সিরাজউদ্দৌলা,ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়ক, না খলনায়ক?

#সিরাজউদ্দৌলা,ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়ক, না খলনায়ক?

"স্বদেশী আন্দোলনের সময় হিন্দু নেতারা মুসলমানদের মধ্যে থেকে নায়ক খোঁজার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তাঁরা তরুণ সিরাজের মতন একজন দুর্বল, অপরিণামদর্শী, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর যুবককে প্রতীক নায়ক হিসেবে বেছে নেন, তাঁদের ইচ্ছে অনুসারেই নাট্যকারের সিরাজকে গড়ে তোলেন এক রোমান্টিক, আদর্শবাদী, হিন্দু মুসলমানের সমন্বয়সাধক হিসেবে.. " অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 

স্কুল ইতিহাসে সিরাজ একজন "স্বাধীনতা সংগ্রামী", "আমি সিরাজের বেগম" উপন্যাস বা "সিরাজউদ্দৌলা" নাটকের সিরাজ একজন ট্র্যাজিক হিরো, কিন্তু বাস্তবে সিরাজকে কি নায়ক বলা যায়? 
সমকালীন কোন তথ্যে, ফার্সি, বাংলা,ফরাসী,ওলন্দাজ, বা ইংরেজি, সিরাজ সম্পর্কে একটিও প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত হয় না কেন? 

ব্রিটিশদের সঙ্গে সিরাজের শত্রুতা থাকতে পারে, কিন্তু ফরাসীরা? ওরা তো সিরাজের বন্ধু ছিল। 

জ্যঁ ল দ্য লরিস্তঁ, যিনি ১৭৬৫ সালে পন্ডিচেরীর গভর্নর নির্বাচিত হন, ১৭৫৬-৫৭ সালে ছিলেন চন্দননগরে। তিনি লিখেছেন "কোন ব্যক্তির কুখ্যাতি সিরাজের থেকে বেশী হতে পারে এটা অকল্পনীয়। এই যুবক  ইন্দ্রিয়পরায়ণতা আর নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত। এর চ্যালারা  স্নানরত অবস্থায় সুন্দরী হিন্দু রমণীদের তুলে নিয়ে যায় মালিকের মনোরঞ্জনের জন্য। এই যুবকের আর একটি কৌতুক বজরার আঘাতে নৌকাডুবি ঘটানো। অনেকবার মাঝনদীতে সিরাজের বজরার আঘাতে যাত্রীবাহী নৌকা জলে ডুবে বহু যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। 
নবাব আলীবর্দীর কাছে কোন মন্ত্রী কিংবা উচ্চবংশীয় ব্যক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করার জন্য সিরাজ এগিয়ে আসত। এমন নৃশংসভাবে হতভাগ্যদের হত্যা করা হত যে স্বয়ং নবাব শহরের বাইরের কোন প্রাসাদে আশ্রয় নিতেন যাতে তাদের আর্তনাদ না শুনতে হয়। সিরাজের নাম শোনামাত্র জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হত। এই নির্বোধ যুবকের সরকার চালানোর মত কোন সামর্থ্য নেই, এ শুধু জানে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে, কিন্তু আসলে এ একজন ভীতু। 
এই যুবকের প্রকৃতি রুক্ষ,  এ কাপুরুষ এবং গোঁয়াড় । এ সামান্য ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বদমেজাজী। এ কাউকে বিশ্বাস করে না, এবং কারও বিশ্বাসের দাম দেয় না। শৈশব থেকে রাজকীয় পরিবেশে বড় হলেও এর ব্যবহারের মধ্যে শিক্ষা বা সৌজন্যবোধের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়  না। "

আরও বিশদভাবে লিখেছেন সিরাজের আত্মীয়, গোলাম হোসেন খান। " যুবরাজ যাকে পছন্দ হত যৌনতৃপ্তির জন্য তাকেই বেছে নিতেন, এমনকি পুরুষ মহিলা ভেদাভেদ করতেন না। নবাব আলিবর্দী খানের সেনাপতিদের নিয়মিত অপমানিত হতে হত সিরাজের কাছে। তাঁরা মুখ খুলতে ভয় পেতেন কেননা অশ্লীল গালাগালি শোনার সম্ভাবনা থাকত। যুবরাজ আলীবর্দীর অমাত্যবর্গের উপদেশ গ্রহণ করতেন না, এবং অমাত্যগণ উপদেশদানে বিরত থাকতেন, আসলে তাঁরা সিরাজের পতনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। 
পৃথিবী সম্পর্কে সিরাজ ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নিজের কৃতকর্মের কি পরিণাম হতে পারে কখনও চিন্তা করতেন না। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে পাপ পূণ্য, ভালো মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতেন না। এমনকি কোনও সেনা অভিযানের সময় সবচেয়ে সাহসী এবং দক্ষ সেনাপতিদের কটুবাক্যের ছুরিতে বিদ্ধ করতেও বাধত না সিরাজের। রাজ্যের সবাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত সিরাজের থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। "

তবে সিরাজের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল তৎকালীন বাংলার ব্যাঙ্কার জগৎশেঠের সঙ্গে শত্রুতা করে। মনে রাখতে হবে এই জগৎ শেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ই( মহাতাব রাই আর স্বরূপচাঁদ)কিন্তু আলীবর্দীকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। রাজত্বকালের প্রথম দিকে পুর্ণিয়া আক্রমণের সময় সিরাজ জগৎশেঠেদের থেকে তিন কোটি টাকা চেয়ে বসেন। যখন মহাতাব রাই অর্থপ্রদানে অস্বীকার করেন, সিরাজ তাকে প্রকাশ্যে অপমান করেন। গোলাম হোসেন খান লিখেছেন " জগৎ শেঠের মত বিশিষ্ট নাগরিককে সিরাজ সবার সামনে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং বিদ্রুপ করতে শুরু করেন, এমনকি প্রায়ই খৎনা করে দেওয়ার হুমকি দিতেন"। 

পলাশীর যুদ্ধের সময় আলীবর্দী খানের বিশ্বস্ত অমাত্য, সেনাপতিগণ এবং জগৎ শেঠ ভ্রাতৃদ্বয় কেন সিরাজের বিপক্ষে চলে গিয়েছিলেন গোলাম হোসেনের বিবরণ সেটা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। সিরাজউদ্দৌলা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন বাংলায় নবাবী শাসন ধ্বংস করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল প্রতিষ্ঠিত করার অনুঘটক। 

তথ্যসূত্র: দ্য অ্যানার্কি। উইলিয়াম ডালরিম্পল।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted