দাদাবাবুরা রাস্তা মাপেন :
----------------------------
বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এক জগাখিচুড়ি ইসলামী “কর্পোরেট কালচার” বা “মডারেট ইসলাম” চালু হয়েছে ! এই কালচারের অনুসারী মুসলিমরা অকৃতিম ইসলামকে নতুন মোড়কে পেশ করছে । মেয়েদের আপাদমস্তক পর্দা না করে শালীনভাবে শাড়ী বা সালোয়ার কামিজ পরলেই হবে । ভিন্ন ধর্মের বন্ধুদের সাথে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগদান করা । তারা ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় টাইপের বুলি মুখে! এরা সাধারণত দিনে হয়তো একবার নামাজ পড়ে, শুক্রবার দুপুরে-শবে বরাত-শবে মেরাজের রাতে খুব গম্ভীরমুখে নামাজ পড়তে যায় । জাকির নায়েক-হারুন ইয়াহিয়া’দের ব্যাপারে আপাত উদাসীন । তাদের কথা : ইসলাম খুবই শান্তির ধর্ম কিন্তু আধুনিকভাবে মানতে হবে । “আধুনিক” মানে পুরোনো মদ নতুন বোতলে। সবশেষে “ধর্মীয় মৌলবাদ” ইসলামের মূল শত্রু !! গুটিকয় পথভ্রষ্ট “কট্টর” মুসলিমের জন্য পুরো ইসলামকে দোষারোপ করা ঠিক না ! কিন্তু ব্যাপারটা আদতেই তা নয় । অকৃতিম ইসলামের বৈজ্ঞানিক কিতাব কোরান বলে:
১.’হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের (ইহুদি ও খ্রীষ্টানদের) অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যালিমদের পথ দেখান না। (আল কোরআন, ৫ : ৫১)’।
২.’মুমিনগণ যেন মুমিন ব্যাতিরেকে অন্য কোনো অমুসলিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমন করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। (আল কোরআন, ৩ : ২৮)।
৩.’আর তাদেরকে হত্যা করো যেখানে পাও সেখানেই এবং তাদেরকে বের করে দাও সেখান থেকে… (আল কোরআন, ২ : ১৯১)’।
৪.’আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই করো, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। (আল কোরআন, ২ : ১৯৩)’।
জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্ব অনু্যায়ী বাংলাদেশ তো হিন্দুদের দেশই না ! মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে এই ধারণা থেকে বাংলাদেশ তৈরী হয়নি, তবে “আদিরূপ” পাকিস্তান কিন্তু এই তত্ত্বেরই সন্তান। হিন্দুরা বাংলাদেশে বহুলক্ষেত্রে মানসিক কষ্টে থাকতে থাকতে অনেক সময় বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে । ধর্মনিরপেক্ষ এইদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম!! তার মানে কি হিন্দুরা এদেশের মুসলিমদের সমান
না ? সংবিধানের শুরুতে আছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”। একজন হিন্দু বা ভিন্নধর্মী কেন এই সংবিধানকে মেনে নেবে ? সরকারী টিভি’তে অধিবেশনের শুরুতে আল কোরআন’এর তর্জমা হয়; অথচ বাকি ধর্মগ্রন্থের আলোচনা হয় তিনদিনে একবার। সরকারী বাংলা বইয়ে কেন “মরূ ভাস্কর” বা হযরত মুহাম্মদ (সা)’এর জীবনীসহ অন্যান্য ইসলামী কাহিনী থাকবে ? একটা ক্লাস ফোরের হিন্দু ছাত্র তার বাংলা পরীক্ষায় কেন “পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ” :প্রশ্নের উত্তরে “হযরত মুহাম্মদ ” উত্তর দেবে ? হিন্দুরা খুব খারাপ কারন তারা বাংলাদেশকে নয় বরং ভারতকে কে নিজের দেশ ভাবে । বেশ, মেনে নিলাম ! স্কুল পোষাকের একটি জরুরী অংশ টুপি । হিন্দুরা মাথায় টুপি দেয়না সমাবেশে’র জন্য যখন মাঠে একসাথে দাড়ায় ছাত্ররা তখন হাতে গোনা হিন্দু ছাত্রদের খুব সহজেই আলাদা করা যায় ! কিছু শিক্ষক নামে কলংক প্রতিদিনই তাদের অপমান করে: “কিরে তুই হিন্দু নাকি? টুপি কই?” বা “তোদের জন্য আলাদা লাইন লাগবে”। হয়তো বা খেলার মাঠে শুনতে হয়:“দাদাবাবু এদেশ ছাড়। এটা তোদের দেশ না !!”
ছোটবেলা থেকে এরকম ব্যাবহার পেলে কিভাবে একটি জন্মসূত্রে হিন্দু শিশু নিজেকে এদেশের মানুষ ভাববে? হিন্দুরা নাকি ব্যবসা করে বাংলাদেশে কিন্তু বাড়ি কেনে ভারতে। টাকা জমায় ভারতে !! বাংলাদেশের অনেক হিন্দুদের আত্নীয়-স্বজন দেশভাগ বা একাত্তরে ভারতে চলে গেছে। অনেকেই নিজের আপনজনদের কাছে পেতে ভারতে চলে যায় । বাংলাদেশে বসবাস করায় ঝামেলা মনে করে বলেই তারা ভারতে যায়, এটা তেতো সত্য!। হিন্দুর যদি পান থেকে চুন খসে, আর কোন বাছ-বিচার নেই ! সাথে সাথে ‘–উন কা বাচ্চা, কাভি নেহি আচ্ছা’। আচ্ছা এই মনোভাবের মধ্যে আপনার থাকতে ভাল লাগবে ? ১৯৪১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ ভাগ ছিলো হিন্দু। ভারতভাগ নামক সার্কাসের পর ২২ ভাগ। পাকিস্তানেই ২৩ বছরে নেমে ১৩.৫ ভাগে। এরপর বিএনপি-জামাত জোটের কল্যানে ৮ ভাগের কাছাকাছি। অনেক মেধাবী নামকরা ভারতীয় হিন্দু আছে যারা বর্তমানে সারা বিশ্বে সম্মানিত, অথচ তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের অধিবাসী ছিলো! ভাবুন কতটা লজ্জার !! ছিঃ ছিঃ। মুমিনরা যদি মুমিনগিরি না করতো তাহলে এই সকল মানুষকে নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারতো আজ ! কিন্তু না ! তারা যে মুসলমান আগে, মানুষ পরে ! ১৯৭১ এর কথা আসলে অনেক মুসলিম বলে “যুদ্ধের সময় হিন্দুরা ভারতে ভাগছে”। যুদ্ধের সময় প্রায় ৮০ লাখ বা তারও বেশী মুসলিমও “ভারতে ভাগছে” !! দুই পাকিস্তানের “সাচ্চা মুসলিম”রা না ভাগলে ছাড়তো ? গুজরাটে’র দাঙ্গায় মুসলিম হত্যা হয়েছে ! ব্যাস ! হিন্দু মার । আর ২০০১-০২ সাল তো সবকিছুকে হার মানায়। শুধুমাত্র হিন্দু হবার অপরাধে দক্ষিনবঙ্গের জেলাগুলোয় কি হয়নি ? খুন-লুন্ঠণ এবং সেইসাথে ইসলামের সবচেয়ে প্রিয়কর্ম ধর্ষণ, সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল! এক হাজারের বেশী ধর্ষণ হয়েছিলো যার মধ্যে শিশু ধর্ষণ , মা-মেয়ে-পুত্রবধূ কে এক বিছানায় গণধর্ষণের ঘটনাও ছিলো। মহানবী হযরত মুহাম্মদ নাকি বিধর্মীদের অত্যাচারে হিযরত করেছিলেন, কিন্তু হিন্দুরা মুসলিমদের অত্যাচারে দেশ ছাড়লে বিরাট দোষ !! ভারতে হিন্দুরা কেউ শখে যায়না ! আর ভারত সরকারও বাংলাদেশ থেকে খেঁদানো হিন্দুদের সাদরে আপ্যায়ন করে নেয় না !!
সুরঞ্জিত সেন দুর্নীতির দায়ে ধরা পরার পর দেখা গেলো তার মন্ত্রনালয়ে নিয়োগ পাওয়া সকলেই হিন্দু। ব্যাস !! “দেখলা তো, হিন্দুরা খালি নিজেদের ভালো বোঝে”। হিন্দুরা ক্রিকেটে ভারত সাপোর্ট করে কিন্তু সব মুসলিম পাকিস্তান করেনা। এই কথাটা আরেকটা ধ্রাস্টামি ! অলি-গলিতে, মসজিদে-ময়দানে ওয়াজ মাহফিলে উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে হিন্দু ধর্ম নিয়ে, এমনকি দেব-দেবীদের কাপড়-যৌনতা নিয়ে যে অসুস্থ আলোচনা হয় তা একজন হিন্দু ধর্মালম্বী সহজভাবে নেবে ?? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাদ পরছে না। এ টি এন বাংলা চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানের আলোচক মাওলানা তারেক মুনাওয়ার বলেছে: “এই বাংলাদেশ শাহজালাল-শাহপরানের দেশ, কাজী নজরুলের দেশ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুইর্যা’র দেশ না”। যে ব্যাক্তি বাংলা সাহিত্যকে ১০০ বছর এগিয়ে দিয়েছেন তিনিও ধর্মের কাছে রেহাই পাচ্ছেন না !!
এদেশের খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধদের চেয়ে হিন্দুরা অনেক বেশী নির্যাতিত! একটাই কারন ধর্ম। যা কোনদিন সকল মানুষের মাঝে সম্প্রীতি আনতে পারেনি, পারবেওনা। এই পৃথিবীতে ধর্মের কারনে যত যুদ্ধ-হত্যা-লুন্ঠন-ধর্ষণ হয়েছে অন্য কোনো কারনে তার সিকিভাগও হয়নি !
তাই বাংলাদেশের ‘দাদাবাবু’ রা এবার ভালোয় ভালোয় রাস্তা মাপেন, তবেই রক্ষে...........
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................