দুরা বইয়ের জবাবে আরেকটি বই লিখলে রাজপাল কেবল রঙ্গীলা রসূল বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা নেন। ইলমুদ্দিন খুন করে কিন্তু পালিয়ে যায়নি। বীরদর্পে পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এই ঠান্ডা মাথার খুনটির উৎসাহ এসেছিল কোথা থেকে? মাদ্রাসা থেকে। ইমাম মুয়াজ্জিন মাওলানা মুফতি বের হয় মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোর তরিকা কোথা থেকে আসে? দেওবন্ধ থেকে। দেওবন্ধ ভারতে অবস্থিত।  পাকিস্তানের কথিত বিখ্যাত জিহাদ মাদ্রাসার সার্টিফিকেটও এই দেওবন্দ অনুমোদিত। মানে হচ্ছে একজন ইলমুদ্দিন তৈরি হয় মাদ্রাসা মগজ থেকে। তারপর সেই ইলমুদ্দিনকে মুসলমানদের জাতীয় বীর বলে আখ্যায়িত করেন কবি ইকবাল। বলেন আমরা শিক্ষিতরা যা করতে পারেনি আজ এই অশিক্ষিত ছেলেটি সেটি করে দেখিয়েছে। ইলমুদ্দিনের জানাজা তাকে পড়াতে বললে তিনি রাজি হননি কারণ তার মত পাপী মুসলমান সে যোগ্যতা রাখে না। নরহত্যাকে কিভাবে সমর্থন করে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টারা এটা এখানে ফোকাস না। সেদিন হিন্দু মুসলমান দুই জাতি এই ভিত্তিতে দেশভাগের কথা বলেছিলেন বিষয়টা তাও নয়। কিভাবে মাদ্রাসার সঙ্গে ইকবাল জিন্নার মত লোকজনের যোগসূত্র তা আরো পরিস্কার হওয়া যাবে যখন পাকিস্তান হওয়ার পর ইলমুদ্দিনের নামে অসংখ্য রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয় এবং নবী অবমাননার আইন করে ইলমুদ্দিনের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়। জিন্না ছিল ইলমুদ্দিনের আইনজীবী। এজন্য তিনি কোন পয়সা নেননি। এটা হচ্ছে মুসলিম আধিপত্যবাদের বহির্প্রকাশ। জিন্না তো নবী প্রেমি ছিলেন না। কোন ঘোর নাস্তিক যদি তার পারিবারিক ধর্ম ইসলাম হয় তাহলে কোন অমুসলিম থেকে নবী সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি শুনে তাহলে তার দম্ভে লাগে। পাকিস্তান হচ্ছে মুসলমানদের আধিপত্যের সর্বচ্চো ফ্যাসিস্ট রূপ। পাকিস্তানে একজনও অমুসলিম না থাকলেও তারা প্রতিবেশী হিন্দুস্থানের উপর মুসলিম আধিপত্য দেখাতে নানা রকম ছলচাতুরি করতেই থাকবে। এটাই পাকিস্তান আইডোলজি।

পাকিস্তান তো মাদ্রাসার লোকজন চালায় না। পাকিস্তান চালায় তাদের সেনাবাহিনী ও আশরাফ মুসলমানদের অভিজাত কিছু পরিবার। এরা সকলেই ইকবাল ও জিন্নার মত ননমাদ্রাসা ফেরত। তফাতটা দেখুন, আফগানিস্থানে শিক্ষিত ও ধনী পরিবারগুলো সকলেই আধুনিক আফগানিস্থানপন্থী। কিন্তু পাকিস্তানেই সেটি উল্টো! কারণ তারা দ্বিজাতিতত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলো। ১৯২৯ সালের পর থেকে ইকবাল ভাবিকালের পাকিস্তানের রূপরেখা নিয়ে বিস্তর বইপত্র লিখেন ও প্রচুর বক্তৃতা দিতে থাকেন। তারই একান্ত প্রচেষ্টায় জিন্নার সাহস হয় পাকিস্তান বাস্তবায়নে। ফলে হুমায়ুন আজাদ যখন বলেন, ‘পাকিস্তান ফুল নিয়ে আসলেও তাকে আমি বিশ্বাস করি না’ এখানে গভীর দার্শনিক অর্থ আছে। কেন পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে না সেটাই আমি একটু লম্বা করে বললাম।

সেই পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে দোস্ত পাততে চাচ্ছে বাংলাদেশ। এটা আর নতুন করে বাংলাদেশের কি সর্বনাশ করবে কিংবা আর কি কি সর্বনাশ হতে পারে- তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে কোন রকম রাষ্ট্রীয় সম্পর্কই যে ধ্বংস এতে কোন বিতর্ক নেই।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted