তারাই গর্ব করে নাম দিয়েছে ‘মুসলিম শাসন’ ‘ইসলামের ইতিহাস’!


‘ইসলামের ইতিহাস’ হিসেবে বখতিয়ার খিলজি-মুহাম্মদিন বিন কাশেম থেকে বাদশাহ আকবর-ঔরঙ্গজেব যদি অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে এই শাসকদের যে কোন কর্মের দায় ভার ইসলামকে নিতে হবে। ইতিহাসের কোনো রক্তলোলুপ যোদ্ধার নিষ্ঠুরতা আর যে যোদ্ধা নিজেকে নবী বা অবতার বলে ভক্তদের মাঝে স্বীকৃত হন, তাদের দুজনের বিচার এক রকম হবে না। তৈমুর লং কিংবা চেঙ্গিস খান কতজন মানুষকে খুন করেছিলো, মানুষের মাথা দিয়ে পিড়ামিড বানিয়েছিলেন সে তুলনায় একজন নবী ৫০-১০০ জন মানুষকে হত্যা করলেও তার বিচার ভিন্ন হবে। তাই ‘মুসলমান’ যেহেতু একটি ধর্মীয় পরিচয় তাই এই পরিচয়ের আলাদা অর্থ আছে। আরব আফগান তুর্কী থেকে আসা এইসব শাসকরা ভারতে যখন এসেছিলো তখন নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিয়েছিলো। অথচ তাদের ছিলো নির্দিষ্ট জাতি পরিচয়। কিন্তু ‘মুসলমান’ এই পরিচয় তৌহিদের পরিচয় যা নবী মুহাম্মদকৃত নির্দিষ্ট করা। ‘ইসলামের ইতিহাস’ নামে ভারত শাসনের যে ইতিহাস আমাদের এখানে প্রচলিত তা ‘মুসলিমদের গৌরবের ইতিহাস’। এই যে গৌরব তা ‘মুসলমানদের’। এটি ধর্মীয় পরিচয়। আমি বাঙালি, আপনি পাঞ্জাবী সে মঙ্গলীয়, আমাদের আছে ভিন্ন জাতিসত্ত্বার ইতিহাস। আছে পূর্ব পুরুষদের ভিন্ন গৌরবগাথা। কিন্তু যখনই মুসলমান হিসেবে ‘ইসলামের ইতিহাস’ পাঠ করে বুকে গৌরব অনুভব করছি তা একটি পরিস্কার ধর্মীয় আইডেন্টি ছাড়া আর কিছু নয়। এর বিপদ কোথায় বলছি…।

পূর্তগীজরা এদেশে এসেছিলো, এসেছিলো গ্রীকরা, ফরাসীরা আর ইংরেজরা। এদের সকলের ধর্মীয় পরিচয় ছিলো খ্রিস্টান। কিন্তু তাদের উপনিবেশকে কখনই ‘খ্রিস্টানদের ইতিহাস’ বলা হবে না, বলা হবে ‘ইউরোপিয়ান উপনিবেশ’। আমরা এখন ইতিহাস পর্যালোচনা করে যে কেউ স্বাধীন মত দিতে পারি- ইউরোপীয়ানরা ছিলো বর্বর! তারা ভারতবাসীকে অত্যাচার করেছে নিপীড়ন করেছে ইত্যাদি। একইভাবে ইউরোপীয়ানদের আগমনের পূর্বে ভারতে হানা দিয়েছিলো মধ্য এশিয়ার নানা জাতি যারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ধরে নিজেদের বলত ‘মুসলমান’। এখন তাদের শাসনামলের বিশ্লেষণ করে কেউ যদি বলে মুসলমানরা ছিলো বর্বর অত্যাচারী তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি আর শান্ত থাকবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিযোগ উঠবে। ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ ‘ইসলাম বিদ্বেষের’ অভিযোগ উঠবে। কিন্তু যৌক্তিকভাবে এটা তো অস্বীকার করা যাবে না ভারতে ‘মুসলিম শাসনে’ নানা রকম অত্যাচার অনিয়ম ঘটেছিলো। এই অনিয়মগুলোর জন্য দায়ী করা হবে এখন কাদের? যেহেতু তারা পরিচিত ‘মুসলমান’ নামে এবং তাদের ইতিহাসকে নাম দেয়া হয়েছে ‘ইসলামের ইতিহাস’- তাই দায় দায়িত্ব এই পরিচয়ের উপরই পড়বে না?

কোনো বদশার মহানুভবতাকে যদি ‘মুসলিম শাসনের সুফল’ হিসেবে দেখান, তাদের কোনো সফলতাকে যদি ‘ইসলামী শাসন’ হিসেবে দেখিয়ে ফয়দা লুটতে রাজি থাকেন তাহলে তাদের দোষগুলোর দায় তো ঐ পরিচয়গুলোকেই বহন করতে হবে তাই না? যেমন ‘মুসলিম শাসনে’ ভারতের মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানানোর দায় এখন মুসলমানদের। প্রশ্নবিদ্ধ ইসলাম ধর্মও। কিন্তু এইসব শাসকরা যদি আফগান পুশতু তুর্কী ইত্যাদি পরিচয়ে বিদ্যামান থাকতো তাহলে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানানোটা একান্ত মধ্যযুগের একজন শাসকের সময়কাল ধরে বিচার করা যেতো। যেমন হালাকু খানের বর্বরতাকে মধ্যযুগের একজন যোদ্ধা হিসেবে বিচার করা গেলেও নবী পরিচয়ে মুহাম্মদের ইহুদী গণহত্যাকে কোনোভাবে এক স্তরে বিচার করা যায় না।

অনেকে বলেন একই ধর্মের অনুসারী হয়েও হিন্দুরা কখনই একজাতি চেতনায় ঐক্যভূত হতে পারে নি জাতিভেদ প্রথার কারণে। কিন্তু ভেবে দেখতে হবে বৌদ্ধ ইহুদী খ্রিস্টান ধর্মে জাতিভেদ প্রথা না থাকার পরও কখনই তারা ধর্মীয় পরিচয়ে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করে নি। এর কারণ কি? এর কারণ ইসলাম একটি উপনিবেশিক ধর্ম। মুসলমান পরিচয়ে পৃথিবীতে তারা সাম্রাজ্য স্থাপন করবে- এটি এই ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য। বাকী ধর্মগুলোর এরকম রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের ক্রুসেডকে এখানে টেনে এনে কেউ দেখাতে চাইলে সেটা চরম হাস্যকর হবে। কারণ আমরা ইসলামে দেখতে পাই নবী মুহাম্মদ মারা যাবার পর ইসলামী খিলাফতের তরফ থেকে গণিমত সংগ্রহে ভারত সীমান্তে আবু বকর, উমার এবং উসমানের শাসনামলে আক্রমন চালানো হয়। এ সময় ধনসম্পদ লুন্ঠন এবং যৌনদাসী সংগ্রহ করতে মূলত আক্রমন করা হয়েছিলো। ইসলামের ইতিহাসের এই বিনা কারণে আক্রমনগুলোকে বাম ঘরনার ঐতিহাসিকরা ব্যাখ্যা না করে কেনো এড়িয়ে যান জানি না। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন ‘মুসলিম’ হিসেবে ভারত আক্রমন করে ‘ইসলামের ইতিহাসে’ অর্ন্তভুক্ত হচ্ছে তখন তার বাহিনীর হাতে তিনদিন ধরে লুন্ঠন চলে। নির্মমতার শেষ সীমায় পৌঁছায় ‘মুসলিম বাহিনী’। বিন কাসিম কাফেরদের প্রাপ্ত বয়স্ক সকল পুরুষদের হত্যা করেন। এক্ষেত্রে আমরা নবী মুহাম্মদের নিয়ম জানতে পারি যিনি নিম্নাঙ্গে চুল হওয়াকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ধরতেন। বিন কাসেম সেই ফর্মূলা ধরে ১৭ বছরকে ধার্য করেছিলেন। গণিমতের এক-পঞ্চমাংশ খলিফাকে পাঠান ইসলামী নিয়ম মান্য করে। ৭০০ নারীকে মন্দির থেকে বন্দি করা হয় যাদের চালান করে দেয়া হয় খলিফার কাছে। এইসব নারীমাংস বিক্রি করে দেয়া হতো। বিন কাসেম বা সমসাময়িক ‘মুসলিম শাসকদের’ জিজিয়া কর ধার্য করাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অথেনটিক সোর্স ইসলামের। কারণ এই করটি একমাত্র ইসলাম বিধর্মীদের জন্য প্রয়োগ করে। এ কারণেই ভারতে ‘মুসলিম শাসন’ কান টানলে মাথা আসার মত করে ইসলাম ধর্মটিও চলে আসে।

ধর্মীয় পরিচয়ে উপনিবেশ একটি ধর্মকে ফ্যাসিবাদী ইতিহাসের অংশ করে তোলে তার একমাত্র উদাহরণ ইসলাম। ভারতবর্ষে ‘মুসলিম শাসন’ ‘ইসলামের ইতিহাস’ নামে আরব আফগান তুর্কী শাসনকে আজো মুসলমান পরিচয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতির মানুষ যেমন জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করছেন তেমনি নিজেরাই তাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বিতর্কিত করছেন। ‘মুসলমান মন্দির ভেঙ্গে ছিলো’ বলা আর ‘ইংরেজরা মন্দির ভেঙ্গে ছিলো’ বলা এক কথা নয়। কিন্তু আমাদের ইতিহাসকে জানতে হবে ভবিষ্যতের জন্যই। ইতিহাস মুছেও যাবে না। পৃথিবীর সেই ইতিহাসে একমাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় (জাতি হিসেবে দাবী করা হয়) মুসলমানরাই হচ্ছে হানাদার! এই ইতিহাস কিন্তু প্রতিষ্ঠা করে চলেছে ‘মুসলমানরাই’। তারাই গর্ব করে নাম দিয়েছে ‘মুসলিম শাসন’ ‘ইসলামের ইতিহাস’!

এখনো সময় আছে 'মুসলমান' নামের এক অবাস্তব বায়ূবীয় পরিচয় থেকে নিজের জাতিসত্তা কে দূরে রাখুন।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted