প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামিক আগ্রসন এবং ভারতীয় রাজাদের সফল প্রতিরোধ, পঞ্চম পর্ব
==============================================
কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের উত্থান
============================
কাশ্মীরি ঐতিহাসিক কালহানের রাজতরঙ্গিণীর বিবরণ অনুসারে মহান বীর ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় ছিলেন কারকোটা রাজবংশের অন্তর্গত কাশ্মীর নরেশ দুর্লভক ওরফে দ্বিতীয় প্রতাপাদিত্য আর রানি নরেন্দ্রপ্রভার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। ললিতাদিত্যের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তাঁর দুই অগ্রজ দাদা চন্দ্রপীড় আর তাঁরাপীড় কারাকোটা রাজবংশের রাজা হিসেবে কিছুকাল কাশ্মীর শাসন করেন।
তাঁরাপীড়ের মৃত্যুর পর ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে নতুন শাসক হিসেবে কাশ্মীরের রাজসিংহাসনে আসীন হন সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। দীর্ঘ ৩৬ বছর, ৭ মাস আর ১১ দিন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই মহান যোদ্ধার শাসনকাল। চাঁচনামা গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিমের একের পর এক জিহাদি আগ্রাসন দ্বারা যখন ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে সিন্ধু রাজ্য তখন সিন্ধু নরেশ রাজা দাহির শাহ এক পত্র প্রেরণ করে কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের নিকট সেনা সাহায্যের প্রার্থনা করেন। কিন্তু সেই সময় অনত্র যুদ্ধে ব্যাস্ত থাকায় রাজা দাহির শাহকে সামরিক সাহায্য পাঠাতে পারেননি সম্রাট ললিতাদিত্য। রাজতরঙ্গিণী আর চাঁচনামার বিবরণ পাঠ করে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এতোই যদি শক্তিশালী সম্রাট হবেন ললিতাদিত্য তাহলে যদি কেন তিনি রাজা দাহিরকে সাহায্য করলেন না আর কেনই বা ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন বিজাতীয় খলিফা বাহিনীর জিহাদি আগ্রাসন থেকে ভারতবর্ষের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ? এই প্রশ্নের জবাবে MA Stein, Hermann Goetz, André Wink, রমেশচন্দ্র মজুমদার, তানসেন সেন, দশরথ শর্মা, গৌরীশঙ্কর ওঝাদের মতো আধুনিক ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন কালহানের দ্বারা বর্ণিত সম্রাট ললিতাদিত্যের শাসনকালের সময়সীমা সঠিক নয়। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা পেশ করেছেন চিনের তাং সাম্রাজ্যের সমকালীন ঐতিহাসিকদের দ্বারা লিখিত পুস্তকের রেফারেন্স। তাং সাম্রাজ্যের সাথে কাশ্মীরের মৈত্রতার সম্পর্ক ছিল। ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে তাং সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকদের লেখা পুস্তকের বিবরণ অনুসারে সম্রাট ললিতাদিত্যের এক পূর্বসূরি কাশ্মীর নরেশ তাঁরাপীড় বা চন্দ্রপীড় তাং রাজদরবারে রাজদূত প্রেরণ করেছিলেন। এসব কারনে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ নয়, খুব সম্ভবত ৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যাভিষেক ঘটেছিল সম্রাট ললিতাদিত্যের। তাঁর যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ আর সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিমপর্ব থেকে। ঐতিহাসিক তানসেন সেনের মতানুসারে চিনের তাং সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকদের দ্বারা লিখিত পুস্তক “New Book of Tang” এর বিবরণ অনুসারে ৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাং সম্রাটের রাজদরবারে নিজের রাজদূত প্রেরণ করেন কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতানুসারে কালহানের রাজতরঙ্গিণীর বিবরণ অনুসারে ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয় বরং ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল মহান সম্রাট ললিতাদিত্যের শাসনকাল।
তাঁরাপীড়ের মৃত্যুর পর ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে নতুন শাসক হিসেবে কাশ্মীরের রাজসিংহাসনে আসীন হন সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। দীর্ঘ ৩৬ বছর, ৭ মাস আর ১১ দিন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই মহান যোদ্ধার শাসনকাল। চাঁচনামা গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিমের একের পর এক জিহাদি আগ্রাসন দ্বারা যখন ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে সিন্ধু রাজ্য তখন সিন্ধু নরেশ রাজা দাহির শাহ এক পত্র প্রেরণ করে কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের নিকট সেনা সাহায্যের প্রার্থনা করেন। কিন্তু সেই সময় অনত্র যুদ্ধে ব্যাস্ত থাকায় রাজা দাহির শাহকে সামরিক সাহায্য পাঠাতে পারেননি সম্রাট ললিতাদিত্য। রাজতরঙ্গিণী আর চাঁচনামার বিবরণ পাঠ করে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এতোই যদি শক্তিশালী সম্রাট হবেন ললিতাদিত্য তাহলে যদি কেন তিনি রাজা দাহিরকে সাহায্য করলেন না আর কেনই বা ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন বিজাতীয় খলিফা বাহিনীর জিহাদি আগ্রাসন থেকে ভারতবর্ষের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ? এই প্রশ্নের জবাবে MA Stein, Hermann Goetz, André Wink, রমেশচন্দ্র মজুমদার, তানসেন সেন, দশরথ শর্মা, গৌরীশঙ্কর ওঝাদের মতো আধুনিক ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন কালহানের দ্বারা বর্ণিত সম্রাট ললিতাদিত্যের শাসনকালের সময়সীমা সঠিক নয়। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা পেশ করেছেন চিনের তাং সাম্রাজ্যের সমকালীন ঐতিহাসিকদের দ্বারা লিখিত পুস্তকের রেফারেন্স। তাং সাম্রাজ্যের সাথে কাশ্মীরের মৈত্রতার সম্পর্ক ছিল। ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে তাং সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকদের লেখা পুস্তকের বিবরণ অনুসারে সম্রাট ললিতাদিত্যের এক পূর্বসূরি কাশ্মীর নরেশ তাঁরাপীড় বা চন্দ্রপীড় তাং রাজদরবারে রাজদূত প্রেরণ করেছিলেন। এসব কারনে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ নয়, খুব সম্ভবত ৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যাভিষেক ঘটেছিল সম্রাট ললিতাদিত্যের। তাঁর যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ আর সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিমপর্ব থেকে। ঐতিহাসিক তানসেন সেনের মতানুসারে চিনের তাং সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকদের দ্বারা লিখিত পুস্তক “New Book of Tang” এর বিবরণ অনুসারে ৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাং সম্রাটের রাজদরবারে নিজের রাজদূত প্রেরণ করেন কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতানুসারে কালহানের রাজতরঙ্গিণীর বিবরণ অনুসারে ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয় বরং ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল মহান সম্রাট ললিতাদিত্যের শাসনকাল।
যুদ্ধভূমিতে রণনীতি, শৌর্য আর পরাক্রমে তিনি ছিলেন প্রাচীনকালের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্রগুপ্ত, স্কন্ধগুপ্ত আর মধ্যযুগের উৎকল সম্রাট কপিলেন্দ্রদেব, বিজয়নগরে সম্রাট কৃষ্ণদেব রায় আর মারাঠা পেশোয়া বাজীরাও বল্লালের মতোই অদ্বিতীয়, নির্ভীক আর অপ্রতিরোধ্য। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে এইসব মহান ভারতীয় সম্রাট ও যোদ্ধাদেরও ছাপিয়ে গেছিলেন নির্ভীক সম্রাট ললিতাদিত্য। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পর তিনিই একমাত্র ভারতীয় সম্রাট যার তরবারির স্পর্শে কাশ্মীর সাম্রাজ্য আদি ভারতবর্ষের মানচিত্র অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছিল সদুর ইরান, তুর্কমেনিস্থান, তিব্বত আর চিনের তাং সাম্রাজ্যের অন্তর্গত তাকলামাকান আর গোবি মরুভূমির বালুকাবেলায়। বিদেশি শ্বেতাঙ্গ ঐতিহাসিকরা কাশ্মীর নরেশকে গ্রীক সাম্রাজ্যের স্থপতি আলেকজান্ডারের সাথে তুলনা করে "ভারতের আলেকজান্ডার" উপাধিতে ভূষিত করলেও টাইম ট্র্যাভেলের সাহায্যে এই দুই মহান যোদ্ধার মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারকেও পরাজিত করবার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের পক্ষে। উত্তর-পশ্চিমে কম্বোজ মহাজনপদ অর্থাৎ হরিয়ানা, পাঞ্জাব আর আফগানিস্থানের গান্ধার ও হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে পারস্য আর তুর্কমেনিস্থানের কিছু অংশ পর্যন্ত, উত্তর-পূর্বে প্রাগজ্যোতিষ অর্থাৎ অসমের কামরূপ পর্যন্ত, পূর্বাঞ্চলে অঙ্গের বিহার, বঙ্গের গৌড় হয়ে কলিঙ্গ পর্যন্ত, দক্ষিণে বিন্দ্য পর্বত অতিক্রম করে কাবেরি নদি পর্যন্ত, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকা আর অবন্তী রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল মহান আর অপরাজিত সম্রাট ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্য। এছাড়াও রণভূমিতে তিনি পরাজিত করেছিলেন তৎকালীন কোনৌজের আরেক মহাশক্তিশালী সম্রাট যশবর্মণকে, তৎকালীন কর্ণাটকের রাষ্ট্রকূট নরেশ রাজা প্রথম ইন্দ্রের স্ত্রী তথা বিখ্যাত বিন্দ্যবাসিনী নারী যোদ্ধা রানি রাট্টাকে (রাট্টার অর্থ রাষ্ট্রকূট), প্রবল প্রতাপশালী গুহিলট সর্দার বাপ্পাদিত্য রাওয়াল (মহারানা প্রতাপ সিংহদের আদি পূর্বপুরুষ), অখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আফগানিস্থানের গান্ধার, কপিশা, জাবুলিস্থানের স্থানীয় তুর্কি শাহী শাসকদের পরাজিত করে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ইরান আর তুর্কমেনিস্থানের তুর্কিজাত শাসকদের পরাজিত করেছিলেন তিনি, পামির মালভূমি অতিক্রম করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশ দখলকারী আগ্রাসী তিব্বতি সাম্রাজ্য আর চিনের মহাশক্তিশালী তাং সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকেও পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছিল উমেদ খলিফার জিহাদি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্রাট ললিতাদিত্যের অভূতপূর্ব আর গৌরবশালী মহাবিজয় পর্ব। এককথায় বলতে গেলে ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে আল জুনেদের জিহাদি বাহিনী রীতিমতো আড়ং ধোলাই দিয়ে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত আর ছিন্নভিন্ন করে ভারতবর্ষের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে উৎখাত করতে সফল হয়েছিলেন তিনি। এই মহাযুদ্ধে তাঁকে সামরিক দিক থেকে সহায়তা করেছিলেন তাঁর এক চিরশত্রু তথা কোনৌজ নরেশ সম্রাট যশবর্মণ।
কোনৌজ নরেশ যশবর্মণের বীরগাঁথা
======================
অপরদিকে বাকপতির গৌড়বাহের বিবরণ অনুসারে পুস্পবতী রাজবংশের সম্রাট হর্ষবর্ধনের তিরোধানের পর কান্যকুব্জের বর্মণ রাজবংশের সম্রাট যশবর্মণ ছিলেন কোনৌজের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট। শৌর্য আর পরাক্রমে সম্রাট যশবর্মণ ছিলেন প্রায় হর্ষবর্ধনের সমতুল্য। খুব সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে অর্থাৎ আল জুনেদের হানাদারির সময়কালে তিনি ছিলেন কান্যকুব্জের একছত্র অধিপতি। সম্রাট ললিতাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হবার পূর্বে উত্তর আর উত্তর-পূর্ব ভারত, বিহার, বঙ্গ আর কলিঙ্গের প্রভূত ভূখণ্ড কান্যকুব্জের বর্মণ সাম্রাজ্যের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। রাজতরঙ্গিণীর বিবরণ অনুসারে কাশ্মীরের কারাকোটা রাজবংশের সম্রাট ললিতাদিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ভারতীয় প্রতিপক্ষ ছিলেন কোনৌজ নরেশ যশবর্মণ। ললিতাদিত্যের বিরুদ্ধে যশবর্মণের যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। ললিতাদিত্যের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তাঁর দুই পূর্বসূরি দাদা চন্দ্রপীড় আর তাঁরাপীড়কে পরাজিত করে কাশ্মীরেরও বেশ কিছুটা ভূখণ্ড কোনৌজের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছিলেন তিনি। সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হয়ে যশবর্মণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ললিতাদিত্য। অনেকটা পরবর্তীকালের আজমির নরেশ পৃথ্বীরাজ চৌহান আর কোনৌজ নরেশ জয়চন্দ্র গাহাড়ওয়ালের মতোই দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। অবশেষে যুদ্ধে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কাশ্মীর নরেশকে সন্ধি প্রস্তাব প্রদান করেন যশবর্মণ। নিজেও বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া ললিতাদিত্য প্রাথমিকভাবে সেই সন্ধি প্রস্তাবে সম্মতিদান করেন। কিন্তু বেঁকে বসেন ললিতাদিত্যের এক অমাত্য মিত্রশর্মা। তিনি বলেন যেহেতু এই সন্ধি প্রস্তাবে কোনৌজ নরেশ যশবর্মণের নাম সম্রাট ললিতাদিত্যের নামের আগে লিখিত হয়েছে সেহেতু এই অপমানজনক সন্ধি প্রস্তাবে কিছুতেই সায় দেওয়া উচিত নয় কাশ্মীর নরেশের। মিত্রশর্মার এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে সন্ধি চুক্তি নাকচ করে দিয়ে ফের যশবর্মণের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধ ঘোষণা করেন ললিতাদিত্য। এবারে এই যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে স্বাধীনতা হারিয়ে কাশ্মীরের এক সামন্ত রাজে পরিণত হন যশবর্মণ। কিন্তু এসব কিছুই ঘটেছিল ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দের আল জুনেদের জিহাদি আগ্রাসনের অনেক পরে।
ভারতের পরিত্রাতা সম্রাট ললিতাদিত্য
=======================
একে একে কর্ণাটক, গুজরাট আর রাজস্থানকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিম পর্বে কোনৌজের দিকে ধাবিত হলো আল জুনেদের অপ্রতিরোধ্য খলিফা বাহিনী। কিছুদিন আল জুনেদের খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুললেন কোনৌজ সম্রাট যশবর্মণের সামন্ত রাজারা। কোনৌজ বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে গতিপথ বদলে আল জুনেদের জিহাদি বাহিনী এবারে অগ্রসর হলো পাঞ্জাবের দিকে। মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন পাঞ্জাবের সামন্ত রাজারা। তাঁরা এবং কান্যকুব্জ ও রাজস্থানের পরাজিত রাজারা একত্রিত হয়ে পত্র প্রেরণ করলেন কাশ্মীর নরেশ সম্রাট ললিতাদিত্যের রাজদরবারে। যথা সময়ে সেই পত্র এসে পৌঁছল সম্রাটের রাজপ্রাসাদে। পত্র পাঠ করলেন রাজচক্রবর্তী সম্রাট ললিতাদিত্য। রাজতরঙ্গিণীর বিবরণ অনুসারে সেই পত্রে যা লেখা ছিল বাংলায় অনুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এরকম, “হে অজিঙ্কিয়া রাজ চক্রবর্তী কাশ্মীর নরেশ, আপনার মহান তরবারির তলে একে একে পরাভূত হয়েছে আর্যবর্তের তামাম শক্তিশালী রাজা-মহারাজারা। আপনার পরাক্রমের সম্মুখে নতনাজু হয়েছে তুরান আর মাকরানের বিজাতীয় শাসকরা, আপনার শৌর্য ও বীরত্বের সুকঠিন লৌহ শৃঙ্খলে আজ বাঁধা পড়েছে কম্বোজ থেকে গান্ধার, কুরু থেকে প্রাগজ্যোতিষ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ থেকে অবন্তী ও উজ্জয়নী পর্যন্ত ভারতবর্ষের এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড। আজ সেই ভূখণ্ডই আক্রান্ত হয়েছে এক বিশেষ বিজাতীয় ম্লেচ্ছ বাহিনীর দ্বারা, যাদের দণ্ডের আঘাতে ধ্বস্ত হচ্ছে আমাদের উপাসনাস্থল, যাদের বক্র অসির আঘাতে গোরক্ত দ্বারা অপবিত্র হচ্ছে ভারতবর্ষের ভূমি, যাদের দ্বারা হরণ হচ্ছে মা দুর্গার প্রতিরূপ ভারতীয় নারীরা আর লুণ্ঠিত হচ্ছে ভারতবর্ষের ভূস্বামীগণ। এখন একমাত্র আপনার মহান তরবারিই পারে আর্যবর্তের ভূমি থেকে এই বিজাতীয় লুণ্ঠক বাহিনীকে বিতাড়িত করে আর্যবর্তের পবিত্রতা আর স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে। আজ ভারতবর্ষের এই বিপদ লগ্নে একমাত্র আপনার অসিই পারে ভারতমাতার সম্ভ্রম রক্ষা করতে।”
এই পত্র পাঠ করে ক্ষত্রিয় রক্ত গরম হয়ে উঠলো সম্রাট ললিতাদিত্যের। তিনি তৎক্ষণাৎ আল জুনেদ আর তার জিহাদি বাহিনীকে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যপারে মনস্থিত করে ফেললেন। কিন্তু রণকুশলী ললিতাদিত্য সম্পূর্ণ রূপে অজ্ঞাত খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন এই যুদ্ধে একক শক্তিতে অবতীর্ণ হতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের স্বতন্ত্রতা আর পবিত্রতা রক্ষার আর্জি জানিয়ে সামরিক সহায়তা চেয়ে পাঠালেন প্রতিবেশী চিরশত্রু কোনৌজ নরেশ যশবর্মণের নিকটে। এদিকে ইতিপূর্বেই খলিফা বাহিনীর দ্বারা কোনৌজের বেশ কিছু অংশ আক্রান্ত হবার ফলে খলিফা বাহিনীর বিরুদ্ধে যারপরনাই চটে থাকা সম্রাট যশবর্মণও বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন কাশ্মীর নরেশের প্রস্তাবে। দুঃখের বিষয় আরও ৪৬৬ বছর পরে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় এহেন সন্ধি করতে ব্যর্থ হন পৃথ্বীরাজ আর জয়চাঁদ। যাইহোক এরপর ললিতাদিত্য আর যশবর্মণের বাহিনী সম্মিলিত হয়ে ভারত মহাসাগরের জলরাশির ন্যায় এক সুবিশাল আকার ধারণ করে গৈরিক ধ্বজ শূন্যে উত্থলিত করে গগনভেদি “হর হর মহাদেব” রবে রণহুঙ্কার দিতে দিতে পাঞ্জাবের নিকটে অবস্থানকারী আল জুনেদের জিহাদি খলিফা বাহিনীর দিকে সবেগে ধাবিত হলো।
(পরবর্তী পর্বে আসছে কাশ্মীর সম্রাটের রুদ্ররোষে ছারখার হলো আরবের খলিফা বাহিনী)
চতুর্থ পর্বের লিঙ্কঃ
https://www.facebook.com/100995755029464/posts/266339465161758/?sfnsn=wiwspmo
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................