ইতিহাস নির্মম নয়, অবিবেচক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের নামটি তাই অস্পষ্ট।

(তাজউদ্দিন আহমদের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি)

লুঙ্গির উপর সাদা ফতুয়ার মত শার্ট, কাঁধে রাইফেল, কোমড়ে পিস্তল গোঁজা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাবার আগে স্ত্রীকে বলে গেলেন, ‘তোমরা কি করবে কর, আমি চলে গেলাম…’।

বাংলাদেশের জন্ম যদি একটা রূপকথা হয় তাহলে সেই রূপকথার রাজকুমার তাজউদ্দীন আহমদ। এক পোশাকে রাতের অনিশ্চিত অন্ধকারে তাজউদ্দীন বেরিয়ে পড়লেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের প্রাইভেট কারে চড়ে প্রথমে গা ঢাকা দিলেন। তারপর নানা চড়াই উতড়াই পেরিয়ে পৌঁছালেন বার্ডার এলাকায়। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষিদের কাছে সংবাদ পাঠানো হলো। সাহায্যের আবেদন করা হলো। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষির পূর্বাঞ্চলের প্রধান গোলক মজুমদার পরে স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই রণযাত্রীর পরনে ছিলো ময়লা লুঙ্গি-জামা। পায়ে মাটিকাঁদা লাগানো ছেড়া রাবারের স্যান্ডেল…।

তাদেরকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার জানিয়ে ভারতে প্রবেশ করানো হয়। শুরু হয় এক অভূতপূর্ব ইতিহাসের মহেন্দ্রক্ষণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তাজউদ্দিন জানান তার ‘বাংলাদেশের’ আদর্শ, পরাষ্ট্র নীতি, আবেদন করেন সহায়তার। ভারতকে সহায়তা করার আবেদন অবশ্য ১৯৬২ সালেই একবার করা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু লোক মারফত ভারতের কাছে সহায়তা চাইলে সেসময় ভারত আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দুইদিন আগে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার কেসি সেনগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে ১৭ মার্চ আবার সাক্ষাৎকালে মুক্তি সংগ্রাম চলাকালে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেবার বিষয়ে আলাপ হয়। কিন্তু তখন ভারতে সাধারণ নির্বাচন চলায় আলোচনা কোন সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টারা সকলেই বিপ্লবী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তাজউদ্দীনের রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে পড়া ছিলো তাই পূর্ব প্রস্তুতি। কথা ছিলো ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গা ঢাকা দিবেন বিপ্লবী সরকার পরিচালনা করতে। কিন্তু সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে তাজউদ্দীন দেখলেন একদম অন্য এক বঙ্গবন্ধু। হাতে লেখা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও টেপরেকর্ডারে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে আত্মগোপনে চলে যাবে তাজউদ্দীন ও বঙ্গবন্ধু, সে কথা মত তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলে কিছুতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণায় সাক্ষর দিতে রাজি হলেন না। বেগম মুজিব সুটকেসে তার জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। ঘর ছাড়তে বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন না। তার পাকিস্তানীদের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা পড়ার ইচ্ছা দেখে আশাহত বিস্মিত তাজউদ্দীন বাড়ি ফিরে অভিমানে শুয়ে রইলেন। স্ত্রী লিলিকে (জোহরা তাজউদ্দীন) বললেন, মুজিব ভাই কিছুতে রাজি হলেন না। আমিও কোথাও যাবো না…।

কিন্তু বাতাসে ২৫ মার্চে কিছু একটা ঘটতে চলেছে সেটা বিজ্ঞজনরা বুঝতে পারছিলেন। যখন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমন শুরু করে তখন তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন কি ঘটতে চলেছে। বেরিয়ে পড়েন আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। সেই রাতে গ্রেফতার হলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এখন মনে হয় এই গ্রেফতার বাংলাদেশের জন্য হয়েছিলো সাপেবর। বঙ্গবন্ধু মুজিবনগর সরকারে থাকলে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনও করে ফেলতে পারতেন! কিংবা যুদ্ধবিরতীর মত সিদ্ধান্ত ঘটে যেতো। কারণ খন্দকার মোশতাক, শেখ মনিসহ বহু নেতার প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র, কানমন্ত্র থেকে তখন প্রবাসী সরকারকে রক্ষা করতে তাজউদ্দীনের পক্ষে সম্ভব হতো না। কেননা সরকার প্রধান থাকতেন তখন বঙ্গবন্ধু। কেন একথা বললাম সেটা পরে ব্যাখ্যা করব…।

তাজউদ্দীনকে ছোটবেলায় তার স্কুলের হিন্দু সহপাঠিরা দেশ ত্যাগ করে চলে যাবার সময় বলেছিলো, তোদের পাকিস্তান টিকবে না দেখিস…। বালক তাজউদ্দীন প্রতিবাদ করে বলেছিলো, অবশ্যই টিকবে…। আজ তাজউদ্দীন নিজেই সেই পাকিস্তান ভাঙ্গার নায়ক। কাজটা সহজ নয়। বাঙ্গালী মুসলমান পাকিস্তান সমর্থন করেছিলো সাম্প্রদায়িক বিবেচনায়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে কখনই সেক্যুলারিজম গণতন্ত্র সাম্য অসাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না। পাকিস্তান যে আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তাতে কোন বাঙালী মুসলমানেরই দ্বিমত ছিলো না। কিন্তু তাজউদ্দীন বেতিক্রম। বাংলাদেশকে তিনি শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতেই চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ হবে উপমহাদেশের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্র। ৭২ সালের সংবিধানে আমরা তাজউদ্দীনের সেই চাওয়াকে দেখতে পাই। ৭২ সালের সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। ধর্মীয় পরিচয়ে, জাতিগত পরিচয়ে যেন কেউ বাংলাদেশে বৈষম্যের শিকার না হয় তার নিশ্চিয়তা রাখা হয়েছিলো। অথচ খোদ তার দল আওয়ামী লীগেই সেই চর্চা ছিলো না। এরকম বাংলাদেশ চাওয়ার কথা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কতজন মনে মনে ভাবতেন? খালেদ মোশাররফ, সিআর দত্ত ছাড়া তেমন কাউকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ৬৫ সালে এই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ভারতের বিরুদ্ধে লড়েছিলো জিহাদের জোশে!

যাই হোক, ভারতের সহায়তায় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার শপথ নিলো। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দীন হলেন প্রধানমন্ত্রী। এই পদটি চেয়েছিলো খন্দকার মোশতাক। পরে এটি না পেয়ে পরাষ্ট্রমন্ত্রী পদ পাবার শর্তে সে মন্ত্রী সভায় যোগদান করে। এই পদটি ব্যবহার করে মোশতাক চেয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে কোনভাবে যেন দুই পাকিস্তান ঐক্য ধরে রাখা যায়। মোশতাকের একের পর এক প্রচেষ্টা তাজউদ্দীন রুখে দেন। চোখের আড়ালে যাতে কোন ষড়যন্ত্র করতে না পারে তাই তাজউদ্দীন মোশতাককে যে কোন কর্মসূচীতে নিজের সঙ্গে রাখতেন। যুদ্ধবিরতির নামে মুক্তিযুদ্ধকে অনিশ্চিত অবস্থায় নিয়ে যেতে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো সেটা রুখে দিতে না পারলে আজতক বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত না। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর একমাত্র স্বীকৃত মনোনীত ব্যক্তি বলে ভারতের কাছে সামরিক সহায়তা চেয়ে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করে। এ্ই মুজিব বাহিনীর একমাত্র কাজ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ফন্টগু্লোকে লক্ষ্য করে ফায়ার করা। যুদ্ধবিরতিতে এই মুজিব বাহিনী, মোশতাক গং ও বামদের কোন কোন গ্রুপ নিজেদের একচ্ছত্র নেতৃত্ব দাবী করে টোপ গিলতে পারত। এতে অনিশ্চিত হয়ে যেতো বাংলাদেশের জন্ম। তাজউদ্দীন এই সকল বিষফোড়াগুলোকে এক এক করে দুর্বল করে দেন। অনুমান হয়, এ সময় বঙ্গবন্ধু মুজিবনগর সরকারে উপস্থিত থাকলে তাকে ম্যানেজ করা হয়ত সম্ভব হতো কারণ স্বাধীনতার প্রশ্নে তার দ্বিধা, সতর্কতা, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকে যাবার আশায় কালক্ষেপন দেখে এমনটাই মনে হয়।

অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ আর সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এলেন মুক্ত হয়ে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, কোটি জনগণের নয়নের মনি বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবার আগে তাজউদ্দীনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবো…। তাজউদ্দীন তার ভাষণে বললেন, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তাঁরই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতায় এককোনায় আমার নামটা লেখা থাকবে…’।

তাজউদ্দীন একা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলেছিলো- এটি কি কোনভাবে বঙ্গবন্ধুকে অস্বস্তিতে ফেলত? বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকালে কোনদিন মুজিবনগরে যাননি। তার নামে নামকরণ করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের এই স্থানটিতে প্রতি বছর যে অনুষ্ঠান হতো বঙ্গবন্ধু আশ্চর্যজনকভাবে সে অনুষ্ঠানে কখনই যোগ দেননি। তাজউদ্দীনের কাছে কখনই জানতে চাননি মুক্তিযুদ্ধের কথা। প্রবাসী সরকারের অফিস ছিলো কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে। দেশ স্বাধীন হবার পর ভারত সরকার বার বার তাগাদা দিয়েছিলো এই অফিসটিকে বাংলাদেশ সংরক্ষণ করবে কিনা? কিন্তু এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। যে ভবণটিকে বসে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো তাকে জাদুঘর করে রাখা উচিত ছিলো নতুন প্রজন্মকে দেখানোর জন্য। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে যারা তাদের গৌরবকে সংরক্ষণ করতে চায় না? এমনকি নিয়াজীর আত্মসমর্পনের স্থান রেসকোর্সকে স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন জাদুঘর করা উদ্যোগ নিতে চাইলেও সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি! মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল জিয়াউর রহমান এরশাদই মুছে ফেলতে চায়নি, মুজিব সরকারও এই অপকর্ম থেকে পিছিয়ে ছিলো না। আজ কেউ দেখাতে পারবে প্রবাসী সরকার ভারতের কোথায় কোন ভবনে ছিলো? মুজিবনগর সরকার বলতেই কিছু ছিলো নাকি? থাকলে তার প্রমাণ কই? কি জবাব দিবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্টরা?

পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। নিয়াজী, রাও ফরমান আলীসহ ১৯৫জন পাকিস্তানী সামরিক ব্যক্তিকে বিচার করা বাংলাদেশের জন্য কোন বাধা ছিলো না। পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা কঠিন ছিলো আমেরিকার চাপে। উপমহাদেশের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে সেটা সম্ভবপর ছিলো না। কারণ ভারত পাকিস্তান সম্পর্ক ঠিক করতে এই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ভারতকেও নমনীয় হতে হয়েছিলো। কিন্তু যে ১৯৫ জনের বিচার করার কথা ছিলো তাদের বিষয়ে কোন ছাড় দেয়ার কথা কেউ বলেনি। ২৮ আগস্ট ভারত পাকিস্তানের চুক্তিতেও এই ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে বাকি সকল সৈন্যকে মুক্তি দেবার কথা বলা হয়। অর্থ্যাৎ এই ১৯৫ জনকে বিচার করতে বাংলাদেশের কোন বাধা ছিলো না। তবু বাংলাদেশ এই বিচারটি করেনি। ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু লাহোর যান ৭৪ সালে। মুসলিম রাষ্ট্র হতে ওআইনিতে যোগদান ছিলো ৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাজউদ্দীনের নিষেধ সত্ত্বে বঙ্গবন্ধু ওআইসির সভায় যোগ দিতে লাহোর যান। সম্ভবত সেখানে ভুট্টর সঙ্গে কোন সমঝতা ঘটেছিলো যার দরুণ এই ১৯৫ জনকে বিচার করতে কোন বাধা না থাকার পরও বিচার করেনি সরকার। যার দরুণ ইতিহাসের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিয়াজী, রাও ফারমান আলীর মত জল্লাদরা হাসতে হাসতে পাকিস্তানে পাড়ি দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয় তাতে দেখা যায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের করা সমস্ত অপকর্মকে ভু্লে যাবে বলে ওয়াদা করছে! বঙ্গবন্ধু এসবের বিনিময়ে পাকিস্তান ও মুসিলম বিশ্বের স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিলেন। ভারতের লেখক জেএন দীক্ষিত লিখেছিলেন, এই ১৯৫ জনকে বিচার করতে বাংলাদেশ সরকার সাক্ষ-প্রমাণ সংগ্রহ কিংবা মামলার নথিপত্র তৈরির ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দুত হাকসারকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাক্ষ প্রমাণ সংগ্রহের অসুবিধার কারণে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শক্তি ও সময় নষ্ট করতে চান না। সাধারণ ক্ষমা এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপারধীদের বিচার না করার এই সিদ্ধান্তকেই গোলাম আযম বারবার ব্যবহার করে বলত যুদ্ধাপরাধের বিচার শেখ মুজিব ফয়সালা করে দিয়ে গেছে। গোলাম আযমদের বিচার অবশেষে হলেও সেই ১৯৫ জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করতে সক্ষম হইনি কারণ আমরা চাইনি নারী ধর্ষক, শিশু হত্যাকারীদের বিচার হোক…। জাতি হিসেবে কি জঘন্য আমরা….।

মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতি আর মুসিলম উম্মাহ অংশ হতে চেয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ভাষণে বলেন, ভায়েরা, বোনেরা আমার, আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের (রাজাকার আল বদর ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদের) বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এ জন্য যে এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম…। এ ছেড়ে দেয়াকে তাজউদ্দীন তখন মেনে নিতে পারেননি। তিনি তখন বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের কোন দেশেই এভাবে ক্ষমা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে যে কারণেই তাদেরকে ক্ষমা করা হোক না কেন, সেটা ন্যুনতম বিচারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে জাতি পিতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দন্ড মওকুফ করে দিতে পারেন…।

১৯৭৫ সালের ‘ইতিহাসের পটপরিবর্তন’ কথাটায় তাই বড় রকমের ঘাপলা রয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগেই কুখ্যাত দেশীয় রাজাকার আল বদররা সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে সাধারণ ক্ষমার আওতায়। বাংলাদেশ ওআইসিতে যোগ দিয়েছে। মুসলিম উম্মার অংশ হতে তখন তারা মরিয়া। এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলো তা ৭৫-এর আগেই নির্মমভাবে দু:স্বপ্নে পরিণত হয়। শত্রু সম্পত্তির মত কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক আইনটি তখনো বহাল রেখে হিন্দু সম্পত্তি দখলের একটা প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। রমনা কালি মন্দিরকে উচ্ছেদ ও তার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে দখল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিলো।… এরকম এক স্বপ্নভঙ্গের কালেই তাজউদ্দীন একা লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সব আশা ত্যাগ করে মন্ত্রী সভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকান্ডের পর নভেম্বর মাসে জেলখানায় তাজউদ্দীনসহ মুক্তিযুদ্ধের বাকী তিন সেনানীকে হত্যা করা হয়। জীবনে একটা বড় ভুল তখন তাজউদ্দীন করে বসেন। তাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো ভারত চলে যেতে। তাজউদ্দীন যদি একাত্তরের মত সেটা করতেন তাহলে বোধহয় ১৫ আগস্ট ঘটার পরও বাংলাদেশে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

ইতিহাস নির্মম নয়, অবিবেচক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের নামটি তাই অস্পষ্ট। অথচ তার নেতৃত্বেই মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে যে সেক্যুলার, প্রগতিশীল, ধর্ম থেকে রাষ্ট্র বিযুক্ত এক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের কথা বলা হয় তার রূপকার এই তাজউদ্দীন। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ সেক্যুলার নেতা তিনি…।

[তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ লিখিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ অবলম্বণে]

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted