এ কারণেই বাংলার বাউলরা নাস্তিক হিসেবে সাধারণ ধার্মীকদের কাছে স্বীকৃত।

“তন্ত্র-মন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই/শাস্ত্র গ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই/কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে/মুর্শিদ ধনহে কেমনে চিনিব তোমারে” (বাউল শাহ আবদুল করিম)

এ কারণেই বাংলার বাউলরা নাস্তিক হিসেবে সাধারণ ধার্মীকদের কাছে স্বীকৃত। এর পিছনে কলকাঠি নাড়ে মোল্লাতন্ত্র। মোল্লাদের ক্ষ্যাপার প্রধান কারণ মোল্লা সমাজ তাদের জীবিকার উপর বাউলদের হুমকি মনে করে। যে মুর্শিদকে (আল্লাহ) বাউলরা খুঁজে হয়রান, ধর্মগ্রন্থে যাকে তারা খুঁজে পান না তাকেই মোল্লাতন্ত্র ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে মসজিদে ডাকেন। মানুষ ভাববাদী মুর্শিদের ভক্ত হলে মসজিদে ভক্তি কমে যাবে। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের গান আছে, "যদি মক্কায় গেলে খোদা মিলতো নবী মিলতো মদিনায়, দেশে ফিরে কেউ আইতো না হজ্ব করিতে যারা যায়। কেউ যায় টাকার বিমানে, কেউ যায় দেশ ভ্রমণে, ধনী যায় ধনের টানে আনিতে সোনাদানা"… ইত্যাদি। এগুলো প্রচলিত ধর্মের আচারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্রোহ। প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। প্রচলিত ধার্মীকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। প্রচলিত মুসলমানিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ…।

এখন এটাকে সবাই মোল্লাতন্ত্রের পেশাগত যুদ্ধ বলতে চাইবেন। ধর্ম ও সাধারণ ধার্মীকদের ভূমিকা এখানে গৌণ করতে চাইবেন। আমি জানি না, এভাবে ধর্ম ও ধার্মীকদের দোষমুক্ত করে কি লাভটা হবে? ধর্মের তেমন দোষ নেই বা ধার্মীকরা আসলে সমাজে কোন সমস্যা নয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা আসলে সমাজে জড়বুদ্ধিবাদকেই জিইয়ে রাখতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু সিনেমায় ডাক্তার যখন মন্দিরের পবিত্র জল নর্দামার জলের পাইপে মিশে দুষিত হয়েছে বল ল্যাব টেস্ট প্রকাশ করতে চান তখন মন্দির ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা লাটে উঠার আশংকা করেন। ডাক্তার ফাইট করেন মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু সাধারণ গ্রামবাসী দেবতায় অবিশ্বাসী নাস্তিক ডাক্তারের বাড়িতে হামলা চালায় কেন? ধর্ম নিজেই একটা ব্যবসা। ধর্ম নিজেই একটা রাজনীতি। আলাদা করে রাজনীতি আর ব্যবসা দিয়ে এই ভয়ংকর মানসিক অসুখকে আড়াল করে বেশিদূর পর্যন্ত কি সুফল পাওয়া যাবে?

করোনো ভাইরাস যখন অমুসলিমদের উপর প্রথম প্রকোপ শুরু হয়েছিলো তখন মুসলমানরা বেজায় খুশি হয়েছিলো। এই খুশি হওয়ার পিছনে সাধারণ ধার্মীকদের কোন রাজনীতি দেখতে পাই না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক বিধর্মী বিদ্বেষ ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। স্টেফিন হকিং মারা যাবার পরও মুসলমানরা বেজায় খুশি হয়েছিলো। এই মহান বিজ্ঞানী আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালাননি বরং যুদ্ধ বিরোধী ছিলেন। তিনি মহাকাশ নিয়ে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে মুসলমানদের উল্লাস তাদের স্বাভাবিক ধর্মীয় অবস্থান। যখন একজন হিন্দু লাশ মুসলিম প্রধান দেশের রাস্তা দিয়ে যায় তখন সাধারণ পথচারী মুসলিম রিকশাওয়ালা, রিকশা সওয়ারির দাঁত কেলিয়ে বিদ্রুপের চোখে তাকিয়ে থাকার মাঝে কোন রাজনীতি নেই। 

এ ধরণের স্বাভাবিক ধর্মীয় বিদ্বেষের মধ্যে অর্থনীতিই বরং নিয়ে আসে খানিকটা সহিষ্ণুতা। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার টাকায় হাতি মাথাওয়ালা গণেশের ছবি ছিলো যা পকেটে নিয়েও মুসলমানরা নামাজ পড়ত। আবার মনে যত রকম সাম্প্রদায়িক ছুয়োছুয়ি পুষে রাখুক কোন হিন্দু, মসজিদের ছাপওয়ালা টাকার নোট পকেটে নিয়েই মন্দিরে যায়। এটাকে ধর্মের উপর টাকার জয় দেখতে কেউ কেউ খুশি হবেন কিন্তু আদৌ এটা সেরকম কিছু নয়। টাকায় মসিজদ বা মন্দির ছাপানো সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের প্রভাব প্রকাশ করতেই করা হয়। বাংলাদেশের টাকায় মন্দিরের ছবি সাধারণ মুসলমান ভালো চোখে নিবে না বলেই রাজনীতিবিদরা মন্দিরকে টাকায় স্থান দেয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন না। কাজেই দেখা যায় সাধারণ ধার্মিকতার কাছে মাঝে মাঝে রাজনীতিই অসহায় হয়ে উঠে।

একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন রাখি, ইন্ডিয়া ১০০ কোটি অমুসলিম আর ২০ কোটি মুসলমান না হয়ে যদি ১০০ কোটি মুসলিম আর ২০ কোটি অমুসলিম হত তাহলে কি ইন্ডিয়া ইসলামিক রাষ্ট্র হত না? আমরা জানি ইন্ডিয়া তখন পাকিস্তানের মত একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হত। এটা কেন হয়? সাধারণ মুসলিমদের ইচ্ছা অনুসারে? নাকি এখানেও খালি রাজনীতিবিদদের দোষ দিব?

আপনি কখ‌নো মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের পক্ষে "ডিম বালক" পাবেন না। আমরা হয়ত এরিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ডিম বালককে ভুলে গেছি যে নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর একজন অস্ট্রেলিয়ার এমপির মুসলিম অভিবাসী বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখার সময় ডিম ছুড়ে মেরেছিল। রাতারাতি সেই বালক হিরো হয়েছে উঠে। এই হিরো হয়ে উঠেছিলো আসলে অমুসলিম লিবারালদের কাছেই। তাদের মিডিয়াই এটাকে তুলে ধরে। আমরা কখনোই মুসলিমদের মধ্যে কোন ‘ডিম বালকদের’ দেখি না যারা নিজ দেশের অমুসলিম নিপীড়নকারীদের ডিম ছুড়ে মারবে। কারণ মুসলিমদের এমন কোনো শিক্ষা দেয়া হয় না। সেটা আরব পাকিস্তানী বাংলাদেশী আফ্রিকান যে মুসলিমই হোক। মুসলিম পারিবারিক শিক্ষাই হলো মুসলিম উম্মাহ আক্রান্ত হলে প্রতিবাদ করতে হবে। মুসলিম উম্মাহ অন্যায় করলে গোপন করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া সমাজে একজন রাজনীতিবিদ বর্ণবাদী বক্তব্য রেখে একটি বালকের ডিমের আঘাতে অপমানিত হোন এবং জনতার মাঝে সেই বালক হিরো হয়ে উঠে। এখানে রাজনীতি এখন ডিম বালকের পক্ষেই কথা বলবে। রাজনীতি ডিম বালকের বিপক্ষে যেতে পারবে না। অস্ট্রেলিয়ার সমাজের খ্রিস্টানরা মুসলিমদের মত ধর্মমতী নয়। সেখানে গির্জা থেকে কোন বিধর্মীর বাড়ি প্রতিষ্ঠান ধর্মালয়ে হামলার ঘোষণা কেউ দিবে না। দিলেও তাকে পাগল হিসেবে উপহাস করা হবে। নতুবা সন্ত্রাসী হিসেবে পুলিশে দেয়া হবে। কিন্তু ৫৭টি মুসলিম দেশে এরকম ঘোষণা মুহূর্তের মধ্যে উন্মত্ত জনতা ধূলিসাৎ করে দিতে পারে অমুসলিমদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মন্দির প্যাগোডা…। অবশ্যই এরকম সাম্প্রদায়িক হামলার পিছনে রাজনীতি কলকাঠি নাড়ে। কিন্তু সেই রাজনীতিটা সফল হয় জনগণের ধর্মের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে। ভারতে বাবরী মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো এর পিছনে রাজনীতির হাত ছিলো। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের স্বাভাবিক মুসলিম বিরোধীতাই তো সেই রাজনীতির আসল শক্তি ছিলো। নাসিরনগর, রামুতে হামলার পিছনে্ও রাজনীতি ছিলো কিন্তু সেই রাজনীতি জানে এখানে ইসলামের নামে পাবলিককে দিয়ে খুন করানো পর্যন্ত সম্ভব। ডেনিশ কার্টুনিস্ট থেকে ফ্রান্সের ফান ম্যাগাজিন অফিসে মুসলমানদের হত্যাকান্ডে রাজনীতি অর্থনীতিটা কোথায় কেউ দেখাতে পারবে? ১৯৩৬ সালে কোলকাতার সেন পাবলিকেশনের ভোলানাথ সেনকে তার অফিসে খুন করে যায় যে ধার্মীক মুসলমান যুবক সেটা কি রাজনীতি ছিলো? ছোটদের জন্য সেরা মুণিষির বইয়ে মুহাম্মদের কল্পিত একটি ছবি ছেপে ভোলানাথ খুন হলে খুনিদের পক্ষে আইনী লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছিলো তখনকার মুসলিম রাজনীতিবিদরা, এটাই ছিলো রাজনীতি। সাধারণ মুসলিমদের সেন্টিমেন্টকে পকেটে পুরতে খুনির পক্ষে আইনী লড়াই প্রয়োজন ছিলো। রঙ্গীলা রসূল বইয়ের প্রকাশককে খুন করেছিলো যারা তাদেরও আইনী সুরক্ষা দিয়েছিলো জিন্না স্বয়ং। সেটাই ছিলো রাজনীতি। কিন্তু প্রকাশক খুন করাটা ছিলো একজন মুসলিম ধার্মীকের, নবীপ্রেমির সাধারণ প্রতিক্রিয়া। এখানে কোন রাজনীতি ছিলো না।

পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম খারাপ। পৃথিবীর সমস্ত ধার্মীক খারাপ। ‘উদার ধার্মিক’ ‘মন্দ ধার্মিক’ বলতে কিছু হয় না। একই ধর্ম দুধরনের ধার্মিক বানায় না। উনি ধার্মিক কিন্তু গোঁড়া নন। কিংবা ধার্মিক কিন্তু মৌলবাদী নন মানে হচ্ছে তিনি ভালো ধার্মিক নন। ধর্মের মূল ধরে হুবহু অনুসরণ করাই ধার্মিকের দায়িত্ব। এজন্য ধার্মিক আলাদা করে মৌলবাদী হন না, মৌলবাদীতাই ধার্মিকতা।

একজন বিবেকবান ভালো মানুষ ধার্মিক হলে তার জিনের নকশা অনুযায়ী আচরণ করেন। একজন পীর বা ধর্মগুরু মানেই প্রতারক নন। পৃথিবীতে লক্ষ রক্ষ ফাদার, পুরোহিত, যাজক, মাওলানা আছে তারা সকলেই মনের গভীর থেকে তাদের ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন। এই ধর্মবেত্তাদের মধ্যে ভালো বিবেকবান ও যুক্তিবান মানুষ থাকা বিচিত্র নয়। তাদের ভালোমানুষিতাই তাদের ধর্মীয় জীবিকার উপর প্রভাব ফেলে। তাই এদের কারোর কথাবার্তা সমাজে চমকিত হয় যখন তারা সব ধর্ম সম্প্রদায় মানুষের মিলন চান কিংবা সবাইকে একই ঈশ্বরের আর্শিবাদ প্রাপ্ত বলে মন্তব্য করেন।

এটা কিছুতে ধর্মের বিজ্ঞাপন হতে পারে না। উল্টো একজন মানবিক মানুষ ধর্মের কাছে অসহায়ত্ব হয়ে পড়েন। প্রমথনাথ বিশীর কোলকাতার কাছেই উপন্যাসে একটা মুসলমান চরিত্র আছে যিনি পরোপকারী। প্রতিবেশী হিন্দু তরুণীদের ডাকাতের হাত থেকে বাঁচান। সেই থেকে মুসলমান লোকটি মেয়েদের দাদা হয়ে উঠেন। হিন্দু পরিবারটির মা ও কন্যারাও ছিলেন ভালো মানুষ। তাদের মুসলমান দাদাকে তারা সত্যিকারের দাদা মনে করেই ভালোবাসত। কিন্তু মুসলমান দাদাটির জন্য বাড়িতে আলাদা জলের গেলাস আলাদা চায়ের কাপ ব্যবহার করা হত যা বাইরে থেকে না ধুয়ে ঘরে নেয়া হত না। সেকালের হিন্দুদের ধর্মীয় শিক্ষাই ছিলো এটা। সবাই এটাকে ধর্মীয় নির্দেশনার পাশাপাশি সহজাত বিধর্মী ঘৃণার কারণে অনুসরণ করলেও তথাকথিত ভালো ধার্মিকরা এটা মানতে বাধ্য ছিলো ধর্মীয় সংস্কার আর ধার্মিকের মনের দুর্বলতার কারণে। আমাদের আলোচ্য উপন্যাসের কন্যা চরিত্রটি যখন তার মাকে তার মুসলমান দাদাটির আলাদা গেলাসের প্রসঙ্গ তোলে তখন মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সংস্কারের কথা বলেন ব্যথিত গলায়। একই ভাবে বাস্তবে একজন ধার্মিক অথচ মানবিক ভালো মানুষ যখন জানেন জাকাত কখনোই কোন অমুসলিমকে দেয়া যায় না তখন তিনি চোখের সামনে থাকা বিপদগ্রস্ত অমুসলিমকে জাকাত দিতে পারেন না। এভাবেই একজন মানবিক মানুষকে ধর্ম বরং গলা টিপে ধরে।

ব্যক্তি এক্স জেড ধর্মের উদাহরন হতে পারে না। ধর্ম আমাদের জন্য ক্ষতিকর কিনা সেটা কোন একজন ধার্মিককে দেখিয়ে ধর্মকে নির্বিষ প্রমাণ তাই ভুল। আমার বাবা কিংবা আমার চাচা এশার নামাজ পড়ে এসে হরিকাকার বাড়ির দুর্গাপূজা দেখতে যেতেন তাই ধার্মিকরা মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে দেয়াটা আহাম্মকি। আমাদের ভাবতে হবে ধর্মই আমার বাবাকে মুসলমান করে রেখেছে আর হরি কাকাকে হিন্দু করে রেখেছে। তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আলাদা নিয়ম পালিত হবে। এবং এগুলো টিকিয়ে রাখতে তারা আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। আর তাদের এই প্রক্টিসের জন্যই নেক্সট জেনারেশনও একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজন বজায় রাখতে পেরেছে। আমরা জানি না ‘ভালো ধার্মীকের’ এর পরের প্রজন্ম "উদার" না "মন্দ" ধার্মিক হয়ে উঠবে। যদি আমাদের কল্পিত ইতিহাসকে সত্য ধরে নেই যে আমার বাবা ও হরি কাকা কঠিন ধার্মিক হয়েও দুজনে ছিলেন হরিহর আত্মা তাহলে প্রশ্ন উঠবে এত প্রেম থাকার পরও কি করে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ সম্ভব হয়েছিলো? রাজনীতিবিদদের কি ক্ষমতা ছিলো বিরুদ্ধ স্রোতের বাইরে যাওয়ার?

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted