ঘোরি পৃথ্বী -- মিশাইল নয় আইডেন্টিটির লড়াই :

ঘোরি পৃথ্বী -- মিশাইল নয় আইডেন্টিটির লড়াই :

পৃথ্বীরাজ চৌহান ! ভারতের শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা ! আপনার আমার পূর্বপুরুষ যার পরাজয়ের পর এদেশে ইসলামি শাসনের সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা ঘটে ! পৃথ্বীরাজ চৌহান ! ওরফে রাই পিথোরা , চাহামানা [চৌহান] বংশের সর্বশেষ নৃপতি, পিতা সোমেশ্বর, মাতা কর্পূরদেবী, ভ্রাতা হরিরাজ, আনুমানিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে যে ভূখণ্ডটি গুজরাটের অন্তর্গত ! পৃথ্বীরাজ চৌহান, দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে যার পরাজয়ের পর, আপনার আমার জন্মভূমি সুদীর্ঘকালের জন্য পরাধীন হয়ে পড়ে, [যার রেশ এখনও চলছে] যার পরাজয়ের কালটিকে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার পরাধীনতার সূত্রপাত লগ্ন হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীন ভারতের মহামহিম প্রধানমন্ত্রী, গিয়াসুদ্দিন গাজির বংশধর হিসেবেও যিনি অনেকের কাছে পরিচিত এবং বিতর্কিত, এতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ তথ্য আপনারা অনেকেই জানেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান ! বহুভাষী, ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত, সমর শাস্ত্র, দর্শন এবং চিত্রকলায় পণ্ডিত এবং পারদর্শী, বর্তমান রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত চৌহান রাজত্বের নরেশ এই মহা বীরটি সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি ? আরও ভাল করে বললে , আমাদের কতটুকু জানানো হয়েছে ? আসুন দেখে নেওয়া যাক। 

কনৌজের রাজা জয় চাঁদ রাঠোর একটি রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য একটিই। প্রতিবেশী রাজাদের অধীনতা স্বীকারে আমন্ত্রণ জানানো এবং নিজেকে রাজাধিরাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যান্য রাজারা উপস্থিত হলেও পৃথ্বীরাজ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে জয় চাঁদ যে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকলে তেমন সমস্যা হতনা। কিন্তু রাজকীয় শত্রুতার ব্যাপ্তি এবং প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের বৈরিতার তুলনায় অনেক সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। কনৌজরাজ জয় চাঁদের  পরমাসুন্দরী কন্যা সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের প্রেমে পড়েন। অত্যন্ত স্বাভাবিক। জ্ঞানে গুণে বীরত্বে পৃথ্বীরাজ চৌহান প্রতিটি রাজকন্যারই হার্টথ্রব ! কন্যাটি জানতেন তিনি এমন একজনের প্রেমে পড়েছেন যাকে তাঁর পিতা মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। তাতে কি ! মগজ কি সবসময় হৃদয়কে হারাতে পারে ? সংযুক্তা প্রিয় পুরুষটির সঙ্গে  যোগাযোগ করেই ফেললেন। কিন্তু অতি গোপনে। কিন্তু বাতাস তো বটেই দেওয়ালেরও কান আছে ! ব্যাপারটা জানাজানি হতে সময় লাগলনা। বসে বা দাঁড়িয়ে সুন্দরী কন্যার প্রেম লীলা দেখে যাবেন, জয় চাঁদ তেমন গোত্রের পিতা ছিলেননা ! কাল বিলম্ব না করে তিনি এক মহা স্বয়ম্বরের আয়োজন করে ফেললেন। সমস্ত প্রতিবেশী রাজাদের আমন্ত্রণ জানালেন। যাদের মধ্য থেকে তাঁর সুন্দরী কন্যাটি জীবনসঙ্গী বেছে নেবেন। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাদ দিলেন সেই জ্ঞানী গুণী মহাবীর পৃথ্বীরাজ চৌহানকে ! কেবল বাদ দিয়েই ক্ষান্ত হলেননা। অপমানের তীব্রতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পৃথ্বীরাজের প্রতিকৃতি হিসেবে একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি নির্মাণ করে স্বয়ম্বর সভার প্রবেশ মুখে দ্বার রক্ষী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এর পর কি আর চুপ করে থাকা যায় ! পৃথ্বীরাজও শ খানেক বাছা বাছা দেহরক্ষী নিয়ে কনৌজ পাড়ি দিলেন। ছদ্মবেশে পৌঁছে গেলেন স্বয়ম্বর সভার কাছে। প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলই। সুন্দরী সংযুক্তা উপস্থিত রাজন্যবর্গকে পাশ কাটিয়ে সেই দ্বার রক্ষীর কাছে পৌঁছে গেলেন। সবার চোখকে চড়কগাছে তুলে দিয়ে সেই দারোয়ানের গলাতেই স্বয়ম্বরের মালাটি ঝুলিয়ে দিলেন। দিল্লীশ্বর প্রেমিকটি চোখের পলকে তাঁকে ঘোড়ায় তুলে নিলেন। শুরু হল পলায়ন পর্ব। যুদ্ধ যে হয়নি এমন নয়। জয় চাঁদের সেনা সামন্ত বাধা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। পৃথ্বীরাজের সঙ্গে যাওয়া দেহরক্ষীদের অর্ধেকের বেশি প্রাণ হারান। কিন্তু তাতে কি ? তাঁদের বীরত্বেই পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। তারপর আর কি ! পরমাসুন্দরী সহধর্মিনীর প্রেমে মজে থাকা রাজা বিলাসে গাঁ ভাসিয়ে দিলেন। রাজ কার্যে অবহেলা শুরু হল। মন্ত্রী সান্ত্রীদের পরামর্শে কর্ণপাত করলেননা। আর জয় চাঁদ ? না, পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করার সাহস তাঁর ছিলনা। কিন্তু অপমানের বদলা হিসেবে তিনি অন্যরকম একটি ছক কষে ফেললেন। সীমান্তে তখন মোহম্মদ ঘোরির উপস্থিতি। ভারত জয়ের পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু কিভাবে কোন পথে এদেশে প্রবেশ করা যায়, ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছেননা। তক্কে তক্কে আছেন। জয় চাঁদ তাঁকেই ব্যবহার করলেন। কালবিলম্ব না করে ঘোরি যাতে পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন এই মর্মে জয় চাঁদের পথ নির্দেশিকাও তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে তিনি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আক্রমণ করে বসেন। শুরু হয় তরাইনের প্রথম যুদ্ধ ! সালটা ১১৯১ ! লাভ হলনা। পৃথ্বীরাজের পরাক্রমের কাছে মোহম্মদ ঘোরি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। বন্দী দশায় তাঁকে দিল্লিরাজের সামনে হাজির করা হল। পৃথ্বীরাজ একটি ভুল করে বসলেন। মহা ভুল ! ইংরেজিতে যাকে ব্লানডার বলা হয়। যার খেসারত তাঁকে প্রাণ দিয়ে চোকাতে হয়েছিল। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। প্রথাগত সৌজন্যের প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি ঘোরিকে মুক্তি দিলেন। কৌশলী, কুচক্রী মোহম্মদ ঘোরি কথা দিলেন ফিরে যাবেন। আর এই দুঃসাহস করবেননা। দিল্লীশ্বর তাঁকে বিশ্বাস করলেন। পত্নী, প্রিয়জনদের সতর্কবানী সত্ত্বেও ঘোরিকে মুক্তি দিয়ে দ্বিতীয় তরাইন যুদ্ধের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে ফেললেন। হ্যাঁ, পরের বছরই অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় আঘাত হানেন। তবে দিনের বেলায় নয়, রাতের অন্ধকারে। ভারতীয় সংস্কৃতি/ রীতি অনুযায়ী রাতে কখনও যুদ্ধ হতনা। সেটিকে বিশ্রামকাল হিসেবেই বিবেচনা করা হত। কিন্তু যবন কবে মানবিকতা, সৌজন্য মেনেছে ? তাছাড়া ঘোরি এবার অনেক বেশি শক্তি নিয়ে আক্রমণ শানান। অতর্কিত এই হামলাতে পৃথ্বীরাজ পরাজিত এবং নিহত হন। সংযুক্তার কি হয় ? হা হা হা  ! বলার অপেক্ষা রাখে ? তাঁকে পৃথ্বীরাজের সামনেই ধর্ষণ করা হয়। বার বার ! গণ ধর্ষণ বলতে যা বোঝায়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ! এবিষয়ে মতভেদ থাকলেও দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে যে তিনি পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিভাবে ? কোথায় ? তরাইনের যুদ্ধেক্ষেত্রে ? 

তবে ওটা কি ? ওই যে ! কবরই তো মনে হচ্ছে ! হ্যাঁ ঠিক তাই ! কিন্তু কী আশ্চর্য ! ওই লোকগুলো কি করছে ? হ্যাঁ প্রত্যেকেই মুসলমান। কবরটির উপর ক্রমগাত লাথি মেরে চলেছে। শুধু লাথি নয়। থুতুও ! কেউ কেউ ছুরি, চাপাতিও চালাচ্ছে ! কী ব্যাপার বলুন তো !এক ছটাক ভূখণ্ডের উপর ওদের এত রাগ ! এত ঘৃণা ! আসুন একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। লাথি, থুতু, ছুরিকাঘাতের লক্ষ্য হওয়া কবরটি যে তেমন হেলাফেলার বস্তু নয়, খোদাই করা অক্ষরগুলো পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ? কি লেখা আছে ? আসুন পড়ে ফেলি ! উঁহু ভাষাটি আপনার আমার বোধগম্য নয়--- তবে ইতিমধ্যেই সেটির ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে—কবরটির উপর লেখা আছে-- “Here lies the Kafer king of Delhi  -অর্থাৎ এখানে শায়িত আছেন দিল্লির কাফের রাজা ! কি বুঝলেন ? বেশ গোলমেলে ব্যাপার না ! কাফের রাজা ? আলবাত তাই ? নইলে ওরা লাথিই বা মারবে কেন ? থুতুই বা ছেটাবে কেন ? কিন্তু কেই এই কাফের রাজা ? কেন  পৃথ্বীরাজ চৌহান ! আরও অবাক হলেন তো ? হাসিও পাচ্ছে নিশ্চয় ! গুছিয়ে হাসুন ! আপনার আমার হাসিতে কিছু যায় আসেনা। কারণ নিয়মিতভাবে লাথি এবং থুতু ছেটানোর কাজটি যারা করেন, তারা এটাই বিশ্বাস করে। উঁহু হালের বিশ্বাস নয়। বংশ পরম্পরায়—প্রায় এক হাজার বছর ধরে। আর ওই যে দেখছেন ! আর একটি কবর ! যত্ন করে বানানো। হ্যাঁ ওই যে শ্বেতপাথরের। খোলা আকাশের নিচে নয়। উপরে রীতিমত ছাদ আছে। হ্যাঁ ইসলামিক স্মৃতি সৌধ যেমন হয় ! ওটি  কার জানেন ? মোহম্মদ ঘোরির ! কী ? ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার দশা তো ! ছেকুলার হলে ভিরমিও খেতে পারেন। তাতে কিছু যায় আসেনা। কারণ এখানকার মানে গজনীর, মানে আফগানিস্তানের মুসলমানরা এটাকে ঘোরির কবর বলেই মনে করে। কিন্তু ঘোরির কবর ভেতরে আর পৃথ্বীরাজের কবর প্রবেশ মুখে কেন ? এখনও বোঝেননি ? পৃথ্বীরাজের কবর না মাড়িয়ে ঘোরিকে সম্মান জানানো সম্ভব ? তাই এই ব্যবস্থা ! প্রিয় জিহাদি বীরটিকে যারা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাঁরা প্রথমে এই কাফের রাজার কবরটিকে লাথি, থুতু দিয়ে অপবিত্র করে মনের ঝাল মেটান। তারপর এটিকে মাড়িয়ে ঘোরির সৌধে প্রবেশ করেন । উঁহু অবাক হবেন না। হিন্দু প্রতীক, দেবদেবীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অসম্মান করার হাজার নমুনা আছে। সুলতান মামুদ সোমনাথের শিবলিঙ্গ গজনীতে নিয়ে গিয়ে সেখানকার মসজিদে সিঁড়ির মত ব্যবহার করেছিলেন। 

কী মাথা ঝিমঝিম করছে তো ! করারই কথা। প্রথমত পাঠ্য ইতিহাস বলছে পৃথ্বীরাজের মৃত্যু তরাইনের যুদ্ধক্ষেত্রে হয়েছিল। তবে তাঁর কবরটি আফগানিস্তানে গেল কিভাবে ? তাছাড়া তিনি হিন্দু ছিলেন। পোড়ানোর বদলে কবরই বা দেওয়া হল কেন ? যদি ধরেই নেওয়া যায় যে মৃত্যুর পর যুদ্ধ বিজয়ের ট্রফি হিসেবে তাঁর মৃতদেহটিকে গজনীতে নিয়ে যাওয়া হয়, অসম্মান করার উদ্দেশ্যেই চিতায় না পুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়, তবে তাঁর উপর এত রাগ কেন ? পৃথ্বীরাজ তো পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। বিষয়টি তো সেখানেই মিটে যাওয়ার কথা ! তাই না ? কিন্তু মেটেনি ! কেন বলুন তো ! এর উত্তরও খুব সোজা ! কারণ ইতিহাস মূলত দু প্রকারের--- বিজয়ীর ইতিহাস এবং পরাজিতের ইতিহাস।  এই বিজয়ীর ইতিহাস অর্থাৎ ইসলামি শাসকদের মহত্ত্ব, বীরত্ব, উদারতা, সম্প্রীতি ইত্যাদি নিয়েই আমাদের স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাসটি রচিত হয়েছে। কারা লিখেছেন, কেন লিখেছেন, কাদের অঙ্গুলি হেলনে লিখেছেন সে বিষয়ে অমৃতস্য পুত্রাঃ নামক সদ্য প্রকাশিত বইটিতে বিশদে আলোচনা করেছি। অনেকেই পড়ছেন, জানছেন। যাক, প্রসঙ্গে আসি। হিটলারের মৃত্যু যেমন বার্লিনের বাঙ্কারে ঘটেনি, পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুও তরাইনের যুদ্ধক্ষেত্রে হয়নি। দ্বিতীয় যুদ্ধের পরও হিটলার বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন, সহধর্মিনী ইভা ব্রাউনের সঙ্গে আর্জেনটিনায় পালিয়ে যাওয়ার পর [ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জুয়ান পেরন এবং তাঁর স্ত্রী এভিটা হিটলার যুগলে আশ্রয় দেন] দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। উর্সুলা নামে তাঁদের একটি কন্যা সন্তানও হয়। সবকিছুই অবশ্য ছদ্মনামে এবং ছদ্মবেশে। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিটলারের মৃত্যু হয়। এখানে সেই আলোচনার পরিসর নেই। আগ্রহীরা হ্যারি কুপারের তথ্যনির্ভর বইটি Hitler in Argentina: The Documented Truth of Hitler's Escape from Berlin (The Hitler Escape Trilogy) পড়ে দেখতে পারেন। হ্যাঁ পৃথ্বীরাজেরও এমন একটি ইতিহাস আছে। যা খুব যত্ন করেই আড়াল করা হয়েছে। কী সেই ইতিহাস ? আসুন, জেনে নেওয়া যাক সেই অন্যরকমের ইতিহাস। 

না, তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ পরাজিত হলেও নিহত হননি। তাঁকে পরিবার প্রিয়জন সহ যুদ্ধবন্দী হিসেবে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। নারীরাও রেহাই পাননি। গণিমতের মাল বোঝেন ? না বুঝলে স্টার জলসা দেখুন। তারপর কি হয় ? ঘোরির চোখে চোখ রেখে কথা বলা উদ্ধত পৃথ্বীরাজকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। কিভাবে ? উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দিয়ে। দৃশ্যটি একটু ভেবেও নিতে পারেন। অকথ্য যন্ত্রণা। তারপর ? হ্যাঁ তারপরই সূত্রপাত এই ধামাচাপা ইতিহাসের। সর্বস্ব হারানো, চূড়ান্ত অপমানিত পৃথ্বীরাজ প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে শুরু করেন। সমব্যথী, সহ যোদ্ধা, সভাকবি চাঁদ বরদাই এগিয়ে আসেন। কিভাবে ? তিনি মহম্মদ ঘোরিকে একটি লোভনীয় প্রস্তাব দেন। তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা । পৃথ্বীরাজ চোখ বাঁধা অবস্থাতেও নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করতে পারেন। হ্যাঁ, সত্যিই তাঁর এই ক্ষমতা ছিল। এই শব্দভেদী বানের কথা আমরা সবাই কম বেশি শুনেছি। অর্থাৎ শুধুই শব্দ শুনে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করা। যদিও অনেক সাধনার বিষয়। ঘোরির তো চোখ কপালে ওঠার দশা। এমন আবার হয় নাকি ! তবু কৌতূহল চাপা দায়। প্রতিযোগিতার আয়োজন হল। প্রথম লক্ষ্যটি সাফল্যের সঙ্গে ভেদ করামাত্র বিস্মিত ঘোরি—সাবাস উচ্চারণে ফেটে পড়লেন। বন্ধু চাঁদ বরদাই আর দেরি করেননি। চিৎকার করে জানিয়ে দিলেন—চার বাঁশ, চব্বিশ গজ, আঙুল অষ্ট প্রমাণ/ তা উপর সুলতান হ্যায় চুকে মত চৌহান ! অর্থাৎ সামনে চারটি বাঁশের দূরত্ব, সেখানেই চব্বিশ হাত আট আঙুল উপরের একটি আসনে সুলতান ঘোরি উপবিষ্ট। পৃথ্বীরাজ আর দেরি করেননি।কন্ঠস্বর আগেই শুনেছিলেন। এবার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুটে গেল নির্ভুল বান। তীরবিদ্ধ ঘোরি লুটিয়ে পড়লেন। চাঁদ বরদাই জানতেন এরপর কি ঘটতে পারে। পরস্পরের বুকে ছুরি বসিয়ে তাঁরা আত্মহত্যা করেন। 

কী বিশ্বাস হচ্ছেনা ? গল্প গাথা মনে হচ্ছে ? চাঁদ বরদাই রচিত পৃথ্বীরাজ রসোতে এমন ঘটনাক্রমের কথাই বলা হয়েছে। কি বললেন ? যদি উনি পৃথ্বীরাজের সঙ্গে আত্মহত্যাই করেছিলেন, তবে এসব লিখলেন কখন? উনি কি এক হাতে কাগজ কলম এবং অন্য হাতে ছুরি নিয়ে পৃথ্বীরাজের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন ? ধীরে বন্ধু ধীরে ! অসামান্য এই গ্রন্থটি একজনের রচিত হয়। সবচেয়ে পুরাতন সংস্করণটি [যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে] ত্রয়োদশ শতাব্দীর বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ চাঁদ বরদাইয়ের মৃত্যুর পরও এতে সংযোজন ঘটতে থাকে। কলহনের লেখা রাজতরঙ্গিনীর নাম নিশ্চয় শুনেছেন। কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তিপিদাকে নিয়ে রচিত এই মহা গ্রন্থটিরও অন্তত তিনটি খণ্ড আছে। অর্থাৎ তিনটি রাজতরঙ্গিনী ! অমৃতস্য পুত্রাঃ শীর্ষক বইটিতে এর বিশদ আলোচনা করেছি। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। রাজতরঙ্গিনী যেমন মুক্তিপিদা এবং কাশ্মীরের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে, পৃথ্বীরাজ রসোও তেমনি মহাবীর পৃথ্বীরাজ চৌহানকে কেন্দ্র করে। কি । বিশ্বাস হচ্ছেনা ? শব্দভেদী বান বলে কিছু হয়না ? বেশ, তাই হোক।সুদীর্ঘ বাম ইসলামিক শাসনের ফলশ্রুতিতে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির কোনো কিছুতেই আপনার বিশ্বাস নেই। তবে গজনীতে অবস্থিত ওই কবরটিতে এত লাথি এবং থুতু পড়ে কেন ? আবহমানকাল ধরে কেন এই বিশ্বাস –পৃথ্বীরাজই মোহম্মদ ঘোরিকে হত্যা করেছিলেন ? আফগানিস্তানের মুসলমানেরাও কি চাঁদ বরদাইয়ের পৃথ্বীরাজ রসো পড়ে ফেলে এমন অনাসৃষ্টি ঘটিয়ে চলেছেন ? ভাবুন ভাবা প্র্যাকটিস করুন। 

কিন্তু কিভাবে জানা গেল এই কবরের অস্তিত্ব ? কানা ঘুষো ছিলই। তার উপর তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। কোনো কিছুই চাপা থাকেনা। শের সিংহ রানার নাম শুনেছেন ? কেউ কেউ নিশ্চয় শুনেছেন। হ্যাঁ ফুলন দেবী হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত। কিন্তু এছাড়াও তাঁর একটি অন্যরকম পরিচয় আছে। জেলে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি এই কবরের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিহার জেল থেকে পালিয়ে যান। কি উদ্দেশ্য ? পৃথ্বীরাজ চৌহানের কবরের মাটি তিনি ভারতে নিয়ে আসবেন। রাঁচি থেকে একটি জাল পাসপোর্ট জোগাড় করে তিনি স্টুডেন্ট ভিসাতে আফগানিস্তানে পাড়ি জমান। ২০০৫ সালের প্রথম দিকে। অর্থাৎ জেল ভাঙার দশ মাস পর। সুভাষ ঠাকুর নামের এক কয়েদি [যার সঙ্গে জেলেই পরিচয়, সমস্ত আর্থিক ভার বহন করেন] তারপর খোঁজ আর খোঁজ। প্রায় তিন মাস ধরে। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন কবরটির লোকেশন নিয়ে তাঁর কোনো ধারণাই ছিলনা। শুধু এক হিন্দু রাজার কবরে লাথি থুতু মারা হয় এটুকুই শুনেছিলেন। জাত্যাভিমানে লেগেছিল। কান্দাহার কাবুল এবং হিরাট হয়ে তিনি অবশেষে গজনী পৌঁছে যান। শহরের উপকন্ঠে ডিক নামের একটি অখ্যাত গ্রাম। সেখানেই তিনি মোহম্মদ ঘোরির কবরের সন্ধান পান। তারই কয়েক মিটার দূরে পৃথ্বীরাজের কবর। স্থানীয়দের মিথ্যা পরিচয় দেন। বলেন তিনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন। মোহম্মদ ঘোরির কবর স্থানটির সংস্কার এবং পুনর্নিমানের উদ্দেশ্য নিয়ে। সে ব্যাপারেই তথ্য চাই। অতি গোপনে কাফের হিন্দু রাজার কবরটি খুঁড়ে [ সেখানে এটি এই নামেই পরিচিত] তিনি বালিও সংগ্রহ করেন।  এই কার্যকলাপকে ভিডিওতেও ধরে রাখেন। ২০০৫ এর এপ্রিল মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন। প্রথমে বেশ হৈচৈ হলেও পেট্রো ডলার খেকো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া পুরো ব্যাপারটিকেই গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। তাতে অবশ্য তিনি পরোয়া করেননি। উত্তরপ্রদেশে পৃথ্বীরাজের নামে একটি স্মৃতিসৌধ বানিয়ে ফেলেছেন। এবিষয়ে যথাযথ তদন্ত করার দাবিতে একটি মাস পিটিশনও শুরু করা হয়। কিন্তু সেটির ফলাফল এখনও অজানা।  ইউটিউব , গুগল-এ এবিষয়ে আরও অনেক তথ্য পেতেই পারেন। কিন্তু মূল স্রোতের মিডিয়া এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।  

কি মনে হচ্ছে ? There are more things in heaven and earth, Horatio, Than are dreamt of in your philosophy. your philosophy তাই না ? বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি ? আর ইতিহাস ? সে যতটুকু ছাপা হয়, চাপা হয় তার কয়েক গুণ ! তাই ইতিহাস গুজবে পরিণত হয়, গুজব ইতিহাস ! এই যেমন ধরুন ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির নাম কি বলুন  তো ! দুর্গা ! ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল। স্রষ্টা কে ? বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগে ? কে বলুন তো ? বিজ্ঞানী আনন্দকুমার ! হ্যাঁ তার জন্ম দেওয়া হর্ষই ছিল ভারতের প্রথম অফিশিয়াল টেস্ট টিউব বেবি ! কেন বদলে গেল ? তদন্ত হল বলে ! [ এবিষয়ে অমৃতস্য পুত্রাঃতে একটি আলোচনাই আছে] বলুন তো কলকাতার জনক কে ? মানে প্রতিষ্ঠাতা ! ছোটবেলায় কি পড়েছিলেন ? জব চার্নক ! এখন কে ? সাবর্ন রায়চৌধুরি পরিবার। হ্যাঁ আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পর এই পরিবর্তন  ! রার বাবরি মসজিদ ? ওখানে কি রাম মন্দির ছিল না ? হা হা হা ! আদালত পর্যন্ত ঢোক গেলা শুরু করেছে। কিন্তু যখন প্রথম শুনেছিলেন সত্যি করে বলুন তো গুজব মনে হয়নি ? মনে হয়নি হিন্দুত্ববাদীরা নতুন ষড়যন্ত্র ফেঁদেছে  ? আলবাত মনে হয়েছিল ! ছেকুলাররা এখনও মনে করেন ! আমরা মানে পেট রোগা বাঙালীরা আবার খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ছাড়া কিছুই বুঝিনা। ভাত দে  নইলে মানচিত্র খাব ! তা খেয়েই ফেলুন না ! গিলতে গিলতে তো পাঁচ ভাগের একভাগে ঠেকেছে ! আচ্ছা, নেতাজীর মৃত্যুও যে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় হয়নি এটাও কি গুজব ? নিশ্চয় নয় ! কেন নয় ? অনেকগুলো তদন্ত কমিশন বসানো হয়েছিল বলেই জলটা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার বাধ্য হচ্ছে ক্লাসিফাইয়েড ফাইল প্রকাশ করতে। যদিও নম নম করে। এবার ভাবুন ১৯৪৬-৪৭ সালে ঘটা একটা মৃত্যু রহস্য নিয়ে যদি এত বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়ে থাকে, তবে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের বেলায় কি কি হতে পারে। পৃথ্বীরাজ যদি সত্যই মোহম্মদ ঘোরিকে হত্যা করে থাকেন সে কথা কি আমাদের মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকেরা ফলাও করে লিখবেন ? কদাপি নয়। যে কারণে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার বীরত্বকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, সেই কারণেই পৃথ্বীরাজকে ধামাচাপা দেওয়া হতেই পারে। শুধু কি তাই ? মহা বীর হিন্দু রাজা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য যিনি দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে দুর্ভাগ্যবশত পরাজিত হন, তাঁকেও এক অকিঞ্চিৎকর ভূমি দস্যু হিসেবে পাঠ্য ইতিহাসে ক্ষমা ঘেন্না করে স্থান দেওয়া হয়েছে।হেমচন্দ্র হিসেবে নয়, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের হিমু !অথচ মহা পরাক্রমশালী এই হিন্দু রাজা তার্দি বেগ খানকে দিল্লির যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং আগ্রা সহ সমগ্র রাজধানীর দখল নেন। সংখ্যায় এবং শক্তিতে তাঁর বাহিনী অনেকটাই শক্তিশালী ছিল। একটি তীরের আঘাতে তিনি সাময়িক জ্ঞান হারাতেই, সেনাবাহিনী ভয় পেয়ে যায়। ফলে বৈরাম খাঁ-র পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে যায়। হেমচন্দ্র বন্দী হন। নির্মম অত্যচারের পর তাঁর শিরচ্ছেদ করা হয়।  হ্যাঁ এই হল আমাদের ইতিহাস। সেখানে কোনো হিন্দু বীর নেই। সবাই লক্ষ্মণ সেন ! পালানো ছাড়া যেন কোন কাজই নেই। অথচ আটশ বছর রাজত্ব করার পরও কেন ভারতকে সম্পূর্ণ ইসলামিক দেশে পরিণত করা গেলনা, তার উত্তর খুঁজলেই এই সব বীরদের অবদান মনে আসে। যদিও সিংহভাগকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।শিবাজী, রাণা প্রতাপের কাহিনীও একান্তই ঢেঁকি গেলার মত করে লেখা। পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। আর সেটা কোন মোল্লার থুড়ি পাল্লার মধু চেটেছে, একটু ভাবলেই বুঝবেন।    
 না, আমি একবারও বলছিনা, উল্লিখিত কবরটি পৃথ্বীরাজ চৌহানের। শুধু তদন্তের দাবী জানাচ্ছি।আমি একা নই। অনেকেই। কারণ এদেশের ইতিহাসে এখন অনেক অন্ধকার গলি ঘুঁজি আছে ! তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারে লুকোনো কঙ্কালের মত সেসব সামনে আসছে। কোনটি ইতিহাস, কোনটি উপন্যাস বুঝে ওঠা মুশকিল। স্বনামধন্য যদুনাথ, রমেশচন্দ্র অনেক আগেই নির্বাসিত। 

আপনি যাই ভাবুন না কেন , পৃথ্বী ঘোরির লড়াইটা নিছক মিসাইলের নয়। আইডেন্টিন্টির। ১১৯১ সালে শুরু হয়ে যা এখনও চলছে। কি বললেন ? গুজব ? বেশ। তবে আপনার পেছনে জোড়া পায়ের লাথিটা, ১৯৪৭শে যার জন্ম ? সেটাও গুজব ? আর ওই যে থুতুটা ? ওটা কিন্তু হিন্দু কাফের রাজার কবরের উপর পড়ছেনা ! ওই দেখুন আপনার গালটা কেমন চটচট করছে। কি বললেন ? এটাও গুজব ! বেশ আসুন, বিফ বিরিয়ানি খাওয়া যাক।  
---
অমৃতস্য পুত্রাঃ দ্বিতীয় খণ্ড থেকে

✍️ দেবাশিস লাহা

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted