ব্রাহ্মণ‍্যবাদ ও বর্ণবাদ শব্দ দু'টি সমার্থক নয়।

ব্রাহ্মণ‍্যবাদ
-----------------            প্রথম কিস্তি

(ব্রাহ্মণ‍্যবাদ ও বর্ণবাদ শব্দ দু'টি সমার্থক নয়)

যে কোন মূল‍্যে হিন্দু জাতিকে সমমর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যের বিকল্প কেবল একটাই - বিলুপ্তি। প্রশ্ন হচ্ছে, এত ভেদ-বিদ্বেষ নিয়ে হিন্দুরা কি ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে ? পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কোন কথা নেই, সবকিছুই সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, হিন্দু জাতির ঐক্যের পক্ষে গবেষণা, লেখালেখি ও প্রচার নেই বললেই চলে। সবাই  একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে ব‍্যস্ত ; ফলে বিভাজন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অদ‍্যবধি এমন একটি দিন নেই, যেদিন আমাকে স্বজাতির কাছ থেকে ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষী কটুক্তি শুনতে হয় নি। বড় হয়ে কটুক্তিকারীদের বলেছি, আমার যদি কোন আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকেন,অথবা আমার যদি কোন ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে,সেটা বলুন। গোষ্ঠী-বিদ্বেষ প্রসূত কল্পিত সামষ্টিক-অভিযোগ এনে, আমাকে অনবরত আঘাত করা হচ্ছে কেন? আপনারা কি আমাকে অন্য ধর্মে ঠেলে পাঠাতে চান ?

কটুক্তিকারীরা বলতো, ব্রাহ্মণ‍্যবাদী শোষণের হাত থেকে যেকোন মূল্যে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।

বলতাম, এতো খুবই সহজ। ব্রাহ্মণরা তো আপনার বাড়িতে জোর করে পূজা করতে যায় না, জবরদস্তি করেও দক্ষিণা আদায় করে না। আপনি ডাকেন বিধায় পূজা করতে যায়। আপনার দেওয়া দক্ষিণায় সন্তুষ্ট না হয়ে, হয়ত বাড়তি দু'চার টাকা চায়। ঠিক আছে, পূজা করাতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডাকলেন না। নিজের পূজা নিজেই করুন। ব্রাহ্মণদের আর দক্ষিণা দিতে হবে না ; ব্রাহ্মণ‍্যবাদী শোষণ থেকে জাতি রক্ষা পেয়ে যাবে।

তারা বলতো, কেবল পূজা করার মধ্যে ব্রাহ্মণ‍্যবাদী শোষণ সীমাবদ্ধ নেই ; ব্রাহ্মণরা হাজার হাজার বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে, হিন্দু জাতিকে শুষে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।

বলতাম, হাজার হাজার বছরের দৃষ্টান্তের দরকার নেই, বাংলার পৌরানিক ও প্রামানিক ইতিহাসে অন্তত একজন ব্রাহ্মণ শাসকের নাম বলুন। 

অবিভক্ত বাংলায় কোন কালেই কোন ব্রাহ্মণ শাসক ছিল না। রাষ্ট্রীয় শাসন-অধিকার-বঞ্চিত ব্রাহ্মণরা পূজা-পার্বন করে যা সামান্য আয় করে, তা দিয়ে তারা প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করে। যাদের হাতে অর্থ নেই,তাদের কোন প্রতিপত্তি থাকার কথা নয় ; সমাজের মানুষ অর্থহীন-ক্ষমতাহীন ব্রাহ্মণদের পাত্তা দেবে কেন! ব্রাহ্মণদের হাতে কোন কালেই সমাজের নিয়ন্ত্রণ-ভার ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই অসহায়,দরিদ্র,প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন ব্রাহ্মণদের টার্গেট করে মিথ্যা-অপপ্রচার চালানো হচ্ছে কেন ?

যারা দিনরাত অক্লান্ত ভাবে, ব্রাহ্মণ-বিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা কি কখনো তাদের বাড়ির পাশের দরিদ্র কোন পূজারী ব্রাহ্মণ পরিবারের দিকে তাকিয়ে দেখেছে যে, তারা কত দুঃখ-দুর্দশার মধ‍্যে দিনানিপাত করছে। এরা বিধর্মী লুঠেরাদের সকাল-সন্ধ্যা চরন-ধৌত করে সম্মান প্রদর্শন করতে পারে, অথচ স্বজাতি ব্রাহ্মণদের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা বোধটুকুও নেই। কেন নেই ? কারণ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই একজন হিন্দুর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়,তীব্র ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ। যারা প্রতিটি সরলমতি শিশুর মগজে তীব্র ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে - তারা নিজেরাও জানে না যে,ব্রাহ্মণদের প্রকৃত অপরাধটা আসলে কি? এভাবে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সমস্ত সর্বনাশের দায় অযৌক্তিক ভাবে ব্রাহ্মণদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায়, সমাজে এই ভয়ঙ্কর ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ চাউর হয়েছে - ফলশ্রুতিতে সর্বকালে আড়ালে থেকে গেছে প্রকৃত সমস্যা। দরিদ্র-দুর্বল ব্রাহ্মণরা মুখবুজে সমস্ত অপমান হজম করেছে, প্রতিবাদ করার শক্তি তাদের ছিল না,এখনো নেই। এমনকি ব্রাহ্মণ পরিবারের যে সমস্ত সন্তান পেটের তাড়নায় অন্য পেশায় চলে গেছে, তারাও যে যার কাজে ব‍্যস্ত থেকেছে ; অনেকেই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে, সেক‍্যুলার-নাস্তিক হয়ে গেছে ; কেউ কেউ অন‍্যধর্মেও চলে গেছে ; কেউ প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে নি।

এই ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষের তথ‍্যানুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই দেখলাম, অস্পৃশ‍্য-দলিত এবং বাংলার বৃহত্তম অবহেলিত জনগোষ্ঠী নমঃশূদ্ররা অতীতে সবাই ব্রাহ্মণ ছিল। কায়স্থ সম্প্রদায়ের মধ্যে 'দত্ত' - পদবীধারীরাও ব্রাহ্মণ থেকে এসেছে। 

কায়স্থ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা প্রবচন  প্রচলিত আছে -
     
          "ঘোষ বংশ সেরা বংশ  
                   বোস বংশ দাতা
             মিত্র বংশ কুটিল বংশ
                    দত্ত হারামজাদা"

লক্ষ‍্যনীয় বিষয় হচ্ছে,এখানে মিত্রদের উদ্দেশ‍্যে ব‍্যবহৃত কুটিল শব্দটি,বিচক্ষণ অর্থে ব‍্যবহার করা হয়েছে। (যেমন মহামতি চাণক্যকে কুটিল বলা হতো)।
কিন্তু দত্ত বংশকে, 'হারামজাদা' - বলে গালি দেওয়া হলো কেন ? দেওয়া হয়েছে, এই কারণে যে, দত্ত বংশীয়রা বংশানুক্রমিক ব্রাহ্মণ থেকে এসেছে। দত্তরা রাজকর্মচারী ছিল বিধায়, তাদের ব্রাহ্মণ থেকে সরাসরি অস্পৃশ্য নমঃশূদ্রে পরিনত করা যায় নি ; মধ‍্যবর্ণ বানিয়ে রেখে, ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ-উদ্ভুত গালি - তাদের উদ্দেশ্যে যুগের পর যুগ ধরে পরিবেশন করা হচ্ছে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা হচ্ছে হারামি ; দত্তরা যেহেতু ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত - এজন্য হারামজাদা। (বিষয়টি আমি উপমা হিসেবে তুলে ধরলাম ; কেউ মনে কষ্ট নেবেন না)
হিন্দু জাতির অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষদের কিংবা বাঙালি অস্পৃশ‍্য শ্রেণির ত্রাণকর্তা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষদের যে ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে - তা খুব বেশি কাল আগেকার কথা নয়।

মানুষকে কথায় কথায় ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে বেড় করে দিয়ে, অস্পৃশ‍্য বানানোর মূল হোতা কারা ? আমি বছরের পর বছর ধরে এর কারণ অনুসন্ধান করতে করতে, একেবারে সমস্যার গোড়ায় পৌঁছে যাই এবং সেখানে পৌঁছে, হিন্দু জাতির সমস্ত সমস্যা সমাধানের মূলসূত্রটিরও সন্ধান পেয়ে যাই। হয়ত সাধারণ মানুষ আমার আলোচনা বুঝতে পারবেন না, কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষেরা সামান্য ইঙ্গিতেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।

অতীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কোন বর্ণভেদ ছিল না ; নারীপুরুষ সমানাধিকার ছিল। তখন সবাই ব্রাহ্মণ ছিল। আমি শাস্ত্রীয় প্রমাণ তুলে ধরছি ―

মহাভারতের 'শান্তি পর্ব' - এর  'ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদ' -

ভৃগুরুবাচ। ন বিশেষোঽস্তি বর্ণানাং সর্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ।
ব্রাহ্মণাঃ পূর্বসৃষ্টা হি কর্মভির্বর্ণতাং গতাঃ।।
ভৃগু বললেন,
আসলেই এই জগতে সকল বর্ণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। প্রথমে জগতে সবাই-ই ব্রাহ্মণ ছিল। কিন্তু পরে কর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই কর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন বর্ণে ভাগ হয়ে গেল। 
(১২.১৮১.১০)

স্রষ্টা ব্রহ্মার নাম অনুযায়ী সমগ্ৰ সৃষ্টির নাম ব্রহ্মাণ্ড। সৃষ্টি পরিচালনার জন্য স্রষ্টা মানুষের মস্তিষ্কে যে জ্ঞান দান করেছেন - সেই সৃষ্টি সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞানকে বলা হয় ব্রহ্মজ্ঞান। ব্রহ্মজ্ঞান যিনি ধারণ করেন তাঁকে বলা হয় ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মাজ্ঞান ব‍্যতীত জগতের কোন কর্ম নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয়। আদিপিতা ব্রাহ্মণ মনুর বংশধর হিসেবে, আমাদের পরিচয় 'মানুষ'। অন‍্যান‍্য আর্য ভাষায় মানুষ বাচক শব্দের মধ্যে, মনুর সংযোগ আছে।যেমন, ইংরেজি ভাষায় 'ম‍্যান', জার্মান-নরজিয়ান-সুইডিশ ভাষায় 'মান', ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় 'মানুষিয়া',চেক ভাষায় মুষ, ফিনিস ভাষায় মিয়েষ, ডাচ ভাষায় মেনষ -  ইত্যাদি। 
তুলনাতীত ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিগণ 'বেদ'-মন্ত্রের দ্রষ্টা। 'বেদ' - শব্দের অর্থ জ্ঞান। ব্রহ্মার মুখ-নির্গত অমোঘ জ্ঞান। আধুনিক সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতি-রাজনীতি-চিকিৎসাবিদ‍্যা প্রভৃতি সহ জাগতিক সমস্ত জ্ঞানের উৎস এই মহাধর্মগ্রন্থ পবিত্র 'বেদ'। ঐ যুগে লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। যেহেতু উৎকৃষ্ট ব্রহ্মজ্ঞানী তথা ব্রাহ্মণ ঋষি ও ঋষিকাগণ 'বেদ'-জ্ঞানের ব‍্যখ‍্যা করেছেন ; স্মৃতি ও শ্রুতি হিসেবে ধর্ম-শাস্ত্রের ধারন-বাহন-প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন - এজন্য সনাতন ধর্মশাস্ত্রকে বলা হয় 'ব্রাহ্মণ‍্যবাদ'। ব্রাহ্মণ‍্যবাদের সঙ্গে বর্ণবাদ ত
বা জাতিভেদ প্রথার সামান্যতম সম্পর্কটুকুও নেই। কারণ সমস্ত ব্রহ্মজ্ঞানের ভিত্তি বৈদিক ধর্মশাস্ত্র তথা 'ব্রাহ্মণ‍্যবাদ'-এ - কোথাও কোন বর্ণভেদ বা নারীবিদ্বেষ নেই। অথচ অজ্ঞানতাবশত বিভেদকামীরা যুগের পর যুগ বর্ণবাদের বিকল্প শব্দ হিসেবে ব্রাহ্মণ‍্যবাদ শব্দটির অপব‍্যবহার করে,ঐ শব্দটিকে ঘৃণা-বাচক শব্দে পরিনত করে ফেলেছে। ব্রাহ্মণ‍্যবাদ শব্দটির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন, প্রকারন্তরে সনাতন ধর্মশাস্ত্রকে অবমাননা করার শামিল। এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে, ভিন্ন ধর্মীরা যুগে যুগে কোটি কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরিত করেছে।

(পরবর্তী পর্বে বর্ণভেদ কি ভাবে সৃষ্টি হল ?)

রচয়িতা
দেবাশীষ মুখার্জী

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted