প্রাচীন রোমের ঐশ্বর্য্যমত্ত বিলাসী-বিলাসিনীরা একদিন একপাত্র ভোজ্যের রাজসিকতা রক্ষার জন্য কোটী মুদ্রা অকুণ্ঠিত চিত্তে ব্যয়িত করিয়া কতই না সন্তোষ লাভ করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহাদের সেই স্মৃতি কাহার হৃদয়-সমুদ্রকে এমন করিয়া মন্থন করে ?
*******
"ক্রুশবিদ্ধ যীশুর এক ফোঁটা বুকের রক্ত, আবার পরদুঃখকাতর বুদ্ধের একবিন্দু চোখের জল যেমন করিয়া হৃদয় উজাড় করিয়া দেয়, চিত্ত-বৃত্তিগুলিকে যেমন করিয়া উন্মত্ত করিয়া তুলে, কোন্ ধনবানের, কোন্ জ্ঞানবানের, কোন্ রূপবানের স্মৃতি তেমন করিয়া আমাদিগকে বিহ্বল করিতে পারে ?
প্রাচীন রোমের ঐশ্বর্য্যমত্ত বিলাসী-বিলাসিনীরা একদিন একপাত্র ভোজ্যের রাজসিকতা রক্ষার জন্য কোটী মুদ্রা অকুণ্ঠিত চিত্তে ব্যয়িত করিয়া কতই না সন্তোষ লাভ করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহাদের সেই স্মৃতি কাহার হৃদয়-সমুদ্রকে এমন করিয়া মন্থন করে ?
সুন্দরী-কুল-শিরোমণি ক্লিওপেট্রার রূপের জ্যোৎস্নায় শুধু নাইল নদীই নহে, সমগ্র ভূমধ্যসাগরের জলরাশি যৌবন-প্লাবনে উথলিয়া উঠিত, কিন্তু তাহার জন্য আজ কাহার চিত্ত অধীর হইয়া উঠে ?---
মানবতার আবেদন যখন আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে তখন ইহাদের কথা স্মৃতির কোণেও জাগে না।
অধিক কি, কালিদাসের সুমোহন কবিতাবলির জন্য উজ্জয়িনীর প্রাসাদে প্রাসাদে প্রতি বাতায়ন উৎকর্ণ হইয়া থাকিত, দ্বাপরের সেই শাশ্বত-বংশীর ন্যায় যাঁহার কাব্য-মুরলীতে শিপ্রার জলরাশি উজান বহিত, আজও যাঁহার অবিনশ্বর বাক্য-সুধা ভূমণ্ডলের প্রতি পিপাসু রসনার পরম-প্রার্থনার সামগ্রী, সেই কালিদাসের মহাকবিত্বকে যখন ত্যাগবীর বুদ্ধ বা যীশুর এক ফোঁটা নয়নাশ্রু বা হৃদয়-রক্তের সহিত তৌল করি, তখন তাহা যেন নিতান্ত তুচ্ছ, নিতান্ত নগণ্য, নিতান্ত উপেক্ষার বস্তু বলিয়া মনে হয়।
তখন মনে হয় যদি বুদ্ধেরই মত দুঃখার্ত্ত-জীবকুলের জন্য সহানুভূতিতে গলিয়া প্রাণ খুলিয়া সমগ্র জীবনে একটী মুহূর্ত্তও কাঁদিবার অধিকার পাই, মানব-জাতির পাপ-তাপ-প্রশমনের জন্য যীশুর মত একদিনের জন্য এক রতি শোণিতোৎসর্গ করিতে পারি, তবে কালিদাস, ভবভূতি, গেটে, সেক্সপীয়ার, হোমার, ভাজ্জিল ইঁহাদের সকলের কবি-প্রতিভা একত্র পাইলেও তাহা চাহি না, চাহি না, চাহি না।
মনুষ্য-সমাজে যাঁহারা পিকরাজ, দুঃখ বর্ষার অবিরাম বর্ষণেও যাঁহারা কণ্ঠের কাকলীতে চিরবসন্তকে বাঁচাইয়া রাখেন, শীতের প্রবল পীড়নেও যাঁহারা আশার ঝঙ্কারে মানবের সংগ্রাম-কুশলতাকে রক্ষা করেন, সেই কবিকুল জগতে চিরনমস্য।
কিন্তু তথাপি মনে হয়, দধীচির মত যদি জগতের হিতার্থে নিজ অস্থি দান করিতে পারি, তবে কবিগুরু বাল্মীকির তপঃসিদ্ধ বীণাও আমার ক্ষণেকের জন্য প্রলোভনের বস্তু নহে। মানবতার পূজা-মন্দিরে কবিদের জন্যও স্থান আছে, কিন্তু পরার্থে-জীবনোৎসর্গকারীর স্থান সর্ব্বোপরি।
অবশ্য একথা আমি ভুলিয়া যাইতেছি না যে, বাল্মীকির বীণা যে তপঃসিদ্ধ হইল, সে শুধু পরদুঃখকাতরতার দৈবী সম্পদে।"
( শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)
[আদর্শ ছাত্রজীবন]
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................