কিভাবে দিন বা বারের নাম এল।

প্রাচীন জ্যোতির্বিদগণ তাঁদের সময়ে মাত্র সাতটি মহাজাগতিক জ্যোতিষ্কের সন্ধান পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সাতটি মহাজাগতিক বস্তু হলো- সূর্য চন্দ্র মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র ও শনি। এই সাতটি জ্যোতিষ্কের বাইরে অন্যকোনো মহাজাগতিক বস্তুর বিষয়ে আদিকালে জানা ছিলো না। তখন মনে করা হতো, সূর্য চাঁদ ও অন্যান্য সব বস্তু পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে। পৃথিবী থেকে মানুষ সবমিলিয়ে সাতটি মহাজাগতিক বস্তুর দেখা পেতে সক্ষম হয়েছিলো। এ থেকে সপ্তাহে সাতটি বারের উৎপত্তি। আর নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বৃহত্তম থেকে ক্ষুদ্রতম গ্রহের নামানুসারে বারের নাম রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। বলা বাহুল্য, পৃথিবী থেকে সূর্যকেই সবচে বড় মহাজাগতিক বস্তু হিসেবে মনে হতো (এখনো খালি চোখে এটাই বৃহত্তম)। এজন্য প্রথমেই রাখা হলো সূর্যের নাম।
.
সূর্যের বাংলা প্রতিশব্দ রবি, ইংরেজীতে সান (Sun), সান থেকে সানডে। সূর্যের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম বস্তু ছিল চাঁদ। চাঁদ বা চন্দ্রের বাংলা একটি প্রতিশব্দ সোম, ইংরেজীতে মুন (Moon), যা পরে সংক্ষেপিত হয়ে Mon বা মান উচ্চারণ ধারন করে। এভাবে রবিবারের পরে আসলো সোমবার। সূর্য ও চাঁদের পর পৃথিবীতে বসে দৃশ্যমান তৃতীয় বৃহত্তম মহাজাগতিক জ্যোতিষ্ক ছিল মঙ্গল গ্রহ। পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়ায় মঙ্গল গ্রহকে অন্যান্য দূরবর্তী গ্রহের তুলনায় বড়ই মনে হয়। তাই রবি ও সোম এর পর তৃতীয় বারের নাম রাখা হলো মঙ্গল। এভাবে (খালি চোখে) চতুর্থ পঞ্চম ও ষষ্ট বৃহত্তম জ্যোতিষ্ক ছিল যথাক্রমে বুধ বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। সর্বশেষ সবচেয়ে ছোট জ্যোতিষ্ক ছিল শনিগ্রহ। (শনিগ্রহ অনেক দূরে ছিল বিধায় একে ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, শনিগ্রহ মঙ্গল ও বুধ এর চেয়েও অনেক বড়)।
.
এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল সাতটি বারের নাম। এখানে রবি (বা সূর্য) কে সবচেয়ে বৃহত্তম আকারে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। আর শনিগ্রহকে উল্লেখ করা হলো সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম গ্রহ হিসেবে। (কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি, সবচে ছোট গ্রহ বুধ। বড় গ্রহ বৃহস্পতি)। তখনকার হিসেবে মোটামুটি এই সাতটি মহাজাগতিক জ্যোতিষ্কই মানুষের জানার আওতায় ছিল। তাই সেগুলোর নাম আসাটাই প্রাসঙ্গিক। জ্যোতির্বিদরা যদি তখন ইউরেনাস বা নেপচুনকেও খুজে পেত, তবে হয়ত সেগুলোও বারের নাম হিসেবে গৃহীত হতো। সব মিলিয়ে যদি আটটি নয়টি বা দশটি মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধানও পাওয়া যেতো তাহলে হয়ত সপ্তাহে বারের সংখ্যা আট নয় বা দশই হতো। অর্থাৎ আমরা অন্তত এটা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি যে, এই প্রচলিত সাতটি বারের ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনা সম্পুর্নই মানুষের কাজ। তখনকার মানুষ এই সাতটি মাত্র মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কেই জানতো। এর বাইরেও যে আরো অনেক গ্রহ আছে তা তখনো জানা ছিল না। সে কারনেই এই বার ব্যবস্থা এবং এর নাম নির্বাচনে ভুলত্রুটি থাকা খুব স্বাভাবিকই ছিল। এই নির্দিষ্ট করে সাতটি বার হওয়া এবং এর নামকরণের সাথে ঐশ্বরিক (স্পিরিচুয়াল) কোনো কিছুর সম্পর্ক নাই।
.
কিন্তু, আমরা দেখি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এই বারগুলিকে নিয়ে নানা মিথ ও বারভিত্তিক আলাদা তাৎপর্য তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। আলাদা আলাদা বারের আলাদা আলাদা গুণাগুণ পর্যন্তও বর্ণনা করা হয়েছে খুবই যত্নের সহিত। আমরা জানি, প্রাচীন গ্রীক ও মিসরীয়দের কাছ থেকে সেমিটিক জাতিগুলোর মাঝেও এই মানবীয় ভুলত্রুটি সম্পন্ন সাতবার ও সেই সাত বারকে ভিত্তি করে বারো মাসের ধারণা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে সেমেটিকদের মধ্য হতে হতে ইহুদী, ইহুদী থেকে খ্রীষ্টান ও খ্রীষ্টান থেকে সর্বশেষ মুসলমানদের মধ্যে এই একই ধারার সাত বারের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা স্পষ্টতই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কেননা, এত বড় সীমাবদ্ধ ধারণা নিয়েও মানুষ তার গণনার সুবিধার্তে যুগের যুগের যুগ তা মেনে নিয়েছে। প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের এমন ভুলত্রুটি সম্পন্ন সাত বার ও বারো মাসের ধারণাটিকেও ‘ঐশ্বরিক সিদ্ধান্ত ’ হিসেবে দেখানো হয়। অবশ্য, এতে করে ‘ঐশ্বরিক’ বিশ্বাসটিরই ভুল প্রমান হওয়ার সযোগ সৃষ্টি হয়।
.
দেখা যায়, আর্যদের (আধুনিক হিন্দুধর্মে) ঈশ্বর বিশেষ বিশেষ বারে স্বর্গের দরজা খুলেন এমন কিছু না থাকলেও। ইহুদীদের পবিত্রদিন শনিবার, খ্রিষ্টানদের রোববার আর মুসলমানদের শুক্রবার। এভাবে পৃথিবীজুড়ে নানান ধর্মে বারকেন্দ্রিক আলাদা মাহাত্ম ও ফজিলত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বাংলায় বারে শব্দগুলি কোন না কোন হিন্দু দেবতার নাম অনুসারে রাখা। সচেতন ও চিন্তাশীল লোক মাত্রই বিব্রত হতে বাধ্য।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted