আজও আমি 'উদ্বাস্তু' শুনতে হয় কেন ?

আজও আমি 'উদ্বাস্তু' শুনতে হয় কেন ?

-----------------------------------------------------

আমার জন্ম এপার বাংলায় । সেই ছোট্টবেলার ইস্কুলের দিনগুলো থেকেই ক্লাসের সহপাঠী থেকে পাড়ার বন্ধুদের কাছে যখন তখন টোন টিটকিরি শুনে বড় হয়েছি :

'কিরে ! তোরা তো উদ্বাস্তু, ওপার থেকে খেঁদিয়ে দিয়েছে ।'

কানে বাজে কথাগুলো এখনও । কেন আমাকে এই 'উদ্বাস্তু' ট্যাগ খেয়ে বেড়ে উঠতে হলো ? পাঠক, আজ আপনাদের বলি কেন আমাকে 'উদ্বাস্তু' শুনে বড় হতে হলো । একটু বড় লেখা, ধৈর্য নিয়ে পড়বেন :

দুই বাংলার বাঙালি মুসলমান বাংলাভাগের প্রধান কারন হিসাবে এপার বাংলার বর্ণহিন্দুদের সেদিনের অবিভক্ত বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে অস্বীকার করাকেই দায়ী করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুয়া থিওরির উপরে ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে আজকের স্বাধীন ভারতবর্ষ ভূখণ্ড । এই ভুল বিক্রিয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্বাস্তু নামে চিররুগ্ন বহু সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে ! প্রকৃত সত্য হল ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ আজও পর্যন্ত দু টুকরো হয়েছে এবং পরবর্তীতে টুকরো ভূখণ্ডের একটি অংশ আবার দ্বিখন্ডিত হয়েছে ভাষাভিত্তিক সায়ত্ব শাসনের রাজনীতির হাত ধরে । ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের দাম চোকাতে হয়েছে প্রায় ২০ কোটি উদবাস্তুকে। দেশভাগে এই ২০ কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করা হলেও তাদের জীবন-জীবিকা,নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি ! পাঞ্জাবিরা ক্ষমতার জেরে তাদের প্রাপ্য আদায় করে নিয়েছে আর বাঙালিরা শুধু নেতাদের প্রতিশ্রুতির উপরে আশা ভরসা করে ঠকেছে আর তাই এপার বাংলায় সর্বস্বহীন উদ্বাস্তুদের ইতিহাস জ্বালা-যন্ত্রণাময় !

দেশভাগের রহস্যটা ছিল একটু অন্যরকম । অবিভক্ত ভারতীয় ভূখণ্ডে দেশভাগের কোপ মূলত পরেছিল বাংলা, আসাম আর পাঞ্জাবের ওপরে । তথাকথিত স্বাধীনতার দু’বছরের মধ্যে পাঞ্জাবের মাটি, মানু্‌ষ সম্পদ সবই সুষ্ঠুভাবে ভাগ হলও, মানুষের পুনর্বাসন হল এবং নাগরিক অধিকারও পেল । বাংলার মাটি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও, মানুষ ভাগ হলোনা ! স্বাধীনতার নামে যাদের উদ্বাস্তু করা হল, তাদের স্থায়ী আবাসভূমি ঠিক হলো না ! স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই পূর্ববঙ্গে একতরফা হিন্দু নিধন, হিন্দু বিতারন শুরু হল কিন্তু জনসংখ্যা বিনিময়ের কোন প্রচেষ্টাই নেওয়া হলো না । নেতারা কেবল আশ্রয়ের জন্য অফুরন্ত প্রতিশ্রুতি দিল । তখন অবিভক্ত বাংলার আয়তন ছিল ২,৩১.৮৪৮ বর্গ কিলো মিটার আর জনসংখ্যা ৬,০৩,০৭,৬১৬ জন । মোট জনসংখ্যার ৫৫% মুসলমান এবং ৪৫% অমুসলমান । পাঠক, এখানে ভাঙতাটা লক্ষ্য করবেন, ৫৫ শতাংশ মুসলমানের জন্য অবিভক্ত বাংলার ৬২.৫৬% জমি ধার্য হল অর্থাৎ তাদের জনসংখ্যার থেকে ৭% বেশি যা হল পূর্ব পাকিস্তান । অবিভক্ত বাংলার ৪৫% অমুসলমানের জন্য ধার্য হল ৩৭.৪৫% জমি যা কিনা তাদের জনসংখ্যার থেকে ৭ শতাংশ কম । বাংলা ভাগের প্রথম গোঁজামিল এখানেই ! ভাগের শর্ত অনুযায়ী তখনের পশ্চিমবঙ্গ এর ৫৩% মুসলমানের ভাগের জমি পূর্ব পাকিস্তানে আর তখনের পূর্ববঙ্গের ১.২০ কোটি অমুসলমানের ভাগের জমি পশ্চিমবাংলায় । সেই শর্ত কিন্তু মানা হলো না । বাংলা ভাগের দ্বিতীয় গোঁজামিল !

পূর্ববঙ্গের মুসলমানি জেহাদে জান মাল বাঁচাতে সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুর ঢল নামল পশ্চিমবঙ্গে অথচ, ধর্মীয় জিঘাংসায় জেরবার পূর্ববঙ্গমুখী মুসলমান উদ্বাস্তু প্রায় ছিল না বললেই চলে ! যে সকল মুসলমান পূর্ববঙ্গমুখী হয়েছিল তাদের সিংহভাগই ছিল অবাঙালি, যারা এপার বাংলায় প্রত্যক্ষ দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছিল ।

গান্ধী বলেছিলো :”আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে দেশভাগ হবে”, আর জিন্নাহ বলেছিলো :’আমি পোকায় কাটা পাকিস্তান চাই না।”

বাস্তবে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা জিন্নাহ ও তার অনুসারী মুসলিম লীগের টাউটগণ জেলও খাটেনি, দিপান্তরেও যায়নি, গুলি-লাঠিও খায়নি ! স্রেফ হিন্দু নিধনের মাধ্যমে আর ‘ মু মে বিড়ি হাত মে পান. লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করে একটি মোটা মুটি বিশাল রাজত্ব পেয়ে গিয়েছিলো ! (এখন সেটিও দ্বিখণ্ডিত-ইতিহাসের প্রতিশোধ !) । বাঙালি হিন্দুর জীবনে এই স্বাধীনতা এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ! ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দুই বাংলাতেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গে হয়েছিল একতরফা পরিকল্পিত হিন্দু নিধন ও বিতাড়ন । পশ্চিম বাংলার সাম্প্রদায়িক হানাহানি মূলত শুরু হয় বসবাসকারী অবাঙালি মুসলমানদের উস্কানিতে । শুরুটা তারাই করেছিল ।পরবর্তীতে জোরদার প্রতিরোধ ও পাল্টা জিগাংসায় পশ্চিমবাংলার এই অবাঙালি মুসলমানেরা পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যায় । এদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২৫-৩০ হাজার । এছাড়াও সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হলে পশ্চিমবাংলার সীমান্ত জেলাগুলো থেকেও কিছু সংখ্যক বাঙালি মুসলমান জমি-সম্পত্তি বিনিময়ের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায় । এদের সংখ্যা প্রায় আনুমানিক ৪০ হাজার ছিল । ভারত সরকারের অনুরোধে পরবর্তীতে এদের প্রায় ২০ হাজার ফেরৎ আসে । পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগী মুসলমানের সংখ্যা এত কম হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো কাজ করেছে, সেগুলো হলো :

১.ভারত সরকারের সার্বিক ধর্ম নিরপেক্ষ কাঠামো ধরে রাখা ।

২.পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ।

৩. পূর্ব বাংলার সামাজিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের মানিয়ে নিতে না পারা ।

৪. সেই সময়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতির অভাব ।

একতরফা সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞে পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘুর টেঁকা দায় হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল, আর হয়েও ছিল তাই । বাংলা ভাগের সময় পূর্ববঙ্গে ১.২০ কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু জিম্মি ছিল । পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বকে ১০০% আত্মিক করে এদের যেন তেন প্রকারে নির্মূল করতে, ভূমিহীন করতে , উঠে পরে লেগেছিল ! ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গ থেকে ৬০-৭০ লক্ষ সংখ্যালঘু হিন্দু বিতাড়িত করা হয়েছে । অগণিত সংখ্যালঘু হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে, মাত্রাহীন হিন্দু নারী ধর্ষিতা হয়েছে এবং পরিশেষে অগুনতি জীবন বাঁচাতে ধর্মান্তরিত হয়েছে । ১৯৪৭ থেকে প্রথম ১০ বছরে ৪১.১৭ লক্ষ সংখ্যালঘু হিন্দু নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়। সুপরিকল্পিত উপায়ে সংখ্যালঘু হিন্দুকে নিঃচিন্হ করতে যা যা করা দরকার সকল প্রক্রিয়া রাষ্ঠ্রের মদতে হয়েছে যেমন, লুট,ধর্ষণ,ডাকাতি, মিথ্যে মামলা, চাকরি ক্ষেত্রে অযথা হেনস্থা এবং বঞ্চনা ইত্যাদি । এমনকি ‘৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পরেও আজও পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলেই আসছে ! বাঙালি হিন্দুই তাই বঙ্গভঙ্গের একতরফা উদ্বাস্তু, কারণ:

১.দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক ভাঁওতায় বাংলা ভাগকে বাঙালি মুসলমানের সর্বাত্মকভাবে মেনে নেওয়া ।

২.ইসলামী নিয়ম মেনে ভূখণ্ডকে অমুসলিমহীন করা ।

৩.পশ্চিমবাংলার সেকুলাঙ্গারদের না না অছিলায় এই জঘন্য নীতিকে ডিফেন্ড করা ।

৪.পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বেক্তিস্বার্থে এবং বর্ণবিভেদে ঐক্যের অভাব ।

পাঠক, বাঙালি মুসলমান কিন্তু আদতেই প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক !

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted