জগদীশের ঘুমন্ত চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে। চোখের কোণে জলের মত কিছু চিকচিক করতে থাকে। দুপুরের বুড়িগঙ্গার বুকটা যেমন চিকচিক করত। জগদীশ বুড়িগঙ্গাই দেখে। পাল তোলা নৌকা। বুড়িগঙ্গার ওপারে গ্রাম। গ্রামের ওপারে বিস্তৃত আকাশ। জগদীশের বাড়ির ছাদ থেকে ঐ তো বুড়িগঙ্গা, এপারে চকবাজার, শাখারী পট্টি, লক্ষ্মিবাজার…। জগদীশ ছাদ থেকে দূর বুড়িগঙ্গার দিকে চেয়ে থাকে। বুড়িগঙ্গার বুকে প্রথম সকালের রবির কিরণ। দুই হাত জোর করে জগদীশ চোখ মুদে কাউকে প্রমাণ জানায়। হয়ত বুড়িগঙ্গাকেই…।কিন্তু নিজেকে কি করে দেখে জগদীশ? এ এক রহস্যই বটে! জগদীশ নিজেকে দেখে। দেখতে দেখতে তার শ্বাস ঘন হতে থাকে। দুই ভুরুর মাঝখানে ভাঁজ পড়ে। জানালার ফাঁক গলে সকালের রোদ এসে লাগে তার চোখে। ঘুম ভেঙ্গে যায় জগদীশের।
ঘুম ভেঙ্গে সবটাই অবাস্তব মনে হয় জগদীশের। তার দৃঢ় বিশ্বাস দুদিন বাদেই নেহেরু জিন্না রাগ অভিমান ভুলে সব এক হয়ে যাবে। জিন্না পাকিস্তান তুলে নিবে। আবার জগদীশ দেশে ফিরতে পারবে। কোলকাতাতে তো দুদিনের জন্য এসেছে। আগেও কতবার কোলকাতা আসত জগদীশ। দিন সাতেক পরই বাড়ির জন্য মন ছুটে যেতো। জগদীশের দেশে ফেরার জন্য স্বপ্নে সেই বুক উচাটন। ঘুম ভাঙ্গতেই তার কোলকাতা বাসকে অবাস্তব অসম্ভব মনে হলো। সে দেশে যাবে! বাড়িঘর নিশ্চিয় সব জঙ্গল হয়ে গেছে! প্রথমেই যাবে জহরের চায়ের দোকানে। আহা কতকাল সে চা খায় না জগদীশ? জহর কি এখনো ঢাকাতে আছে? কি যে দিন গেছে! জহরের দোকানের পাশেই বশিরের বাখরখানির দোকান। বাখরখানি আর আমেত্তির কথা মনে পড়লে এখনো মুখে জল আসে। জগদীশ আবার ভাবে, ধুর, আমি বিশ্বাস করি না পাকিস্তান! বেবাগ ঠিক হইয়া যাইবো! কয়দিন ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকব?
চল্লিশ বছর বয়েসে জগদীশ ১৯৪৭ সালে কোলকাতায় এসে পৌঁছায়। পশ্চিমবঙ্গ তার অচেনা নয়। অবিভক্ত বাংলায় সে জীবনে ঢের এসেছে এখানে। তার মাসির বাড়ি বনগাঁ। দুই পিসির বিয়ে হয়েছিলো চুঁচুড়া। কোলকাতা এসে তাকে তাই শেয়ালদা স্টেশনে শরণার্থী হতে হয়নি। কিন্তু সর্বস্ব খুইয়ে প্রায় খালি হাতে তাকে আসতে হয়েছিলো। রায়টের সেই রাতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে হয়েছিলো জগদীশকে একমাত্র পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে। কোলকাতায় এসে তাকে জলে পড়তে হয়নি। আত্মীয় স্বজন সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বছর যেতেই তাই জগদীশ সংসার গুছিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু চল্লিশ বছরের একটা গাছকে শেকড় সুদ্ধ তুলে নিয়ে কোলকাতার মাটিতে পুঁতে দিলেই হয় না। জগদীশের সবুজ পাতা হলদেটে হতে শুরু করে। একদিনের জন্যও কোলকাতাকে তার নিজের মনে হয়নি। বারবার বুড়িগঙ্গার কথা সে ভেবেছে। পাড়ায় জগদীশকে ঢাকার সুলতান বলে ক্ষ্যাপায়। বাঙালগুলির সবার নাকি পাকিস্তানে জমিদারী ছিলো! ইয়া বাড়ি, বাগান, ঘি দিয়ে লুচি ভাজত হে: হে: হে:…। কবুতরের খুপরির মত আলো বাতাসহীন দুটো ঘরে জগদীশের মন বসে না। তাই পাড়ার চায়ের দোকানে দেশের গল্প বলতে সে ভালোবাসত। এই ভালোবাসা তার মুদ্রাদোষ হয়ে উঠল। কিছু হলেই ঢাকার কথা। রোজ স্বপ্নে এসে ধরা দিতো বুড়িগঙ্গা…।
জগদীস এখন ৬৩ বছরের এক বৃদ্ধ। নানা কারণে তাকে আরো বেশি বয়স্ক দেখায়। কোলকাতা বাস তার ২৩ বছর হয়ে এলো। এই সময় একদিন সকালবেলা আনন্দবাজার হাতে দারুণ উত্তেজিত জগদীস। ঘরে পায়চারী করছে! নিজেকেই বারবার বলছে, কইছিলাম না? পাকিস্তান টিকবো না…!
ছেলে প্রসেনজিৎ অফিসের যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। জগদীশ তাকে ধরে বলে, দেখছতনি, আমি কইছিলাম না পাকিস্তান টিকবো না!
প্রসেনজিৎ বলে, হুম তাতে হয়েছি কি?
-কছ কি তুই! আমাগো দ্যাশ না!
-বাবা, পাকিস্তান ভাঙ্গলে তোমার কি লাভ? তুমি কি মনে করছ জয় বাংলায় তুমি যেতে পারবে?
জগদীশ হাসে। তরা পোলাপান কিছু বুঝছ না। দ্যাশ হইল গিয়া দ্যাশ! আমার দ্যাশে আমি যামু না! জয় বাংলা যেইদিন হইব সেইদিনই আমি যামু। দেহি কোন হালারপুতে আমারে ঠেকায়…
এরপর প্রতিদিন প্রসেনজিৎ বাসায় ফিরলে জগদীশ তাকে ধরে জয় বাংলার খবর জানতে চায়। তাদের অফিসের ভোলাবাবু সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলছে শরণার্থী ক্যাম্পের জন্য। ঠিক হয়েছে অফিস থেকে সুবিধামত তারা কয়েকজন যশোররোড যাবে। জগদীশ বলে, আমি তগো লগে যামু আগেই কইয়া দিলাম!
-পাগল নাকি তুমি! তোমার এই শরীরে যাওয়া সম্ভব না। তুমি বরং শ্যামবাজারে একটা অনুষ্ঠান হবে সেখানে যেও। আরে রেডিওতে চরমপত্র পড়ে যে মানুষটা তিনি থাকবেন। তোমার তো চরমপত্র দারুণ লাগে।
বিকেলে দিকে জগদীশ হাঁটতে বের হয়। তার এই বৈকালিক ভ্রমণের সঙ্গী পাড়ার নিত্যবাবু। নিত্যবাবুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ইয়ার দোস্তের মত। দুজন দুজনকে তুমি করে সম্বধন করে। নিত্য সর্বদা রসে টইটুম্বর। জগদীশকে ক্ষ্যাপাতেই তার ভালো লাগে। নিত্য বলে বাঙালরা কথা বললেই মনে হয় ঝগড়া করছে। এর একটা বৈজ্ঞানিক কারণ সে বের করেছে। জগদীশের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে ঝালের কারণে তার নাকের পানি চোখে পানি একাকার অবস্থা। তাতেই তার মনে হয়েছে বাঙালরা ঝাল বেশি খায় বলে তাদের মেজাজটাও লংকার মত! নিত্য বিকেলে বেরিয়ে জগদীশকে ঠেস মেরে বলল, কি হে শুনছি ফের জমিদারী ফিরে পাচ্ছো!
জগদীশ জানে এটা নিত্য বলছে নেহাত রশিকতা করে। জগদীশকে ক্ষ্যাপিয়ে সে মজা পায়। জগদীশ জবাবে বলল, পামুই তো! তোমার সমস্যা আছে?
-হে: হে: কি যে বলো ভায়া। তা যাবে নাকি জয় বাংলায়?
-নিশ্চিয় যামু। জয় বাংলা স্বাধীন হইব দেইখা নিয়ো।
-তা হয়ত হবে। তবে তোমার সেখানে জায়গা হবে কি ভায়া?
-শুনো, দ্যাশ হইল দ্যাশ, সেইটা কোনদিন পর হয় না।
-আরে ভায়া, বলছি সেখানে তোমাকে ওরা নিবে কি?
জগদীশ জেদ দেখিয়ে বলে, কোন হালায় নিবো না নিবো তারে আমি পুছি না!
নিত্য হো হো করে হাসতে থাকে। সে সফল। জগদীশকে ক্ষ্যাপানো গেছে। নিত্য ঘোর ঘটি। জগদীশ বাঙাল বলে সব সময় ঘটি বাঙালের একটা তর্ক তুলে সে মজা পায়। মুখে যা-ই বলুক, নিত্য পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য জগদীশের মতই উদবিগ। কোথায় কোন সভা সমাবেশ হচ্ছে পূ্র্ব বাংলার জন্য নিত্য সেসব খবর এনে দিবে জগদীশের জন্য। তারপর দুজনে মিলে সেখানে উপস্থিত হবে।
জগদীশ বলল, শ্যামবাজার যাইবা নি?
নিত্য হাসতে হাসতে বলল, নকশালরা ধরে প্যাঁদাবে ওদিকে যেয়ো না!
-ক্যান, নকশালগো আমরা কি করছি?
-জয় বাংলা হোক এটা চীন চায় না বুঝো না। নকশালরা যদি জানে তুমি পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাও হে: হে: হে:…। যাগগে, শোনো, রাতের বেলা ক’টায় শেষ হবে তার ঠিক নেই। আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
-তুমি না গেলে নাই।
-হা হা হা দেখো বাবু কেমন রাগ দেখায়। আরে মশাই যাবো তো ঠিকই। এতো রাগো কেন…
প্রসেনজিৎদের অফিস থেকে শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে এসেছে। জগদীশ ছেলের মুখে অগণিত মানুষের দু:খ কষ্টের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
-বুঝলে বাবা, এ জিনিস চোখে দেখা যায় না! কি হাল যে করেছে পাকিস্তানীরা ওদের…
-হালার পুতেগো পাইলে জলে ডুবাইয়া মারমু!
প্রসেনজিৎ হো হো করে হেসে উঠে। তুমি পাকিস্তানীদের পাবে কোথায়? বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে যাবে নাকি?
জগদীশ গম্ভীরভাবে বলে, মজা করিছ না। বয়স থাকলে ঠিকই যাইতাম গিয়া…।
প্রসেনজিৎ বাবার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে যায়। মা মারা যাবার পর বাবা এমনিতে একা হয়ে পড়েছে। তার উপর দেশ দেশ করে সারা জীবন বাবা আর স্থীর হতে পারেনি। এতখানি সিরিয়াস হয়ে যাবে সেটা প্রসেনজিৎ ভাবেনি। ভেতরের ঘরে গিয়ে শার্ট খুলতে খুলতে প্রসেনজিৎ স্ত্রী মিলিকে বলে, বাবার দিকে একটু নজর রেখো। বাংলাদেশ নিয়ে উনি তো দেখি পাগলই হয়ে যাবেন। আজ যে চোখে আমার দিকে চেয়েছেন, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি। বাবার চোখের দৃষ্টিটা আমার ভালো লাগেনি।
মিলি বলল, তুমিই তো বুড়ো মানুষটিকে উশকে দিচ্ছো। রোজ এসে এত যুদ্ধ আর বাংলাদেশ করো কেন?
প্রসেনজিৎ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, হ্যাঁ, একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, না বাবা আর এসব বলতে আসব না…।
জগদীশ আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপনটা পড়ল। শ্যামবাজারে দুই বাংলার বাঙালী গুণিজনদের সংবর্ধনা দেয়া হবে। এর মধ্যে চরমপত্রের এম আর আখতার মুকুলও থাকছে। চরমপত্রের লোকটার গলা শুনে জগদীশের রক্তে ঝড় বয়ে যায়। আজ সামনে থেকে তাকে দেখতে সকাল থেকেই জগদীশ অস্থির হয়ে আছে। দুপুরে ভাত খেয়েই জগদীশ পাজামা পাঞ্জাবী পরে নিত্যর বাড়ি সামনে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল।
তিন চারবার ডাকার পরই নিত্য সাড়া দিতে দিতে গেইট দিয়ে বেরিয়ে এসে বলল, ইস এই বাঙালগুলি যা চেঁচায় না! বলি তোমার ডাকে শেষে দৌড়াতে হয়েছে। এত তাড়া কিসের বলো তো? চলো আগে একটু চা খেয়ে নেই।
মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে জগদীশ দেখে সবার হাতেই খবরের কাগজ। এখন কাগজে খালি বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ। বাড়িতে আনন্দবাজার শেষ করে জগদীশ পাড়ার একটা ক্লাবে যায় অন্য আরেকটা কাগজ পড়তে। এখানেও সবাই বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করছে। একজন বলল, চীন একটা ফ্যাক্ট হয়ে উঠবে এই যুদ্ধে দেখে নিও…। পাশের জন চাপা গলায় তাকে সতর্ক করে বলল, এ্যাই, আস্তে, চীনের নাম তোমাকে এখানে কে নিতে বলেছে? লোকটা চুপ করে গেলো। অন্য দিকের একজন বলল, শেখ সাহেবকে কি মেরে ফেলবে মনে হয়? অন্যজন উত্তর দিলো, আরে ভাই এত সোজা না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন কি ছেড়ে কথা বলবে? আনন্দবাজারে আজকে একটা লেখা বেরিয়েছে পড়েছেন… এই যে এখানে…
নিত্য আর জগদীশ উঠে যায়। তারা শ্যামবাজার যাবে। বাসে উঠে নিত্য বলে, শোনো আসার সময় তোমার একাই আসতে হবে। আমার শ্যামবাজারে বড় শ্যালকের বাড়িতে একটু কাজ আছে। আমার আসতে বেশ রাত হবে। তুমি কি এতরাত অব্দি আমার সঙ্গে থাকবে? তুমি বরং অনুষ্ঠান শেষে চলে এসো।
শ্যামবাজার নাট্যশালায় মানুষের প্রচন্ড ভীড়। চাপা উত্তেজনাও সবার মধ্যে। কংগ্রেস আর নকশালের ছেলেরা একে অপরকে ঠান্ডা চোখে দেখছে। বাংলাদেশ নিয়ে নকশালদের মাথা ব্যথা নেই কিন্তু চীন নিয়ে যদি বুর্জোয়ারা কিছু বলে তাহলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলা হবে…। কংগ্রেসও হুমকি দিয়ে রেখেছে বিশৃঙ্খলাবাদীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না…। জগদীশ ও নিত্য আসন নিয়ে বসল। বেজায় ভীড় আর চেঁচোমেচি।
সংবর্ধনা হলো আলোচনা হলো। এবার মাইক হাতে নিয়ে চরমপত্রের মুকুল কথা বলতে শুরু করল। জগদীশ সোজা হয়ে বসে। কান চোখ স্থীর করে মঞ্চে। জয় বাংলার তেজদীপ্ত মানুষটি তখন বলছে কেন তাদের পাকিস্তান করতে বাধ্য করেছিলো। কারণ হিন্দুরা তাদের মুসলিম হিসেবে অপমান অবজ্ঞা করত। তার ছেলেবেলার কয়েকটি ঘটনার কথা বলল। জগদীশ জানে এগুলোর সবগুলোই সত্যি কথা। হিন্দুদের জাতপাত ছোঁয়াছুয়ি আজো যায়নি। মুসলমানের খাওয়া গেলাশ তারা সাতবার ধুয়ে তবে ঘরে তুলবে!... তাই বলে দেশভাগ? না হয় তরা থাকতি তগোর মত…। জগদীশ শুনতে শুনতে ঠায় ফ্যাকাশে হতে থাকে। মাইকে চরমপত্রের বজ্রকন্ঠটি তখন উপসংহার টানছে, “বাংলাদেশের এই ভয়াবহ দুর্দিনে আপনারা আশ্রয় দিয়েছেন-আপনজন ভেবে কাছে টেনে নিয়েছেন। এজন্য আপনাদের জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে আপনারা যারা সাতচল্লিশ, পঞ্চাশ, আটান্নো, বাষট্টি কিংবা পয়ষট্টি সালে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আবার তারা এককালের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন। তবে হ্যাঁ একাত্তরে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যারা দানবীয় আক্রমনের মুখে বাস্তুচ্যুক হয়ে চলে এসেছেন দেশ স্বাধীন হবার পর তারা স্বদেশে পুনর্বাসিত হবেন। বাস্তব ক্ষেত্রে যা ঘটতে যাচ্ছে, সেই নির্মম সত্য কথাটা আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করলাম। অলীক স্বপ্ন দেখলে শুধু মানসিক যন্ত্রণাই বৃদ্ধি পাবে…”
হলঘর থেকে বেরিয়ে আসে জগদীশ আর নিত্য। বাইরে তখন শেষ বিকেলের আলো। নিত্য তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল, কি হে, জয় বাংলা তো বলছে তোমাকে নেবে না! ঐ ৬৫ সালে যারা এসেছিলো তাদেরও নয়। তুমি তো তারও আগে এসেছো…। বলে নিত্য হাসে। নিত্যের গলায় শ্লেষ উপহাস নেই। এ কেবলই বন্ধুকে খুঁচিয়ে একটু রাগানোর উপলক্ষ্য মাত্র। জগদীশ অবশ্য কিছুই শুনছিল না। সে পায়ে পায়ে হেঁটে বড় রাস্তায় চলে গেলো। নিত্য বিদায় নিয়ে চলে গেছে। কোলকাতার অফিস ভাঙ্গা পথে আজ অন্যদিনের চেয়েও বেজায় ভীড়। রাস্তায় নাকি সিনেমার লোকজন পূর্ববঙ্গের জন্য অর্থ সাহায্য তুলছে। জগদীশ বাড়ির পথ ধরে চলতে চলতে দেখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা খুবই সাধারণ পোশাকে একজন বিখ্যাত মানুষ হাত পেতে মানুষের কাছে পয়সা চাচ্ছে। জগদীশ জানে এই মানুষটির নাম ঋত্বিক ঘটক। উনি বলছেন, আমার দেশের জন্য সাহায্য করুন…।
দেশ! জগদীশের বুকে চাবুকের মত করে বেঁধে। সত্যিই কি এর কোন অর্থ আছে? নেহাতই কিছু স্মৃতি। কিছু মানুষ। একটি নদী। বাড়িঘর।…এছাড়া দেশ বলতে কি কিছু আছে? পূর্ববঙ্গের এতগুলো গ্রাম শহর, তার কোনটার জন্যই তো তার চোখের জল আসে না। আর কোথাও তো জগদীশ ফিরে যেতে চায় না? বুড়িগঙ্গার ধারে মাত্র কয়েক কিলোমিটার স্মৃতিমাখা সীমানাটুকুর নামই তাহলে দেশ?
জগদীশের কাছে বাস ভাড়া যা ছিলো সেটাই তুলে দিলো সাহায্য প্রার্থীদের হাতে। ঋত্বিক ঘটকের মুখের দিকে চেয়ে জগদীশ ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, এই যে বাবু, আমি আপনারে চিনি, আপনে ছবি বানান তো, এই যে জয় বাংলা যখন স্বাধীন হইব, তখন কি আপনের ছবি সেখানে দেখানো হইব?...
ঋত্বিক ঘটক এতক্ষণ খেয়াল করেননি। কন্ঠ শুনে চেয়ে দেখেন মুখে খোচা খোচা সাদা দাড়ির একটা ভাঙ্গাচুরা বুড়ো তাকে কিছু বলছে, কি বলল বুঝা গেলো না। লোকের ভীড়ে জগদীশ সহসা পিছিয়ে আসল। ঋত্বিক ঘটক কার সঙ্গে কথা বলছিলো, আবার সেখানে মনোযোগ হলো। জগদীশ ক্রমশ পিছনে পড়ে গিয়ে ভীড়ে বাস রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে লাগল। পশ্চিমের আকাশে তখন দিনের শেষ সূর্যটা গলে লেপটে গেছে সিঁদুর রঙে। সব কিছু ভুলে জগদীশ এখন সেইদিকে চেয়ে আছে। বিষাদমাখা এই সন্ধ্যাক্ষণ তার চিরকাল প্রার্থনার মত পবিত্র লাগে। বুকের ভেতর কিসের জন্য যে হুঁ হুঁ করে জগদীশ জানে না। সেই ঢাকার বাড়ির ছাদে উঠেও জগদীশ দূর পশ্চিমের আকাশের দিকে চেয়ে বেদনাকে ভালোবেসে রোজ সূর্যাস্ত দেখেছে…। জগদীশের মনে হলো বুড়িগঙ্গার সূর্যাস্তটা আজ কোলকাতার শ্যামবাজারের আকাশে কি করে এলো? জগদীশের কানে ঘন্টার বাজার শব্দ এলো।… ঢাকার সন্ধ্যায় এখনো কি আজানের সঙ্গে পুজার ঘন্টা বাঁজে?... ঘন্টা ধ্বনি তীব্র হতে লাগল। জদীশের মনে হলো… না জগদীশ বিস্মৃত হলো… জগদীশ এখন ঢাকায়। ঐ তো পশ্চিমের আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বুড়িগঙ্গার বুকে তখন শান্ত হাওয়া বইছে। চারদিক শান্ত, নিবির অন্ধকার… জগদীশের শেষবারের মত মনে হলো সব কিছু বুজে আসছে গভীর অন্ধকারে…।
কোলকাতা ট্রামের শতবর্ষের ইতিহাসে ট্রাম লাইনে কাটা পড়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা কবি জীবনানন্দ দাসের। দ্বিতীয় ঘটনাটি ইতিহাসে স্থান পায়নি। জগদীশ রায়ের ট্রাম লাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর খবরটি কোলকাতার কোন খবরের কাগজে স্থান পায়নি। জগদীশের মৃত্যু সংবাদটি সম্পাদকের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছালেও সেদিনকার বাংলাদেশ যুদ্ধের খবরাখবরে স্থানসংকুলান না হওয়ায় জগদীশের খবরটি শেষ পর্যন্ত বাতিল কাগজের ঝুরিতে গিয়ে ঠাই পায়…।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................