ক্ষ্যাপা ও তার পরশমণি
যূথিকা আচার্য্য
“আরে তুম বাঙ্গালীলোগ কিয়া খাকে পয়দা হোতে হো! ইতনা দিমাগ কাহাসে আতি হ্যায়?”
অথবা,
“ ইজ দিস ট্রু দ্যাট এভরি বেঙ্গলী হ্যাজ অ্যা ইউনিভারসিটি ডিগ্রী?”
প্রবাসী বাঙালীমাত্রেই এই প্রশ্নগুলো হাজারবার শুনেছেন নিশ্চয়। আমরা বাঙালী। আমাদের কাছে গুজরাতি-মাড়োয়ারিদের মতো টাকার জোর নেই। ‘চান্দি কী জুতি মার কে’ দুনিয়াটাকে নিজের পকেটে পুরে নেব সেই ক্ষমতা আমাদের নেই। পাঞ্জাবী-কাশ্মিরীদের মতো রুপের দেমাক বা জৌলুষ নেই। গোয়ান বা মারাঠিদের মতো স্ট্রীট-স্মার্ট নই। ইউ-পি, বিহারের লোকজনের মতো খেটে খাওয়ারও ক্ষমতা নেই। তাহলে আছেটা (পড়ুন ছিল) কী? কীসের জোরে আমাদের এত নাচনকোঁদন?
আমরা বাঙালী। আমাদের আছে শিক্ষা। আমাদের আছে সংস্কৃতি। আমাদের আছে শিল্প। আমাদের আছে সাহিত্য।
কদিন আগের কথা। বন্ধুদের মধ্যে ভাষার জটিলতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ফ্রেঞ্চ বন্ধুটি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে এই প্রসঙ্গ উঠলেই। তার ধারণা, ফরাসী ভাষার থেকে সুললিত এবং মার্জিত ভাষা নাকি হওয়া সম্ভবই নয়। লেবানীজ মেয়েটিকে পারলে সে খ্যাঁক করে কামড়ে দেয়। অথচ আমার দিকে ফিরে বললো,
“তোমাদের ব্যাপার আলাদা। ইউ গাইজ্ হ্যাভ স্যাট্জিট রে। ইউ গাইজ্ হ্যাভ টেগোর। আর্ট, লিটারেচর, এডুকেশন নিয়ে গর্ব করা তোমাদের সাজে।“
জার্মান অ্যাপ্রেন্টিসটি মাথা নাড়িয়ে সেকথা সমর্থন করলো,
“ ট্রু, দে আর বেঙ্গলীজ্। ওরা বাকী ইন্ডিয়ানদের থেকে অনেক আলাদা। আমার গ্রান্ডফাদার ওদের ক্যাপিটাল সিটিতে বছর দুয়েক ছিলেন। তাঁর মুখে শুনেছি যে পড়াশোনা ছাড়াও মানুষপিছু আর্টে দু-তিনটি ডিগ্রী ওদের কাছে জলভাত।“
এত গেল দেশের বাইরে। এবার দেশে থাকাকালীন একটা অভিজ্ঞতা বলি। মুম্বাই ওবেরয়ে কাজ করছি তখন। এক সহকর্মীর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেছি। সহকর্মী ও তার দাদার মধ্যে খুনসুটি চলছে। দাদাটি বোনের পনিটেল ধরে টেনেছে। সেই নিয়ে ঝগড়া। বোনটি চেঁচাচ্ছে,
“ ওই চুল টানলি কেন রে, আমার মাথায় লাগে না নাকি!”
দাদা উত্তর দিল,
“ লাগলেই বা কী? লড়কিয়োঁ কী দিমাগ তো ঘুঁটনো পে রহতা হ্যায়।“
সেকথা বলেই দাদাটি ধাঁ করে আমার দিকে ঘুরে বললো,
“ ব্যায়সে আপ বুড়া মাত মানিয়ে বহেন। আপ তো বঙ্গালী হো। আপ কী বাত অলগ হ্যায়!”
এর চাইতেও বেশী ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। শিক্ষা-সংস্কৃতি না থাকলে আমাদের কাছে কিন্তু কিছুই থাকবে না। ওইটুকুই তো রসদ আমাদের। তাই নিজের মায়ের কপালে লাথি মারার আগে দুবার ভাবুন। বঙ্গভূমির বীজমন্ত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নোংরামো করার আগে দুবার ভাবুন। ইংরিজি অ্যাকসেন্টে ন্যাকামো করে বাংলা বলার আগে দুবার ভাবুন। বানান শেখা মুশকিল তাই ভুল বানানই ঠিক, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুবার ভাবুন। সংস্কৃতির এই উত্তরাধিকারকে সম্মান করতে না জানেন, অন্তত অপমান করবেন না। পরশমণি হাতে পেয়েও হারানোর ভুল করলে ভবিষ্যৎ কিন্তু ক্ষমা করবে না।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................