বলা হয়ে থাকে 'সিক্সটি ফোর'-এর দাঙ্গা। কিন্তু ওটা দাঙ্গা ছিল না, ছিল পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিত 'হিন্দু নিধনযজ্ঞ'। 'কাশ্মীরের হযরত বাল মসজিদ থেকে নবীর চুল চুরি হয়ে গেছে' - এই গুজব ছড়িয়ে দিয়ে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান, বিশেষ করে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের হিন্দুদের মেরে-কেটে-নারী ধর্ষণ করে-সর্বস্ব লুটে নিয়ে অস্তিত্বহীন করে দেওয়া হয়।
চৌষট্টির সেই হিন্দু-জেনোসাইড সারভাইভার, ঢাকার এক হিন্দু ভদ্রলোক আমার নিকটতম প্রতিবেশী। তার মুখে শুনেছি, ঢাকার শহরতলীতে ছিল তাদের যৌথ পরিবার। তিনি কেবল তখন স্কুলে যেতে শুরু করেছেন। তার মা,জেঠি ও কাকিরা মিলে বাড়ির ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে একদল সশস্ত্র লোক 'আল্লাহুআকবার' - বলে চিৎকার দিয়ে বাড়িতে ঢুকে, পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে যা করেছে, তা ভাষায় বর্ণনাযোগ্য নয়। ওই ভদ্রলোক ভয় পেয়ে প্রথমেই খাটের নিচে ঢুকে লুকাতে পেরেছিলেন বিধায়, প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। অন্য সবার শরীর দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে; এমনকি নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করার পরেও তাদের বেঁচে থাকতে দেওয়া হয়নি। ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে পারিবারিক দোকানে গিয়ে দেখেন, তার বাবা,জ্যাঠা ও কাকাদের ছিন্নমস্তক মাটিতে পড়ে আছে;দোকানে কোন মালামাল নাই,সব লুট হয়ে গেছে। সেই বীভৎস নরকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া ভদ্রলোকটি কিন্তু ভীষণ সেক্যুলার। মন্দিরে যা দান করেন, তার তিনগুণ দান করেন মসজিদ-মাজার-মাদ্রাসায়।
হিন্দুদের পাঁচ টাকা দিলে, মুসলমানদের কুড়ি টাকা দিয়ে সবাইকে ডেকে দেখিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা জাহির করেন।
ভদ্রলোক প্রথমদিকে ছিলেন অন্ধ কংগ্রেস সমর্থক, পরবর্তী সময়ে হয়ে যান তৃণমূল-ভক্ত। আমি বঞ্চিত-প্রতারিত-অত্যাচারিত হিন্দুর পক্ষে কথা বলি, তাই আমাকে হরহামেশা 'সাম্প্রদায়িক' বলে তিনি কটুক্তি করতেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-জোট বিজয়ী হওয়ার পরে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকদের সঙ্গে মিলে, আমার সাথে এমন আক্রমণাত্মক ভাষায় তর্ক-বিতর্ক করেন,আমি তাতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাই। আমি নিরুপায়। ভোরবেলা উঠে তার মুখ দেখতে হয়, এজন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি,'তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন' - এই অমোঘ আপ্তবাক্য স্মরণ করে তার সঙ্গে রোজ হাসিমুখে কথা বলি। ভদ্রলোক ইহুদিদের অশালীন ভাষায় গালি দেন, অথচ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের হিন্দু নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে বলেন,"দাদা,হগল ধর্মই সুমান, কিছু খারাপ মাইনষের লাইগা মুসলমানগের বদনাম হইবার লাকচে। হগোল অশান্তির মূলে হইলো গিয়া ইহুদী-নাছারাগো নোংরা ষড়যন্ত্র। এইযে দেখতাছেন না লাদেন-ফাদেন, এগুলান হইলো গিয়া এম্রিকার এজেন্ট ..."
আমি বলি,"দাদা,আপনি যে ঢাকা থেকে সব হারিয়ে শুধু প্রাণটা হাতে নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, সেটাও কি ইহুদী-নাছারা- আমেরিকার ষড়যন্ত্রের কারণে?"
ভদ্রলোক পরিণত বয়সে হঠাৎ করে অনেক টাকা পয়সার মালিক হয়ে যান। তিনি গর্ব করে বলে বেড়ান,আমি বিজনেস পারপাস কোন হিন্দুরে সাহায্য করতাম না, আমার চোক্ষে হিন্দু-মুসলমান কোন তফাৎ নাই ..."
আমি বলতাম,"যদি তাফাৎই না থাকে, তাহলে একচেটিয়া মুসলমানদের সাহায্য করছেন কেন! দুস্থ হিন্দুদেরও কিছু সাহায্য করুন।"
ভদ্রলোক বলতেন,"হিন্দু-মুসলমান কি মাইনষের ছরীলে লেকা আছে নি, চামড়া ছিল্লে হক্কলের রক্তই লাল।"
ক্ষমতাসীন দলের এক যণ্ডা প্রকৃতির মুসলিম যুবককে, অতিরিক্ত ব্যবসায়িক আস্কারা দিতে দেখে, আমি তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম।
ভদ্রলোক আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন,"দাদা আমি আপনার লাহান সাম্প্রদায়িক না,বুঝবার পারছেন নি।"
আমি না বুঝলেও ভদ্রলোক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলেন অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই - যুবকটির ভয়ে ভদ্রলোক বেশ কয়েক মাস পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। যুবকটি ভদ্রলোকের সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য তাকে খুন করতে, হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
দুশ্চিন্তায় ভদ্রলোকের হার্টে গুরুতর সমস্যা হয়। সিঙ্গাপুর গিয়ে হার্টের চিকিৎসা করাতে ভদ্রলোকের বহু অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। তবুও ভদ্রলোকের চেতনা ফেরে না; বিধর্মীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে যা তা ভাষায় গালিগালাজ করেন।
গতবছর হঠাৎ করে তিনি একদিন আমার হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে, চা দিয়ে আপ্যায়ন করে, অত্যন্ত মোলায়েম ভাষায় বললেন,"দাদা,আপনারে অনেক ছোময় অনেক ধরনের কথাবার্তা কইচি,আপনি কোলোম আমার উপরে কোন রাগ রাইখেন না; ক্ষমা কইরা দিয়েন। বয়স হয়া গ্যাছে গা,কোনসম মইরা যাই, হ্যায়া ঠিকনাইক্কা..."
আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, ভদ্রলোক অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন, "... দাদা, আমিত শাহ - নরেন্দ্র মোদি কলাম কামের কামডা কইরা ফালাইছে। এই যে আইনডা(CAA) করচে না,এখন থিকা আমরা বৈধ নাগরিকত্ব পায়া গেলাম গা... উনারা(সেক্যুলার) আমাগের নাগরিকত্ব দিবোনা; উনারা চিল্লায়া মরতাছে কাগো লাইগা জানেন,ওই যে রোহিঙ্গা-পোয়িঙ্গা আছে না, মানে যে মিঞাছাবরা জোর কইরা ডুকছে, তাগো নাগরিকত্ব দেওয়নের লাইগা উনারা জান কুরবানী দিবার লাগছে ...ওরা যদি ফের পাওয়ারে আইবারর পারে, আমাগের পাছায় লাত্থি মাইরা দেশ থিকা বাইর কইরা দিবো,বুঝছেন।... এত বছর ধইরা ওনাগের দুধ দিয়া আইলাম, তারপরও কয় আমরা নাকি দুধ দেই না; ব্যেবাক দুধ দেয় নাকি মিঞাছাবরা। ঠিক আছে আপনারা আপনাদের দুধেল গরুগুলা লিয়াই থাকেন..."
এজন্যই বলি,নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো মতভেদ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অনেকে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয়। এটা ঠিক নয়। আমাদের পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করে যদি আমরা একে অপরের অন্তরে আঘাত দেই, তাহলে যে আঘাতপ্রাপ্ত হবে,তার জেদ চেপে যাবে; সে নিজের নাক কেটে স্বজাতির যাত্রা ভঙ্গ করতে - শত্রুকে সাহায্য করবে।
কৃত্তিবাস ওঝা
২৫-০৭-২০২০খ্রিঃ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................