মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতিদিন দলবেধে বইমেলায় যাওয়াটা একটা পরিকল্পনার অংশ।

মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতিদিন দলবেধে বইমেলায় যাওয়াটা একটা পরিকল্পনার অংশ। আগে বইমেলা, পহেলা বৈশাখ, শহীদ মিনার, বিজয় দিবস- এসবে ইসলামিকদের এলার্জি ছিলো। পরে তারা চিন্তা করে দেখল এই জায়গাগুলোর দখল না নিলে এসব জায়গা থেকে উদার সেক্যুলার জনমানুষের জন্ম হবে। কাজেই মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে এসবের মধ্যে গিয়ে জিনিসগুলোকে ইসলামিক চেহারা দিতে হবে। যেমন পহেলা বৈশাখে বেশ কয়েকটা কওমি ও জামাতী সংস্কৃতি সংগঠন ঘটা করে অনুষ্ঠান করে থাকে। তারা পহেলা বৈশাখে তাদের ইসলামিক গান, রাজনৈতিক চেতনার কবিতা দিয়ে অনুষ্ঠান করে। কওমিদের একটা দলের নাম দাবাণল, জামাতীদের সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠি। এরাই এখন শহীদ মিনারে গিয়ে নামাজ পড়ছে। সামনের দিনগুলিতে শহীদ মিনারে এরা তাদের ইসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চালাবে। ইসলামিক সাংস্কৃতি হচ্ছে মুসলমান জাতীয়তাবাদ। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের নিউক্লিয়াসে এই জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা করার কিছু আছে। জ্ঞান তাপস বলে খ্যাত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে যখন আবুল ফজল হিন্দুত্ববাদী বলে আক্রমন করেছিলো তখন শহীদুল্লাহর মত শিক্ষিত মানুষ নিজেকে আত্মরক্ষা করে নিজের জাতি পরিচয় তুলে ধরেছিলেন এভাবে-

‘আমি নাকি আগে বাঙালী পরে মুসলমান, এইরূপ মত প্রচার করিয়াছি। তিনি কি আমার অসংখ্য লেখা হইতে এইরূপ কোনও উক্তি উদ্ধৃত করিতে পারেন? আসল কথা আমি আমার অভিভাষণে বলিয়াছিলাম যে আমরা বঙ্গদেশবাসী হিন্দু ও মুসলমানগণ ধর্ম্মে ও আচারে পৃথক হইয়াও আমরা ভাষাভাষী হিসাবে বাঙালী। সমালোচক ইহারই কদর্থ করিয়াছেন। কিন্তু আল্লাহ পাক এবং যাঁহারা আমাকে ঘরে বাহিরে জানেন তাঁহারাই ভালভাবে জানেন যে আমি কিরূপ মুসলমান, আমার আকীদা এবং আমার আমল কিরূপ। আমি শুধু এইটুকু বলিয়া ক্ষান্ত হইব যে আলহামদুলিল্লাহ। আমি সমালোচক হইতে কোন অংশে কম মুসলমান বা পাকিস্তানী নই (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, দৈনিক আজাদ)।

আমি একবার বলেছিলাম যে, চরমোনাই পীরের সিলেবাস পরিবর্তন নিয়ে সাম্প্রদায়িক নোংরামী, আহমদ শফি বাবুনাগরীর কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের পরম্পরা। এটা শুরু করেছিলো প্রগতিশীল বলে পরিচতজনরাই। পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য পাঠ্যসূচী নিয়ে আবুল ফজল লিখেন-

“মেঘনাদবধ’ কাব্য রাম-রাবণের লড়াই আমাদের পড়িতে হইবে অথচ মহাশ্মশানের দুই সর্গ পড়া হইবে না! মোহিতলাল মজুমদার-সম্পাদিত ‘কাব্যমঞ্জুষা’ পাঠ্য হইয়াছে অথচ ড. এনামুল হক-সম্পাদিত ‘কাব্যকুঞ্জ’ বা রেজাউল করীম ও আবদুল কাদির-সম্পাদিত ‘কাব্যমালঞ্চ’ পাঠ্য করা হয় নাই! ইহা কী মুসলেম বিদ্বেষ নহে? আর ‘কাব্যমঞ্জুষা’ হইতে বাছিয়া বাছিয়া হিন্দু লেখকদের হিন্দু ভাবাপন্ন কবিতাগুলিই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হইয়াছে। সেই গ্রন্থ হইতেও মুসলমান কবিদের রচনা (একটি কি দুটি ছাড়া) পাঠ্য করা হয় নাই! সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম ও ড. এনামুল হক-সম্পাদিত আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য এত মূল্যবান গ্রন্থ যে তাহা প্রকাশিত হওয়ার পর ডা. সুনীতিকুমার তাঁহার ‘ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ বইতে সংশোধনী পরিচ্ছেদ যোগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বাংলা সাহিত্যের একাধিক বিশেষজ্ঞ এই বইটির মূল্যবান অবদান সম্বন্ধে মন্তব্য করিয়াছেন, নিজেদের মতামত পর্যন্ত সংশোধন করিয়াছেন! অথচ সেই বইটিও পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয় নাই। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, গীতগোবিন্দ, চন্ডীমঙ্গল, ধর্ম্মমঙ্গল, সারদামঙ্গল সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দয়া করিয়া পাঠ্য করিয়াছেন অথচ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামনি’ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই গ্রন্থের প্রকাশক) পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা হয় নাই! ইহাকেও মুসলেম বিদ্বেষ বলিব না ত কী বলিব? জনা, কৃষ্ণকুমারী, পুরুবিক্রম ইত্যাদি সম্পূর্ণ হিন্দু ভাবাপন্ন নাটক পাঠ্য করা হইয়াছে অথচ… ও পাকিস্তানের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী নাটক পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয় নাই’!”

এই বক্তব্য কি চরমোনাই পীর, শফি-বাবুনাগরীর চাইতে পৃথক কিছু? কাজেই আমরা বেহুদাই একুশে বইমেলাকে ‘কিতাব মেলা’ বলছি। এমন তো নয় আমরা হঠাৎ করে পেছনে হাঁটা শুরু করেছি। আমাদের চেতনায় কিতাব মেলাই ছিলো। শহীদ মিনারে নামাজ পড়াটাই নতুন। এক সময় শহীদ মিনারের বিরোধীতা করা হত। এটা দখল করে এখন নামাজ পড়া হচ্ছে। সামনে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার পরিবর্তে সকাল থেকে দিনব্যাপী কুরআন তেলাওয়াত কর্মসূচী গ্রহণ করলে এর প্রতিবাদ করার মত খুব বেশি মানুষ অবশিষ্ঠ থাকবে না। কারণ এখানে যারা বই লেখে, গান গায়, সিনেমা বানায় তারা সকলেই আবুল ফজলের ডিএনএ বহন করে চলেছে। এই ডিএনএ দ্বিজাতি তত্ত্বের নকশা বহন করে চলেছে…।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted