২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারের স্মারক চুরি হয়ে গিয়েছিল । তখন সারা ভারতে হৈচৈ পড়ে যায় । মনে হয়, চুরিটা অনেক আগেই হয়েছিল ; কর্তৃপক্ষ নিজেদের অপদার্থতা চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, তাই চুরি ধরা পড়েছিল দেরিতে ।
মহামূল্যবান সেই স্মারকটি চুরি কে বা কারা করেছিল কিংবা সেটি কোথায় ছিল- সে সম্বন্ধে সংবাদমাধ্যম ঠোঁট সেলাই করে রেখেছিল । কিন্তু ভাসা ভাসা একটা খবর শুনেছিলাম যে, স্মারকটি নাকি আমাদের এই বাংলাদেশে চলে এসেছে । প্রথমে বিশ্বাস করি নি ; ভেবেছিলাম, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে উল্টোপাল্টা বকছে ।
তারপর একটু 'ইন্টারনেট' ঘাঁটলাম । তখন জানলাম, ঐ লজ্জাজনক ঘটনার সঙ্গে সত্যিই বাংলাদেশীরা জড়িত আর পালের গোদার নাম মোহম্মদ হোসেন শিপলু । সে ইটালির বাসিন্দা । তার বাবা আবুল হোসেন ঢাকার গুলশানের পশ এলাকার একটি হস্তশিল্প দোকানের মালিক । আবুল হোসেন প্রাচীন মূল্যবান বস্তুর চোরাকারবারী করত । সংবাদমাধ্যম এটাকে ছিঁচকে চোরের কাজ বলে প্রচার করেছিল । কোথায় জানালা ভাঙা, কোথায় পাঁচিলের ধারে কাদামাখা হাওয়াই চটির ছাপ ইত্যাদি লিখে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল ।
আসলে এর পিছনে বড় বড় রাঘব বোয়ালও ছিল । চোর স্মারকটি চুরি করে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে গলিয়ে দিয়েছিল । সে হয়ত ভেবেছিল, এর দ্বারা রবি ঠাকুরের নোবেল জয়ের ইতিহাস মুছে দিতে পারবে । কিন্তু ভারতের গোয়েন্দাবিভাগ চুপ করে থাকেনি । তদন্ত করে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পেয়েছিল তারা । পরে তারা সব তথ্য দিয়ে বাংলাদেশকে চিঠি লিখেছিল । এর ফলে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের প্রশাসনের সদস্যরা মোহম্মদ হোসেন শিপলু এবং তার বাবা আবুল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল এবং আবুলের গুলশানের সেই দোকান তল্লাশি করে অনেক চুরির মাল পেয়েছিলেন । সেখানে কেবল সেই নোবেল পুরস্কারের স্মারক নয়, গুরুদেবের আরও অনেক মূল্যবান স্মারক পাওয়া গিয়েছিল ।
তারা অবশ্যই আর্থিক লাভের জন্য চুরি করে নি । কিংবা মূল্যবান স্মারক সংগ্রহের জন্যও চুরি করে নি । তাহলে স্মারকটা গলিয়ে দিত না । একটা নোবেল পুরস্কারের স্মারকে মোটামুটি ১৭৫ গ্রাম সোনা থাকে । ঐ সোনার জন্যও নিশ্চয় এই উদ্যোগ নেয় নি ।
আমার বিশ্বাস, বিশ্বভারতীর বাস্তুঘুঘুরাও এর সঙ্গে জড়িত । তারা মোটা টাকার বিনিময়ে ঐ স্মারক তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল । শিপলুর দল উত্তরায়ণের সংগ্রহশালায় ঢুকে স্রেফ সব কিছু উঠিয়ে নিয়েছে । ভাঙচুরের ঘটনা পরে সাজানো হয়েছিল ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে দুষ্ট লোকের আধিপত্য দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল । তারা ক্ষমতাবলে যথেচ্ছ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল । তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্রাট দেবব্রত বিশ্বাসের গান রেকর্ড করা বন্ধ করে দিয়েছিল নিজেদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে । তারা বেশ কিছু হিন্দি চলচ্চিত্রে গুরুদেবের সুর বিক্রি করেছিল (অমিতাভ বচ্চনের, ইয়ারানা উল্লেখযোগ্য), যেন গুরুদেবের সুর তাদের বাপের সম্পত্তি ।
অনেকদিন আগে বিশ্বভারতীর এক সময়ের উপাচার্য নিমাইসাধন বসুর লেখা 'ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী' বইটি পড়ে আমার শান্তি নিকেতন-বিশ্বভারতী নিয়ে শৈশব থেকে মনের মধ্যে গড়ে তোলা স্বপ্ন আস্তে আস্তে মিলিয়ে গিয়েছে । দেবব্রত বিশ্বাসের কথা তার নিজের বয়ানে জানতে হলে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর 'গান আমার পড়ে পাওয়া ধন' শুনতে পারেন ।
ঐ অসাধু লোকেরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত লেখার সুবিধা নিজেরা ভোগ করছিল । এমন কি সমস্ত নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সুবিধা খাচ্ছিল । অথচ তারা কেউ রবীন্দ্রনাথের রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয় । এই সব লোকেদের বদমাইশির এক চরম পর্যায়ে নোবেল পুরস্কারের স্মারকটি চুরি হয়ে যায় ২০০৪ সালে ।
কোহিনূর হীরে ব্রিটিশরা তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল বলে এখনও অনেকে হাহাকার করেন । কিন্তু রবি ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারের স্মারক চুরি নিয়ে কেউ হাহাকার করেছেন বলে জানা নেই ।
(সৌজন্যে)
Razik Hassan
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................