গোটা সাবমেরিন জুড়ে খালি ডিজেলের গন্ধ। হ্যামের মধ্যে,পাউরুটির মধ্যে। গন্ধে বমি পায়। তার ওপরে ওই দুলুনি। সি সিকনেস। খেতে ইচ্ছে করে না নেতাজির। চাল আর মুসুরির ডাল দিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে দিল তার সেক্রেটারি সাফরানী।
হায়দ্রাবাদের এই ছোকরা ততদিনে নেতাজির সবচেয়ে কাছের লোক। নামবিয়ার, সেনগুপ্ত বাঘা বাঘা সিনিয়রদের বাদ দিয়ে তাকেই বেছে নিয়েছেন নেতাজি। ছোকরার মাথা খুব সাফ। কিছুদিন আগেই নেতাজিকে একটা অসুবিধে থেকে মুক্তি দিয়েছে। নেতাজি তখন জার্মানিতে আটক ভারতীয় সেনাদের নিয়ে একটা ইন্ডিয়ান লিজিওন নামে সৈন্যবাহিনী গড়ার কাজে ব্যস্ত। ব্যারাকে, রাস্তাঘাটে, অফিসে যেখানে দেখা হয়, ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল আর্মির ঐতিহ্য মেনে তারা তাদের সর্বাধিনায়ক কে গ্রিটিংস জানায় তাদের মতো করে। কেউ বলে, রাম-রাম, কেউ বলে সৎ শ্রী অকাল, কেউ আবার সেলাম আলাইকুম।
নেতাজির ঠিক পছন্দ হয় না। বৈচিত্র্য এর মধ্যে ঐক্য এর সেই সুর কানে বাজে না। কেমন বেসুরো লাগে। এ ও মাথা খাটিয়ে ওই অভিবাদনের যা ভাষা বের করলো তার মধ্যে ওই ছোকরা সাফরানীর টাই মনে ধরে গেল। চেম্পকরমন পিল্লাইয়ের বহুদিন আগে তুলে ধরা ছোট্ট একটা বাক্যবন্ধ: জয় হিন্দ। ছোট অথচ তেজ আছে। ওটাই টিঁকে গেল। ছোকরার নাম অবশ্য তখন সাফরানী ছিল না, অন্য কিছু ছিল। ওই নামটা নিজের নামের শেষে যুক্ত করেছিল পরে যখন সে আর নিছক সেক্রেটারি নয়, আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর। তেরঙ্গার, ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গেরুয়া রং টা বড্ড মনে ধরে ছিল।
খিচুড়ি খেয়ে প্রাণে বাঁচলেও নতুন সংকট। ওই জার্মান সাবমেরিনএ গোটাটা যাওয়া যাবে না। জাপানি ইউ বোটে উঠতে হবে। ২৭শে এপ্রিল, ১৯৪৩ সাল। মোজাম্বিক চ্যানেল এ ভোর। প্রচুর আলো কিন্তু বিপত্তি অন্য। সমুদ্রের ঢেউ বিশাল আকার নিয়েছে। অগত্যা জাপানি সাবমেরিন আর জার্মান, একে অন্য কে চক্কর কাটা শুরু হল। বিকেলে হঠাৎ দুই জার্মান সাবমেরিনার ঝাঁপিয়ে পরে। সাঁতার কেটে এসে ওঠে জাপানি সাবমেরিনে। তাদের কাছে জানা যায় যে জ্বালানি প্রায় শেষ হয়ে আসছে ৭৭ দিন যাত্রার পরে। অনন্তকাল অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। পরের দিন সকালে ওই দুজন মিলে জার্মান সাবমেরিন অবধি টেনে নিয়ে যায় মোটা ম্যানিলা রোপ। সেই ম্যানিলা রোপের সাহায্যে রবার এর ডিঙি নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়া হল।
ভারত নামের এই দেশটাকে ভালোবেসে প্রশান্ত মহাসাগরের সেই বিক্ষুব্ধ উত্তাল তরঙ্গে মোচার খোলার মতো একটা ডিঙি নৌকাতে জীবন মৃত্যু তুচ্ছ করে তার সর্বাধিনায়ককে অনুগমন করা সেই সৈনিক, বিদেশি লুঠেরাদের ধর্মের নামে হাজার হাজার বছরের দেশ ভেঙে দু কোটি 'অবিশ্বাসী'কে জবাই করে তৈরি হওয়া বর্বর অন্ধকার ভূখণ্ডটিতে যেতে রাজি হননি। দেশের শত্রু ডাঙ্গে রণদিভেদের মত কমিকুত্তারা যখন ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় বলে সদ্যস্বাধীন ভারতের তেরঙা পতাকাটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছে তখন সেই সাফরানি বেছে নিয়েছেন ভারত রাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস অফিসারের পরিচয়। ১৯৬২ সালে দেশের শত্রু কমিউনিস্টরা যখন উত্তর পূর্ব ভারতকে বিক্রি করে দিতে চাইছে চিনের কাছে, সেই সৈনিক তখন কোনো দূর বিদেশে ভারত সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চেষ্টা করছেন হিংস্র কমিউনিস্ট মাও সে তুংয়ের জল্লাদদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বজনমত তৈরি করতে। ১৯৬৯ সালে সে যখন তথাকথিত শ্রেণিশত্রু-বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ভারত সরকারের কাজ থেকে তিনি অবসর নিলেন, তখন দেশের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে চিনের কুকুর, কমিউনিস্ট সাইকোপ্যাথ চারু মজুমদারের নির্দেশে তাঁরই মত সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, আইনজীবীদের এলোপাথাড়ি খুন করা হচ্ছে দেশটাকে ভিতর থেকে ভেঙে ফেলতে। নরপশু কমিউনিস্ট বিশ্বাসঘাতকরা যখন এ দেশের ভিতরে মাথা তুলে ঘুরে বেড়ায়, তখন সেই সৈনিকটি যেন কোনোদিন কমিউনিস্টদের ভাষায় 'তোজোর কুকুর'-এর পাশে থাকার অপরাধে তার দেশের মানুষের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত না হয়। দেশটা যেন আরব সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রিত মৃত্যু উপত্যকা না হয়। নইলে আর কোনো জৈন আল অবদিন হাসানকে কোনোদিন পাবে না এই ভারত, যিনি পবিত্র ভারতীয় সংস্কৃতির দিকচিহ্ন নিজ নামে ধারণ করে নিজের নাম নিজেই দিয়েছিলেন সাফরানি।
সাফরানিদের আদর্শ মেনে আজকের ভারত বৈরাগ্যের গৈরিক পতাকার পবিত্র আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হোক। দেশের শত্রুদের লাল পতাককে ধ্বংস করে উড্ডীন হোক সাফরানিদের গেরুয়া। বন্দে মাতরম। জয় হিন্দ।
ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন--
দরিদ্রের বল।
"একধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে' এ মহাবচন
করিব সম্বল।
লিখনে - ডোবা সেনগুপ্ত
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................