*চৌষট্টি যোগিনী মন্দির*
*প্রথম পর্ব*
জাদুবিদ্যায় পারদর্শীনী যোগিনীরা নাকি সকল ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন। তাঁরা ভক্তদের মনের কথা বুঝে নিয়ে ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। আর ভক্তদের আরাধনায় সন্তুষ্ট হলে যোগিনীরা সশরীরে ভক্তদের সামনে আবির্ভূতাও হন। বিশ্বাস করা হয় যে যোগিনীরা অর্ধ মানব এবং অর্ধ ঐশ্বরিক। তাঁরা ভীষণ ও অসীম ক্ষমতার অধিকারীনী। কথিত আছে, মনোবাঞ্ছা পূরণের তাগিদে ভক্তরা এই যোগিনীদের পুজো করতেন।
টাটকা হলুদ রঙের গাঁদা ফুল পিষে তা যোগিনীদের পায়ে লেপে দেওয়া হত। লাল জবা কপালে ঠেকানো হত। পাথরের বাটিতে কর্পূরও জ্বালানো হত। এর পর যোগিনীর সামনে মাথা ঠেকিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করা হত। অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করে যোগিনী ও ভক্তদের মধ্যে বার্তা আদানপ্রদান হত। প্রচলিত একটি কাহিনি হলো, দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে অষ্টমাতৃকার সৃষ্টি হয়। এই অষ্টমাতৃকার একেকজন আবার আরও আটটি ভাগে ভাগ হয়ে মোট চৌষট্টি যোগিনীর সৃষ্টি করেছে। চৌষট্টি যোগিনীর সাথে তন্ত্রসাধনার বিশেষ যোগ রয়েছে।
যোগিনী তন্ত্রকে মূলত 64 টি ভাগে ভাগ করা হয়। তাই সাধারণভাবে যোগিনীর সংখ্যাও 64 ধরা হয়। তবে কোথাও কোথাও 42 বা 82 যোগিনীর উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত যোগিনী মন্দিরগুলি বৃত্তাকার এবং ছাদবিহীন হয়। মন্দিরে 64টি ভাগ থাকে যেগুলিকে 'আরা' (কিরণ) বা 'ডালা'(পাঁপড়ি) বলা হয়।
তন্ত্র সাধনার সাথে এই যোগিনী মন্দিরগুলির বিশেষ যোগ ছিলো। একমাত্র খাজুরাহতে অবস্থিত চৌকাকার মন্দির ছাড়া বাকি চারটে জায়গাতে বৃত্তাকার মন্দির রয়েছে। বৃত্ত একসঙ্গে সূর্য, চন্দ্র, চক্ষু, সময়, রাশিচক্র এবং অনন্তকে বোঝায়। বৃত্ত কোনো সূচনা বা সমাপ্তির ব্যতিরেকেই নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বাইরের সমস্তকিছুকেই আলাদা করে দেয়। আবার বৃত্ত আত্মাকেও বোঝায়। বিশেষ প্রকারের তন্ত্র সাধনায় চক্রের গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যখন বিভিন্ন যোগিনী মূর্তিগুলি সেই চক্রের মধ্যে অধিষ্ঠান করানো হয়, তাকে যোগিনীচক্র বা যোগিনী মন্দির বলা হয়। কোনও কোনও তান্ত্রিক পাঠে ওই মন্দিরকে 'মণ্ডল' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মাতোত্তারা তন্ত্রে যোগিনীচক্র এবং চৌষট্টি যোগিনীর উল্লেখ রয়েছে। ভারতে কৌলার্নাভা তন্ত্রের অধীনে তন্ত্র চর্চার জন্য যোগিনী মন্দিরগুলির নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশেষ এই তন্ত্রটির চর্চা উড়িষ্যার হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনী মন্দির থেকে শুরু হয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পরেছিল। হিরাপুর ছাড়া ভারতের অন্যান্য যেসব জায়গায় যোগিনী মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষের কিছু উল্লেখ পাওয়া গেছে তা হল, জব্বলপুরের ভেদঘাট, মধ্যপ্রদেশের দুদাহি, বাদো ও শাহদোল, উত্তরপ্রদেশের লোখারি, খাজুরাহ ও রিখিয়ান, গোয়ালিয়রের মিতাওলি ও নরেসার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তের হিংলাজগড়, ওড়িষার রানিপুর-ঝরিয়াল এবং দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চিপুরম। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের বেনারস বা কাশীতে গঙ্গার একটি ঘাট সংলগ্ন চৌষট্টি দেবী মন্দির রয়েছে। এখানে কিন্তু মন্দিরটি ছাদবিহীন নয়। একটিমাত্র দেবী মূর্তিই চৌষট্টি দেবীর প্রতিভূ। ঘাটটির নামও চৌষট্টি যোগিনী ঘাট। এরমধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। ভগ্নমূর্তিগুলি বিভিন্ন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
যোগিনী হলো দেবী কালীকার সহচরী, তবে দশ মহাবিদ্যার মতো অষ্ট মাতৃকা হলো প্রধান আদি শক্তি মহামায়ার আংশ আর এই আষ্ট মাতৃকার এক এক জনের আট জন সহচরী বা পরিচারিকা আছে যাদের একযোগে ৬৪টি যোগিনী বলা হয়।
*ক্রমশ*
তথ্যসূত্র-- বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন বই
ছবি-- ইন্টারনেট
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................