ভারতের আলেকজান্ডার কাশ্মীর অধিপতি , ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা (মুক্তিপিড়) [প্রথম পর্ব] :
প্রিয় পাঠক বন্ধুদের কথা দিয়েছিলাম পূজার পর এক বীর যোদ্ধার গল্প শোনাব। ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা। পরিকল্পনা মাফিক যাকে এদেশের ইতিহাস থেকে আপাদমস্তক ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তার আগে আবার পড়ে নিন কোন পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে এটি জানিয়েছিলাম। যারা মিস করেছেন, তাঁদের জন্য আরেকবার--
কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তথাকথিত বামপন্থিরা জুনাগড়ের গল্পটি শুনিয়ে থাকেন। কি সেই গল্প? স্বাধীনোত্তর ভারতেও কিছু "স্বাধীন " রাজ্য/ অঞ্চল থেকে গিয়েছিল যারা ভারতের অঙ্গীভূত হতে চায়নি। এমনই দুটি রাজ্য হল কাশ্মীর এবং জুনাগড়। জুনাগড়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু শাসক ছিলেন একজন মুসলিম। তিনি পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু জনগণ যেহেতু বেশির ভাগ হিন্দু, তাঁরা চাইলেন ভারতের অংশ হতে। মুসলিম শাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা রীতিমত বিদ্রোহ করে বসলেন। জনগণের মতই চূড়ান্ত হওয়া উচিত, এই যুক্তিতে গণভোটের মাধ্যমে জুনাগড়কে ভারতে যোগ দিতে বাধ্য করা হল। কাশ্মীরে ছিলেন হিন্দু রাজা হরি সিংহ। কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। হরি সিংহ প্রথমে স্বাধীন রাজা হিসেবেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে আশংকিত হরি সিংহ জহরলাল নেহেরুর সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সুযোগের সদব্যহার করে এবং কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত করেন ( যদিও সমগ্র কাশ্মীর নয়)৷ অতি সংক্ষেপে ইতিহাসটি এমন। বামপন্থিরা এবার আপনাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে -- জুনাগড়ের বেলায় জনগণ যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছিল, তাই তাকে ভারতে যুক্ত করা হল, কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সেটি কেন পাকিস্তানে যোগ দিতে পারল না? গণভোট কেন নেওয়া হল না? খুব যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। আপনিও অবশই মন দিয়ে শুনবেন। যুক্তি তর্ক খুব প্রিয় বস্তু৷ আমি তো দারুণ ভালবাসি৷ এবার আপনি পালটা প্রশ্ন করুন -- কাশ্মীরের জনগণ তো রাজা ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সময়ও পুরোপুরি হিন্দু ছিল, গজনীর সুলতান নৃশংস রক্তপিশাচ মামুদ যখন রাজা জয়পালকে পরাজিত করে, তখনও কাশ্মীরের জনতা হিন্দুই ছিলেন, তাঁর সন্তান আনন্দপাল যখন বীরগতি লাভ করেন তখনও কাশ্মীরের জনগণ হিন্দুই ছিলেন, এমনকি লোহারা রাজবংশের শাসনকালেও কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা হিন্দুই ছিলেন। তবে বিংশ শতাব্দীর কাশ্মীর কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেল?
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার পর আপনার প্রিয় কমরেডটির দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখুন। অপেক্ষা করুন কি উত্তর দেন৷ নইলে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। উত্তর আমিই দেব৷ সেই পৈশাচিক গণহত্যা আর অমানবিক ধর্মান্তকরণের কাহিনী। তবে পূজার পর।
-----
প্রথমেই প্রশ্ন জাগে কে এই ললিতাদিত্য মুক্তিপদ ? কেনই বা তাঁকে স্বাধীন ভারতের মার্ক্সবাদী /বামপন্থী ঐতিহাসিকেরা পরিকল্পনা মাফিক এড়িয়ে গেলেন। স্কুল পাঠ্য তো দূরের কথা কোনো রকম একাডেমিক আলোচনাতেও তাঁর তেমন উল্লেখ পাওয়া যায়না।গবেষণা তো দূরের কথা। অথচ তথ্যের যে খুব অভাব আছে এমন নয়। তাঁকে নিয়ে আস্ত একটি গ্রন্থই আছে। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত সিল্ক রুটের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই সম্রাটকে কেন্দ্র করেই কলহন নামের এক ঐতিহাসিক একটি অসামান্য পুস্তক রচনা করেছিলেন—রাজতরঙ্গিনী। রচনাকাল দ্বাদশ শতাব্দী। যথেষ্ট পরিশ্রম করে লেখা। মোট ৭৮২৬টি শ্লোক, আট খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটি নিছক ঐতিহাসিক সত্তাই নয়, সংস্কৃত ভাষার উপর কলহনের অনন্যসাধারণ দখলকেও নির্দেশ করে। তবে ললিতাদিত্য কেন এই বই থেকে ভারতের ইতিহাসে উঠে এলেন না ? কি ভাবছেন ? উত্তর নেই ? এমনি এমনি ঘটে গেছে ? ইয়ে মানে আমাদের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক থুড়ি ঐতিহাসিকেরা [এই যেমন ইরফান হাবিব, মোহম্মদ হাবিব, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র] মুঘল শাসন, ব্রিটিশ শাসন নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে ললিতাদিত্যের নামটিই ভুলে মেরে দিয়েছেন ? উঁহু এসব কোনো কারণ নয়। তবে ? আরে মশাই সংস্কৃতের মত একটা “হিন্দুত্ববাদীদের” “বর্ণহিন্দুদের” ভাষায় লেখা ইতিহাস ! ছোঃ আস্তাকুড়ের জঞ্জালকে মার্ক্সবাদীরা কখনও ছুঁয়ে দেখে ? তাই বুক এণ্ড অথর সেকশনের[ ইয়ে মানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। বইয়ের নাম উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়—লেখক কে ?] মামুলি একটি সংযোজন হয়েই রাজতরঙ্গিনী তথা কলহনকে থেকে যেতে হল। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি আছে ! কোনো পার্সি, ইসলামি, নিদেন পক্ষে ব্রিটিশ রচনাকার যদি লালাদিত্যকে নিয়ে কিছু লিখতেন তবে হয়ত ক্ষমাঘেন্না করেও এই মহাবীরকে একটু জায়গা দেওয়া হত [ আমায় একটু জায়গা দাও, বাম মসনদে বসি ---] লালাদিত্যের মধ্য এশিয়া বিজয় নিয়ে অনেক পরে অবশ্য একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ লেখা হয়েছে। অধ্যাপক আন্দ্রে উইঙ্ক-এর AL Hind, Making of Indo-Islamic world[2002] এছাড়াও কোরিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হায়েচোর বিবরণ থেকেও লালাদিত্য সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা কলহনের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীর ভ্রমণে আসেন।
ধরে নেওয়া যাক কোনো পার্সি বা ইসলামিক ঐতিহাসিক এই যেমন ধরুন মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ গোছের কেউ ললিতাদিত্যকে নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক কিছু লিখে গেলেন। তবে কি তিনি স্বাধীন ভারতের ঐতিহাসিকদের কলমে স্থান পেতেন ? ইয়ে মানে আমি যাঁদের কথা বলেছি ! উঁহু সে গুড়ে বালি ! তাতেও কিছু লাভ হতনা। কেন ? সেই আলোচনাই তো করব। তার আগে খান দুই প্রশ্ন করি ।
বলুন তো এদেশের ইতিহাসে কোন কোন রাজা/ সম্রাট বড় বড় সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন ?
আমিই বলে দিচ্ছি[ ইয়ে মানে আপনারা বেশীরভাগ যা বলবেন] ১] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, ২] সমুদ্রগুপ্ত [ এঁকে ভারতের নেপোলিয়ন বলা হয়] ৩] আলাউদ্দিন খিলজি ৪] আকবর ৫] ঔরঙ্গজেব ইত্যাদি--আমি কেবল বড় সড় সাম্রাজ্যের কথাই বলছি।
এঁদের মধ্যে হিন্দু কজন ? অবশ্যই প্রথম দুজন।
পরের প্রশ্ন। এই দুজন কি ইসলামি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই সাফল্য অর্জন করেছিলেন ? প্রশ্নই আসেনা। তাঁদের সময় ইসলামের জন্মই হয়নি।
পরবর্তী প্রশ্ন –কজক হিন্দু শাসক/ রাজা ইসলামি শাসক/ আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ?
বেশ কয়েকজন । যেমন পৃথ্বীরাজ চৌহান, [মহম্মদ ঘোরির বিরুদ্ধে] আনন্দপাল জয়পাল [সুলতান মামুদের বিরুদ্ধে], রাণা প্রতাপ এবং হিমু [সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে], শিবাজী [ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে] ইত্যাদি—
পরের প্রশ্ন এঁদের মধ্যে কে কে জয়লাভ করেছিলেন ? এক কথায় কেউই না।
পৃথ্বীরাজ চৌহান তরাইনের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করলেও দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘোরির কাছে পরাজিত এবং নিহত হন। প্রথম যুদ্ধে পরাজিত ঘোরিকে তিনি ক্ষমা করার ভ্রান্তি করেছিলেন।] শিবাজী অবশ্য বেশ কিছু যুদ্ধে মুঘলদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তখন ইতিমধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিশাল সাম্রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে নজরদারী লড়াই চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। আর পর্বত মূষিক শিবাজী গেরিলা কায়দায় চোরা গোপ্তা আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। মহারাষ্ট্রের কিছু অংশেই তিনি তাঁর আধিপত্য দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বোপরি এঁরা কেউ ইসলামি শাসকদের আক্রমণ করেননি। আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করেছিলেন মাত্র। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। তাই এঁরা সবাই – ডিফেন্ডার !
এবার শেষ প্রশ্ন—বলুন তো কোন হিন্দু রাজা সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটি স্থাপন করেছিলেন? চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিক্রমাদিত্যের চেয়েও অনেক অনেক বড় ! কোন হিন্দু রাজা মহা বিক্রমে একের পর এক ইসলামি রাজ্যকে আক্রমণ করেছিলেন এবং বার বার পরাজিত করেছিলেন? কোন হিন্দু সম্রাট পরাজিত ইসলামি সেনা বাহিনীর মাথা অর্ধেক ন্যাড়া করে রাজপথে হাঁটিয়ে ছিলেন এবং করজোরে মার্জনা না চাওয়া পর্যন্ত কাউকেই ক্ষমা করেন নি ? কোন হিন্দু রাজা নিছক ইসলামি শক্তি নয়, তিব্বতের শাসকদেরও কাল ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন ? কোন হিন্দু নরেশ উত্তরে তুর্কিস্থান থেকে দক্ষিণে কেরালা, পশ্চিমে ইরাণ থেকে পূর্বে আসাম পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এবং জীবদ্দশায় একবারও পরাজিত হন নি ? সব প্রশ্নের একটিই উত্তর—ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা ! তাঁর আর একটি পরিচয় আছে। ভারতের আলেকজান্ডার ! বর্তমান গবেষণা তাঁকে এই শিরপাটিই প্রদান করেছে।
কিন্তু কজন এই মহাবীরের নাম শুনেছেন ? পথে ঘাটে , মলে মার্কেটে যাচাই করতেই পারেন—দেখবেন পাল্টা প্রশ্ন আসবে—ক্রিকেটার ? না রাজনীতিবিদ নাকি ফিল্ম স্টার ? বর্তমান কাশ্মীরের অবস্থা দেখে এই মহাবীরটির অস্তিত্ব মালুম করা অসম্ভব। যদিও অনন্তনাগ থেকে কিছু মাইল দূরে তাঁর কীর্তি হিসেবে মার্তণ্ড সান টেম্পল বা সূর্য মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন মার্তণ্ড সূর্যের একটি সমার্থক শব্দ।
ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার জন্ম হয় ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। তৎকালীন কাশ্মীরের রাজা দুর্লভক প্রতাপাদিত্যের তৃতীয় পুত্র তিনি। কাশ্মীরের কর্কট কায়স্থ বংশের প্রতিনিধি। এই বংশটিই যুগ যুগ ধরে কাশ্মীরের রাজার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে আসছিল। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ।বীরত্বের জন্য বিখ্যাত ছিল। কাশ্মীর নৃপতি তাঁদের শাক্যসেনা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কিন্তু এই বংশটি আদিতে কাশ্মীরের শাসন ক্ষমতাতে ছিলনা। ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার এক পূর্বপুরুষ [যিনি সমসাময়িক রাজার সেনাপতি ছিলেন] দুর্লভ বর্ধন কাশ্মীর নৃপতির একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করেন এবং কালক্রমে কর্কট বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ললিতাদিত্যের পিতা দুর্ভলক প্রতাপাদিত্য এই দুর্লভ বর্ধনেরই নাতি ছিলেন। চন্দ্রপিদা এবং তারাপিদা নামে তাঁর দুই সহোদরও ছিল। প্রথা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠপুত্র চন্দ্রাপিদাই প্রথম সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়। তারপর ক্ষমতায় আসেন তারাপিদা। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মাথায় তাঁর হৃদরোগে মৃত্যু হয়। বলাই বাহুল্য এর পরেই সিংহাসনের বসেন লালাদিত্য। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। কত খ্রিষ্টাব্দ ? ৭১৯ ! খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। খেয়াল করুন—ঠিক এই সময়েই ভারতে আরব [মুসলমান] আক্রমণ শুরু হয়েছে। তারা ইতিমধ্যেই মুলতান, পেশোয়ার, সোয়াত, এবং সিন্ধু জয় করে ফেলেছে। কার নেতৃত্বে ? ঠিক ধরেছেন মোহম্মদ বিন কাশেম !বিজয় গর্বে উদ্দাম এই অধিপতিটি তখন কাশ্মীর তথা সম্পূর্ণ মধ্য ভারত জয় করার জন্য এগিয়ে আসছেন। অনেক দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাঁর আস্ফালণ ! প্রমত্ত হুংকারে কেঁপে উঠছে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল। বলুন তো এমতাবস্থায় ললিতাদিত্য ঠিক কি করলেন ? রে রে করে মোহম্মদ বিন কাশেমের দিকে ধেয়ে গেলেন ? মাথা খারাপ ? এই জাতীয় মাথা গরমের কাজ কর্ম করলে কি উনি ভারতের আলেকজান্ডার হতেন ? ললিতাদিত্য বেশ ভালই বুঝেছিলেন কাশেম খুব সহজ প্রতিপক্ষ নন। এবার আপনিই বলুন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ম্যাচে ওয়ার্ম আপ ছাড়া নামা যায় ? ইয়ে মানে একটু গা গরম করে না নিলে মেজাজ আসে ? এমন কি ব্যাটসম্যানরা পর্যন্ত শেডো প্র্যাকটিস করতে করতে ক্রিজের দিকে এগোয়। লালাদিত্য ঠিক তাই করলেন। আঞ্চলিক ওয়ার্ম আপ। তিনি লাদাখ অঞ্চলের কিছু ছোটখাট শত্রু[ যারা সমসাময়িক তিব্বতের অধীনে ছিল] যেমন দারাদা, কভোজা, ভুট্টা ইত্যাদিদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন । না, তিনি কোনো সেনাপতি পাঠান নি। তবে ওয়ার্ম আপ হবে কি করে ? সেনাবাহিনীকে নিজে নেতৃত্ব দিয়ে লাদাখে প্রবেশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এই অঞ্চলের উপর আধিপত্য স্থাপনে সমর্থ হন। ললিতাদিত্য তখনও সুযোগের অপেক্ষায়। বেশ কিছু বছর অতিবাহিত হয়েছে। সিন্ধু প্রদেশের শাসক পদে এসেছেন জুনেদ। সময়টা ৭৩০ খ্রিস্টাব্দ। জুনেদের লক্ষ্য সমগ্র ভারত জয় করা। ললিতাদিত্য অনুমান করেছিলেন। তিনি কনৌজের রাজা যশবর্মনের সঙ্গে একটি যৌথ মোর্চা গড়ে তোলেন। এই শক্তিশালী রাজা্র রাজ্যটিও বেশ বড় সড় ছিল। বর্তমান বিহার, উত্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, এমনকি বাংলার কিছু অংশও যশবর্মনের রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ললিতাদিত্যের অধীনে তখন কাশ্মীর, হরিয়ানা এবং উত্তর পাঞ্জাব। এরপর কিছুদিন অপেক্ষা। ললিতাদিত্য শুধু নজর রাখছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রথমে তিনি আক্রমণে যাবেন না। এভাবে কয়েক মাস। আশঙ্কা সত্য হল। আগ্রাসী আরব সেনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ল কাশ্মীর সীমান্তে। নেতৃত্বে জুনেইড। পাল্টা প্রতিরোধে নেমে পড়লেন লালাদিত্য এবং যশবর্মন। একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু প্রত্যেকবারই আরবরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হল। সীমান্তেই পড়ে থাকল হাজার হাজার লাশ। ইতিমধ্যে খবর এল আফগান অঞ্চলে হিন্দুদের উপর আরবরা অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার হিন্দু। তিনি বুঝতে পারলেন কাশ্মীরের পরাজয় আরবদের খেপিয়ে তুলেছে। তাই আফগান হিন্দুদের উপর এই অত্যাচার। [অবাক হচ্ছেন নাকি ? আফগানিস্তানও তখন হিন্দুদের দেশ।] লালাদিত্য এতটাই ক্রুদ্ধ হলেন যে পরাজিত আরবদের মাথা ন্যাড়া করার [পুরোটা নয়] নির্দেশ দিলেন। যাতে সবাই বুঝতে পারে তারা পরাজিত এবং আত্মসমর্পনকারী। কি ভাবছেন ? এরপর এই হিন্দু রাজাটি থেমে গেলেন ? অন্য কেউ হলে অবশ্য তাই করতেন। আমার রাজ্য তো সুরক্ষিত। কি দরকার আর ঝামেলা বাড়িয়ে। ললিতাদিত্য অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। তিনি ঠিক করলেন আরবদের আরও বড় শিক্ষা দিতে হবে। বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি দার্দিস্থান [বর্তমানে উত্তর পাকিস্তান এবং উত্তর পূর্ব আফগানিস্তান] আক্রমণ করলেন। এবার আর যশবর্মনকে সঙ্গে নিলেন না। একাই আক্রমণ শানালেন। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। ডিফেণ্ড নয় এটাক ! কয়েক দিনের লড়াইয়েই দার্দিস্থানের উপর তাঁর দখল প্রতিষ্ঠিত হল। এরপরও থামলেন না। তাঁর নজর পড়ল টার্কিস্থানন্ড ত্রান্সোক্সিয়ানা [ বর্তমানে মধ্য এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। আধুনিক উজবেকিস্থান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ কিরগিজস্তান, এবং দক্ষিণ পশ্চিম কাজাকস্তান। আবার রক্তক্ষয়ী লড়াই। সহস্র আরবের মৃতদেহে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। ফল একতরফা। ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্য তখন বেড়েই চলেছে। না, এরপরও থামলেন না। কাবুল অতিক্রম করে তিনি তুর্কিস্তান আক্রমণ করে বসলেন। বুখারায় [তুর্কিস্তানের অন্তর্গত ] তখন মুমিন নামক এক আরব শাসক রাজত্ব করছিলেন। পরাক্রমশালী বীর বলে তাঁর সুনাম ছিল। একটি নয়, চার চারটি বড় সড় যুদ্ধ হল। কিন্তু লালাদিত্যকে পরাজিত করা দূরের কথা শেষ পর্যন্ত প্রাণ ভয়ে আত্মসমর্পন করলেন। তারপর ? শুনলে অবাক হবেন।আত্মসমর্পনকারী আরব শাসক মুমিন ললিতাদিত্যকে জিজিয়া প্রদানে সম্মত হলেন। না অর্থের প্রতি লোভ নয়। মুমিন যে তাঁর পদানত হয়েছেন তার প্রতীক হিসেবে। ইতিহাসে জয়ী হিন্দু রাজাকে জিজিয়া দেওয়ার উদাহরণ এই একটিই আছে । আমার অন্তত জানা নেই।
কাশ্মিরী ঐতিহাসিক কলহন এই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখছেন –
'The king, who carried his prowess, abandoned his (war-like) fury (only) when the (opposing) kings discretely folded their palms at his victorious onset. At the sound of his drums (beaten) in attack, the dwellings of his enemies were diverted by the (frightened) inhabitants and thus resembled women dropping in fright the burden of their wombs.'[ সংস্কৃত থেকে ইংরেজি অনুবাদ]
“দোর্দণ্ডপ্রতাপ লালিতাদিত্যের ক্রোধ তখনই শান্ত হত,যখন তাঁর শত্রু রাজারা হাত জোড় করে তাঁর বিজয়কে স্বীকার করে নিতেন। তাঁর রণবাদ্যের শব্দে শত্রুদেশের জনতা এবং সৈন্যবাহিনী চরম আতংকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, এমন এক দৃশ্য যেন প্রাণভয়ে ভীত রমণীরা তাদের গর্ভের ভার মোচন করে ফেলেছে।”
কি ভাবছেন ? এখানেই শেষ ? হা হা হা। এসবই সলতে পাকানোর পর্ব। হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
বহিঃশত্রু হিসেবে একদিকে যেমন আরব মুসলমান এবং তিব্বতের হানাদার, অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরেও একটি নতুন সমস্যার উদ্ভব হল। ললিতাদিত্যের শক্তি বৃদ্ধি অন্যান্য দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ঈর্ষা এবং আশংকার জন্ম দিল, যা একান্তই স্বাভাবিক। রাজ্যের সীমানা এবং আধিপত্য নিয়ে মিত্র রাজা যশবর্মন বিবাদ শুরু করলেন। আলাপ আলোচনায় কোনো ফল মিললনা। ললিতাদিত্য উপলব্ধি করলেন দেশের অভ্যন্তরে বিবদমান রাজাদের অস্তিত্ব থাকার অর্থ দুর্বলতাকে আমন্ত্রণ জানানো। একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করার প্রাথমিক শর্তই হল ভেতর থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠা। তাই দেশীয় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই আশু প্রয়োজন। ললিতাদিত্য সেই পথটিই অবলম্বন করলেন। যশবর্মনের সঙ্গে ঘোরতর লড়াই শুরু হল। বলাই বাহুল্য তাঁর পক্ষে ললিতাদিত্যের সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব ছিল। তিনি বড় করুণভাবে পরাজিত হলেন। যা অনিবার্য তাই ঘটল। ৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে যশবর্মনের রাজ্য কনৌজ ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হল। কনৌজ দিয়েই তাঁর জয়যাত্রা রুদ্ধ হলনা। এরপর তিনি অতি সহজেই গৌড় প্রদেশ এবং বঙ্গদেশ নিজের দখলে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে তিব্বত প্রভূত শক্তিধর হয়ে উঠল। এই সাম্রাজ্যটিকে প্রতিহত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠল। কিন্তু তিব্বত মানেই অজানা ভূখণ্ড। অন্য আবহাওয়া এবং জলবায়ু। তাই এমন কোনো মিত্র দেশের দরকার যে এই ভূখণ্ডটিকে চেনে। জলবায়ুর সঙ্গেও পরিচিত। রাজা ললিতাদিত্যের এবার একটি অসাধারণ কূটনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। চীনের ট্যাং রাজ বংশের সঙ্গে মিত্রতা। সপ্তম শতাব্দীতে এই ট্যাং বংশ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মধ্য চীনের অনেক এলাকা দখল করে নেয়। বলাই বাহুল্য তিব্বতের উপর চীন যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিল। ললিতাদিত্য এসবই বিশদে জেনে নিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ট্যাং রাজ বংশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ললিতাদিত্যের এই প্রস্তাবে চীন এক পায়ে খাড়া। কাল বিলম্ব না করে ললিতাদিত্যের সাহায্যার্থে হাজার হাজার সুসজ্জিত অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী পাঠিয়ে দিল। দুই বাহিনীর যৌথ আক্রমণে শক্তিধর তিব্বতকেও হার মানতে হল। ললিতাদিত্য অনায়াসেই কুচা এবং টারফান নিজের দখলে নিয়ে এলেন। কুচা হাতে আসার অর্থ সিল্ক রুটের [প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগ এবং বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ] একটি উল্লেখযোগ্য শাখার উপর আধিপত্য। এরপরই তিনি আসাম এবং বর্তমান বাংলাদেশ [যা তিব্বতের দখলে ছিল] নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন।
তিব্বত জয়ের পরই তাঁর মনে হল সমগ্র বিশ্বকেই যদি দখলে আনা যায় মন্দ কি ! যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্ব জয় চাইলেই করা যায় না। তার জন্য উপযুক্ত সেনা বল চাই। আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র , উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সদস্য বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি একটি বিশাল সেনা বাহিনী প্রস্তুত করে ফেললেন। এবার আর কি ! বেরিয়ে পড়া। প্রথমে পশ্চিম। মহারাষ্ট্রে তখন রাষ্ট্রকূট বংশের শাসন। তাদের পরাজিত করে ললিতাদিত্য দক্ষিণে পাড়ি জমালেন। পল্লব রাজাদের পরাজিত করলেন। তারপর কলিঙ্গের দখল। হ্যাঁ, এর পরই তাঁকে আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়।
ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্যটিকে আর একবার দেখে নেওয়া যাক। পূর্বদিকে তিব্বত থেকে পশ্চিমে ইরান পর্যন্ত। উত্তরে তুর্কিস্তান থেকে দক্ষিণে কেরালা। কাশ্মীর তখন কেবল ভারতের নয়, সমগ্র মধ্য এশিয়ার শক্তি কেন্দ্র।
কেবল বিজেতা হিসেবে নয়, প্রশাসক হিসেবেও তিনি অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলেই অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অটুট ছিল। এই বুদ্ধিমান রাজাটি অনুভব করেছিলেন প্রজারা যদি অত্যধিক ধনবান হয়ে ওঠে, একদিন রাজাকে অবজ্ঞা বা অমান্যও করতে পারে। তাই তিনি সম্পদ সঞ্চয়ের উর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনীতে সেনা নিয়োগের সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতেন। তাঁর নির্দেশ ছিল একই এলাকা/ অঞ্চলের দুটি সৈন্যের জন্য যেন একই ব্যারাক বরাদ্দ না করা হয়।
সম্রাট হিসেবে তাঁর দিগ্বিজয় অর্থাৎ সাম্রাজ্য বিস্তারের কাহিনী তো কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কলহনের রাজতরঙ্গিনী থেকে একটি উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছিনা-- ‘For rivers which have set cut from their own region, the ocean is the limit. But nowhere is there a limit for those who are frankly aspiring to be conquerers.”
ঐতিহাসিক কলহনের এই উক্তিটি রাজা ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে করা হলেও, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। সাম্রাজ্য বিস্তারের সীমা চিহ্নিত করা আর জ্ঞানচর্চার সীমানা বেঁধে দেওয়া দুটিই অসঙ্গত কাজ। আর তাই জ্ঞান বিজ্ঞানও কোনো সীমানা মানে না। ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্যের এই উপলব্ধি ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন একজন সার্থক সম্রাটের কীর্তি নিছক সাম্রাজ্য বিস্তারে নয়, সুশাসন, সংগঠন এবং রাজ্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্থক নির্মাণ কার্য যাকে ইংরেজি ভাষায় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট বলে থাকি। এব্যাপারে রাজতরঙ্গিনীতে কিছু উল্লেখ থাকলেও তা মূলত ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণ। জনগণের দৈনন্দনিন জীবন যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন নির্মাণকার্য নিয়ে বিশদ গবেষণার দরকার আছে মনে করি। একথা অনস্বীকার্য যে সাংস্কৃতিক সম্পদ ছাড়া কোনো জাতিই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেনা। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের জৈবিক বিষয়গুলির উপর জোর দিতে গিয়ে বা মেকী আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে একটি জাতির যে কতটা ক্ষতি হতে পারে তা আমরা এই পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই অনুভব করতে পারি। সম্রাট ললিতাদিত্য এই ভুলটি করেন নি। তিনি সংস্কৃতিকে উপযুক্ত মর্যাদা এবং অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
[অরেল স্টেইন সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনিই প্রথম [১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে] রাজতরঙ্গিনীর ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে শাদা চামড়ার মানুষেরাই তাই প্রথম তাঁকে Alexander of India বলে শনাক্ত করেন।এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অন্ধকারে ডুবে থাকা আমার স্বদেশ এখন নিজের মণিমুক্তোকেই চিনতে পারেনা। ]
দেখে নিই রাজতরঙ্গিনীতে তাঁর কি কি উল্লেখযোগ্য নির্মাণকার্যের কথা বলা হয়েছে।
১] ৬২০০০ কিলোগ্রামের একটি রোপ্য নির্মিত একটি গগনচুম্বী বুদ্ধমূর্তি।
২] একটি সুবিশাল নরহরি মূর্তি যা শূন্যে ভাসমান ছিল। কিভাবে ? মূর্তিটির মাথার উপরে এবং পায়ের নিচে চুম্বক লাগানো ছিল। ম্যাগনেটগুলিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাচন করা হয়েছিল যাতে এটি সম্ভবপর হয়।
৩] ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি বিষ্ণু স্তম্ভ যার উচ্চতা চুয়ান্ন হাত। এই স্তম্ভের মাথায় একটি গরুড়ের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল।
৪] একটি হাস্যরত কেশব বা কৃষ্ণ মূর্তি [পরিহাস কেশব] । এটি নির্মাণে ৩৬০০ কিলোগ্রাম রূপা ব্যবহার করা হয়েছিল।
৫] ৯৭৯ কেজি সোনা দিয়ে নির্মিত একটি মুক্ত কেশব মূর্তি
৬] সুবিশাল একটি সূর্য মন্দির [মার্তণ্ড মন্দির]
বলাই বাহুল্য এইসব অনন্যসাধারণ স্থাপত্যের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মহার্ঘ্য সোনা রূপা দিয়ে বানানো এই সব নির্মাণ কেন হারিয়ে গেছে তা পাগলেও বুঝবে। তবে কি কিছুই নেই ? না আছে। একটি ধ্বংসাবশেষ। ললিতাদিত্য নির্মিত স্থাপত্যের শেষ নিদর্শন ! সেই সূর্য মন্দির। অনন্তনাগ [ জম্মু এবং কাশ্মীরে অবস্থিত] থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে। ৭২৫ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা এই মন্দিরটি ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন রণাদিত্য নামের এক হিন্দু রাজা। সম্রাট ললিতাদিত্য তা সম্পূর্ণ করেন। কহলন বেশ বিশদেই এই অনুপম মন্দিরটির বর্ণনা রেখেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী জে ডুগুইড নামের এক সাহেব একটি ছবি এঁকে ফেলেন যা বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।
আসুন দেখে নিই কেমন এই মার্তণ্ড মন্দির। কলহন এটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সু উচ্চ মালভূমির উপর নির্মিত এই মন্দিরটি এমন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে সমস্ত কাশ্মীর উপত্যকাটিই এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সমস্ত ঐতিহাসিকেরাই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, গ্রিক, গান্ধার, রোম্যান, চাইনিজ, সিরিয়ান এবং বাইজানটিয়ান স্থাপত্যের সুষম মিশ্রণে এই নির্মাণটি গড়ে ওঠে। স্তম্ভ সজ্জিত প্রাঙ্গনের উপর মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ছিল ২২০ ফিট, প্রস্থ ১৪২ ফিট। রোম্যান স্থাপত্যে ব্যবহৃত পেরিস্টাইল বিন্যাস এবং বৈশিষ্ট্যের এমন সার্থক দৃষ্টান্ত কাশ্মীর তথা ভারতে অত্যন্ত বিরল।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই পেরিস্টাইল [peristyle] স্থাপত্য রীতি বিশ্বের অনেক নির্মাণ প্রাচীন রোম্যান নগর পম্পেই, ম্যানচেস্টারের র্যা্চডেইল আর্ট গ্যালারি, ভার্সেই [ফ্রান্স] শহরের গ্র্যাণ্ড ট্রায়ানন ইত্যাদি নির্মাণে দৃষ্টিগোচর হয়। মূল মন্দিরটিকে বেষ্টন করে চুরাশিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দির ছিল। হিন্দু মন্দির স্থাপত্যরীতি অনুসারে মূল মন্দিরটির প্রবেশদ্বার ছিল পশ্চিমদিকে। চূড়াটি পিরামিড আকৃতির। মন্দিরের দেওয়া খোদাই করা ছিল বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি যেমন বিষ্ণু, গঙ্গা, যমুনা এবং অবশ্যই সূর্যদেব। তাঁকে কেন্দ্র করেই এই মন্দির।
তা এই সূর্য মন্দিরটিকে কে বা কারা ধ্বংস করল ? ঝড় বৃষ্টিতে নিশ্চয় পড়ে যায়নি। এটিও বলতে হবে ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা ইতিমধ্যেই অনুমান করে ফেলেছেন। তবু একটু বিশদে জানিয়ে দিই। আসুন সেই মহান ব্যক্তিটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। সিকান্দার শাহ মিরি ওরফে সিকান্দার ওরফে সিকান্দার বাতসিকান। কাশ্মীরের শাহ মিরি বংশের ষষ্ঠ সুলতান। ১৩৮৯ থেকে ১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীরের এই শাসকটি বাচার অফ কাশ্মীর অর্থাৎ কাশ্মীরের কশাই বলে পরিচিত। তিনি ঠিক কি কি কারণে এই এপিথেট বা বিশেষণটি অর্জন করেছিলেন ? অবশ্যই তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য। কি সেই কর্মকাণ্ড? এই মহান শাসকটি তাঁর সমস্ত শক্তি এবং ক্ষমতাকে একটি উদ্দেশ্যেই প্রয়োগ করেছিলেন। কাশ্মীরের হিন্দুদের কি প্রক্রিয়াতে এবং কত শীঘ্র ধর্মান্তরিত করা যায়। সেই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত পদক্ষেপগুলিই ছিল প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করা [নতুন মন্দির নয় কেন? নতুন মন্দির বানাবে কে ? কার এত হিম্মত?] হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ করা, এমন কি হিন্দু রীতিনীতি অনুযায়ী পোশাক পরিধানও দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য ঘোষণা করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে চরম ঘৃণিত হয়ে ওঠা এই সিকান্দার মিরিই ললিতাদিত্য নির্মিত সেই অনন্যসাধারণ সূর্য মন্দিরটি ধ্বংস করেন।
আর একটু বিশদে যাব নাকি ? এমন মহান শাসক বলে কথা ! তাছাড়া সূত্র সূত্র ছাড়া ধাপর ধাঁই মিথ্যে কথা বলে ফেলছি এমন অভিযোগও তো আসতে পারে। তাই একটু তথ্যসূত্রও ঝালিয়ে নেওয়া যাক, কি বলেন। বিশদে না জানলে বুঝবেন কি করে কেন ললিতাদিত্য মুক্তিপিদাকে পরিকল্পা মাফিক ইতিহাস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ! কাশ্মীর নামক হিন্দু রাজ্যটি কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠল মহান সুলতান সিকান্দার মিরি-র কর্মকাণ্ড না জানলে বুঝবেনই বা কি করে ? হ্যাঁ, এই অবদান বা কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় দাবিদার এই সিকান্দার !
প্রথমেই আসি দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনী নামের সেই বিখ্যাত গ্রন্থটিতে। কি, চমকে উঠলেন ? স্বাভাবিক। না, এটি কলহন লেখেন নি। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে জনরাজ নামক এক সংস্কৃত কবি এবং ঐতিহাসিক কাশ্মীরের আর একটি ইতিহাস লেখেন। নাম দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনী।[ এঁর জন্ম সাল জানা যায়না। তবে আনুমানিক ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। যদিও অকাল মৃত্যু হওয়ায় তিনি এটি শেষ করে যেতে পারেন নি।তাঁর এক ছাত্র শ্রীভারা কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান এবং তৃতীয় রাজতরঙ্গিনীর জন্ম দেন।] দেখে নেওয়া যাক এই দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনীতে সিকান্দারের কি কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধ আছে।ইংরেজি অনুবাদ থেকে উদ্ধৃতি--
"There was no city, no town, no village, no wood, where the temples of the gods were unbroken. When Sureshavari, varaha, and others were broken, the world trembled, but not so the mind of the wicked king. He forgot his kingly duties and took delight day and night in breaking images."
বাংলা তর্জমায় দাঁড়াচ্ছে—“এমন কোনো নগর, শহর, গ্রাম এমন কি জঙ্গলও ছিলনা যেখানে দেব দেবীর মন্দির ভাঙা হয়নি। যখন সুরেশ্বরী, বরাহ ইত্যাদি দেব দেবীর মূর্তি ভাঙা হচ্ছিল সমগ্র পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু এই দুষ্ট রাজার মনে একটুও প্রভাব পড়েনি। তিনি তাঁর নৃপতিসুলভ কর্তব্য বিস্মৃত হয়েছিলেন এবং দিবারাত্র কেবল মূর্তি ভাঙার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেতেন।”
বাহারিস্তান –ই –শাহি [ মধ্যযুগীয় কাশ্মীরের উপর একটি প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল। যদিও এটির রচনাকার আজও অজ্ঞাত। আনুমানিক ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে রচিত এই অমূল্য গ্রন্থটি কাশীনাথ পণ্ডিত নামক এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অনুবাদ করেন। কাশীনাথ বারামুলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে পাঞ্জাব এবং তেহেরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। কাশ্মীরের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার অফ এশিয়ান স্টাডিস-এর অধ্যাপক এবং নির্দেশক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।] নামক একটি অমূল্য ঐতিহাসিক দলিল বলছে--
"Towards the far end of his life, he (Sultan Sikandar) was infused with a zeal for demolishing idol-houses, destroying the temples and idols of the infidels. He destroyed the massive temple at Beejbehara. He had designs to destroy all the temples and put an end to the entire community of infidels,"
সুলতান সিকান্দার মন্দির, দেবস্থান, মূর্তি ধ্বংসের ব্যাপারে অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তিনি বীজবেহারা নামক স্থানে একটি সুবিশাল মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল সমস্ত মদির, দেবস্থান ধ্বংস করে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কেই নির্মূল করে দেবেন।
হাসান নামক এক মুসলিম ঐতিহাসিক লিখছেন--
"Hindus were forcibly converted to Islam and were massacred in case they refused to be converted'।----"And Sikandarpora (a city laid out by Sultan Sikandar) was laid out on the debris of the destroyed temples of the Hindus. In the neighbourhood of the royal palaces in Sikandarpora, the Sultan destroyed the temples of Maha-Shri built by Praversena and another by Tarapida. The material from these was used for constructing a 'Jami' mosque in the middle of the city."
হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হত । অস্বীকার করার অর্থই নির্মম গণহত্যাকে আমন্ত্রণ জানানো। হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ফলে উৎপন্ন ইট, কাঠ, মূর্তি, পাথর ইত্যাদি তিনি সিকান্দারপুরের [তাঁর নামে নির্মিত একটি শহর] পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। সিকান্দারপুরের আশেপাশে যে মন্দিরগুলি তিনি ধ্বংস করেছিলেন সে দুটি হল প্রবরসেনের নির্মিত মহাশ্রী মন্দির, এবং তারাপিদা মন্দির। এই মন্দির দুটি থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়েই তিনি শহরের মধ্যস্থলে জামি মসজিদ নির্মাণ করেন।
ঐতিহাসিক অজিত ভট্টাচার্য্য [নির্ঘাত নাম শোনেন নি। শুনবেন কি করে ! যেখানে যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিকদের হাপিস করে দেওয়া হয়েছে, অজিত ভট্টাচার্য্য তো নস্যি। এই সংকলনেই যদুনাথ সরকার এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের ইতিহাস ভাবনা এবং তাঁদের কেন স্বাধীন ভারতের ইতিহাস নির্ঘণ্ট থেকে সুপরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হল সে বিষয়ে একটি বিশদ আলোচনা আছে।] তাঁর kashmir, the wounded Valley [UBS publishers, 1994] শীর্ষক গ্রন্থটিতে লিখছেন "Sikandar (1389–1413) equaled the most blood-thirsty and iconoclastic Muslim conquerors anywhere in his zeal to obliterate all traces of the Hindu religion and convert its followers to Islam on pain of death. Temples were leveled and some of the grandest monuments of old damaged and disfigured. Thousands of Hindus escaped across the borders of Kashmir, others were massacred."
সিকান্দার [১৩৮৯ থেকে ১৪১৩] চরম রক্তপিপাসু এবং অত্যন্ত অত্যাচারী মুসলিম বিজেতাদের অন্যতম ছিলেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য এবং আবেগ –হিন্দু ধর্মের সমস্ত চিহ্নকে চিরতরে নির্মূল করে ফেলা। সমস্ত হিন্দুদের পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করা। অসংখ্য মন্দিরকে তিনি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, অনেক ঐতিহ্যবাহী, অতুলনীয় প্রাচীন নির্মাণকে তিনি ধ্বংস এবং বিকৃত করেছিলেন। হাজার হাজার হিন্দু কাশ্মীরের সীমানা অতিক্রম করে পালিয়ে আসে। যারা পালাতে পারেন নি, নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছেন।”
এবার নিশ্চয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা কিভাবে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর নামক হিন্দু রাজ্যটি একটি মুসলমান প্রদেশে রূপান্তরিত হল।
ললিতাদিত্যের সূর্য মন্দিরটি কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল তার একটি বর্ণনাও তাঁর বইটিতে পাওয়া যায়।
"Hindu temples were felled to the ground and for one year a large establishment was maintained for the demolition of the grand Martand temple. But when the massive masonry resisted all efforts, the fire was applied and the noble buildings cruelly defaced."
হিন্দু মন্দিরগুলি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সুবিশাল মার্তণ্ড মন্দিরটি [সূর্য মন্দির] ধংস করার উদ্দেশ্যেই দীর্ঘ এক বছরের জন্য একটি দপ্তর গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত মজবুত এই মন্দিরটি ভেঙে ফেলার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল, তখন বিধ্বংসী আগুন প্রয়োগ করা হল। এইভাবে এই মহান স্থাপত্যটিকে ধ্বংস এবং বিকৃত করা হয়েছিল।
নিজেকে প্রশ্ন করুন। ললিতাদিত্যকে ইতিহাসের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই সিকান্দারের প্রসঙ্গটিও চলে আসতে বাধ্য। কারণ ললিতাদিত্যের উজ্জ্ব্বলতম সৃষ্টিকে তিনিই ধ্বংস করেছিলেন। তাতে কাদের সমস্যা একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন। [এই রাজ্যেরই একটি [১৯৮৯ সালে জারি হয়েছিল] সার্কুলারে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মুসলিম শাসকদের দ্বারা মন্দির ধ্বংস, ধর্মান্তর, হিন্দুদের উপর অত্যাচার ইত্যাদি কোনো পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ করা যাবেনা। এ বিষয়ে বিশদ তথ্য এবং আলোচনা এই গ্রন্থের অন্য একটি প্রবন্ধে করা হয়েছে]
স্বনামধন্য, শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত মোহম্মদ মুজিব [ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর]বলছেন, “Sikandar, the iconoclast of Kashmir, made forcible conversions a sustained political policy.”
“ সিকান্দর নামক বিধ্বংসী অত্যাচারী শাসকটি বলপূর্বক ধর্মান্তকরণকে একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক নীতিতে পরিণত করেন।”
প্রখ্যাত পার্সি ঐতিহাসিক ফেরিস্তা [১৫৬০—১৬২০] তাঁর তারিখ-ই-ফেরিস্তা রচনাটির দশম খণ্ডে কাশ্মীরের উপর যে মূল্যবান পর্যবেক্ষণ রেখেছেন সেখানেও এই অত্যচারী সিকান্দার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আলোচনা আছে। তিনি লিখছেন--
"Many of the Brahmans rather than abandon their religion or their country poisoned themselves, some emigrated from their homes while a few escaped the evil of banishment by becoming Mohamadans."
অসংখ্য ব্রাহ্মণ হয় তাঁদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলেন, অথবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এবং অনেকেই শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
শ্রীরাম বক্সির Kashmir Through Ages এ বিষয়ে আর একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। এখানেও তিনি একই পর্যবেক্ষণের প্রতিধ্বনি রেখেছেন। সিকান্দার সম্পর্কে তিনি কি বলছেন ?
He made it his business to demolish Hindu temple and convert Hindus by force. Hindus had to flee in order to preserve their religion.
অর্থাৎ হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা এবং বলপূর্বক ধর্মান্তকরণকে তিনি [সিকান্দার] রাজনৈতিক নীতি তথা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নিজের ধর্ম বাঁচাতে চাইলে কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা।
ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল তো ? কিভাবে একটি হিন্দু রাজ্য প্রায় রাতারাতি মুসলিম জনপদে রূপান্তরিত হয় ? কেবল কাশ্মীর নয় এদেশ তো বটেই সমগ্র বিশ্বেই এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। যে হাত এখন সেনা বাহিনীর দিকে অহরহ পাথর ছুঁড়ে চলেছে, সেই হাতই একদিন পৈতা ধারণ করে কুল দেবতার উদ্দেশ্যে পবিত্র বারি সিঞ্চন করত !
কি বুঝলেন ? প্রিয় পাঠক আপনিও নিশ্চয় তথাকথিত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের মত ভাবছেন না মুসলমান মানেই ধর্মান্ধ, অত্যাচারী, হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্মূল করার মন্ত্রে দীক্ষিত। এই ভ্রান্ত ধারণাটি দেশ এবং জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বড়সড় বাধা হয়ে উঠতে পারে। মোহম্মদ মুজিব, হাসানের মত অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান এদেশের সম্পদ। তাঁরা ধর্মান্ধতা নয়, শিক্ষা এবং সচেতনতাতেই বিশ্বাস রাখেন। তবে এদেশের ইতিহাসকে কেন বিকৃত করা হল ? মুজিবের মত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতামতও গুরুত্ব পেলনা। উত্তরটি খুব সোজা। মুসলিম সম্প্রদায়ের মৌলবাদী অংশটিকে খুশি করা এবং হাতে রাখাই অন্যতম উদ্দেশ্য। এরাজ্যের সার্কুলারে তারই প্রতিফলন। কিন্তু এতে কি দেশের মঙ্গল হচ্ছে ?ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে গিয়ে দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকেই যদি যূপকাষ্ঠে চড়ানো হয়, সে জাতির ভবিষ্যৎ কি ?
কিন্তু ললিতাদিত্যের কি হল? কিভাবে তাঁর দেহাবসান ঘটল ? আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তুলনীয় এই মহান সম্রাটকে সরিয়ে দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অশোককে কেন এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ঘোষণা করা হল ? তাঁর সম্পর্কে যা পড়ানো হয়, সবই কি সত্য ? অশোক সম্পর্কের জানার প্রধান মাধ্যমই হল তাঁর স্বনির্মিত শিলালিপি, এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র। সেখানে কতটা নিরপেক্ষ ইতিহাস পাওয়া সম্ভব। বৌদ্ধ শাস্ত্র তাঁকে মহান বলবে [বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর] সেটিই তো স্বাভাবিক। চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হয়ে ওঠা একটি রোমাঞ্চকর উপন্যাস নয় তো ? নিজের উদ্যোগে নির্মিত শিলালিপিতেই বা তিনি কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন ? অথচ ললিতাদিত্যের মৃত্যুর প্রায় পাঁচশ বছর পরে লেখা [দ্বাদশ শতাব্দী] রাজতরঙ্গিনীকে কেন প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হলনা। ইতিহাস রচনার জন্য মুক্তিপিদার আত্মা কি তাঁকে ঘুষ দিতে এসেছিলেন? [যা এদেশের অনেক ঐতিহাসিকই পেয়ে থাকেন] নাকি অশোক অহিংসার পথ নিয়েছিলেন বলেই কি এই সম্মান ? কিন্তু একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কি অহিংসা নীতির উপর ভর করে টিকে থাকতে পারে ? যেখানে আমেরিকার মত দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতীক ভয়ংকর এক ঈগল পাখি, শ্রীলংকার আক্রমণে উদ্যত সিংহ, সেখানে এদেশে শান্তির অশোক স্তম্ভ কি কেবল প্রগতির প্রতীক হিসেবেই কাজে লাগানো হয়েছিল ? বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীকেই শান্তিকামী, এদেশের সংবিধানের রূপকার [যদিও বাস্তবে তা নন] আম্বেদকরও বৌদ্ধ ছিলেন। এখানে কি কোন যোগসূত্র কাজ করেছিল ? প্রখ্যাত একটি গবেষক সংস্থার সভাপতি রজনীশ কুমার শুক্লা যখন ঐতিহাসিক ললিতাদিত্য সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, ইরফান হাবিবের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ?প্রশ্নের শেষ নেই। পরবর্তী পর্বে উত্তর খোঁজার প্রয়াস করব। জানিনা সেই সংবেদনশীল আলোচনাটি ফেসবুকে দিতে পারব কিনা। তবে চিন্তা কি ! প্রিয় পাঠকের জন্য পরের বইটি প্রায় প্রস্তুত। দেখা যাক।
বি. দ্র - মহান ললিতাদিত্যকে কেন্দ্র করে এটিই প্রথম পর্ব। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্ব সহ বিস্তৃত, পরিমার্জিত, তথ্যবহুল সামগ্রিক আলোচনাটি অমৃতস্য পুত্রাঃ নামক বইটিতে প্রকাশিত হয়। আপনাদের ইতিহাস মনস্কতার কারণেই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ সম্ভব হয়েছে।
✍️ দেবাশিস লাহা
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................